রাত তখন ১১ টা। গণজাগরণের সেদিন চৌদ্দতম দিন। খুলনা শহরের শিববাড়ির নির্দলীয় গণমঞ্চের একজন সংগঠক তার সহসংগঠক মেয়েটির পায়ের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, 'দিদি দেখেন, এই রাতে আমাদের সংগঠকেরা কীভাবে হাঁটছে।' তাকিয়ে দেখি মেয়েটির পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। গায়ে সাধারণ একটা কাপড় পরেছে মেয়েটি। তার ওপর একটা কালো সোয়েটার পরা। কিন্তু পা জোড়া খালি। আর এভাবেই পিচঢালা পথে হাঁটছে সে। মঞ্চকেই যেন নিজ ঘর বানিয়ে নিয়েছে এখানে আসা তরুণ-তরুণীরা।
একটু পরপর শ্লোগানের শব্দ জোরালো হচ্ছে। এরই মাঝে নির্দলীয় মঞ্চের সংগঠকদের সঙ্গে মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম। আমার সঙ্গে ঢুকল প্রায় পনের জন। দুর্দান্ত সাহসী ও প্রাণবন্ত এ তারুণ্যের উপস্থিতিতে পুরো দোকান গমগম করছিল। বিকেল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ওরা। শেষে সবার দাবি, মিষ্টি খাওয়াতে হবে। ওদের দেখে আমি যেন ভুলে গেলাম সময়ের হিসেব।
দোকান দখল করে বসে আছি আমরা। খুলনাতে কীভাবে আন্দোলনের সূত্রপাত হল তা শুনছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মঞ্চের নাম নির্দলীয় গণমঞ্চ কেন। কয়েকজন ঘুরে ফিরে একই উত্তর দিল। আর তা হল, এ মঞ্চ জনতার, কোনো দলের নয়। এখানে ওরা কোনো দলীয় নেতাকে মাইক দেয় না। সবাই এখানে আসতে পারে, তবে দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকতে হয়। মঞ্চের বাইরে পথে দাঁড়িয়ে ওদের শ্লোগানের বিপরীতে শ্লোগান দিতে পারে যে কেউ, তাতে সমস্যা নেই। তবে নির্দলীয় হলেও আন্দোলনটা যে অরাজনৈতিক নয়, সে বিষয়ে নিজেদের সচেতনতার কথাও সবাই আমাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল।
আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো নেতা কি তৈরি হচ্ছে? একটি আত্ববিশাসী কণ্ঠ বলে উঠল, 'দয়া করে আমাদের নেতা বলবেন না, বলবেন সংগঠক। আমাদের মধ্যে একজন সমন্বয়ক আছেন, বয়স ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে তাকে আমরা সবাই মিলে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে দিয়েছি। কিন্তু যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে মিটিং করে সবার মতামত নিয়ে আমরা কর্মসুচি ও দাবি-দাওয়া ঠিক করি। কেউ আমাদের উপর কিছু চাপিয়ে দেয় না।'
এখানে সংগঠকের ভূমিকায় যারা আছে তারা সবাই কি অতীতে বা বর্তমানে কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত? একজন ছাড়া প্রায় সবারই কোনো না কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ততা আছে। ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে শুরু করে নাট্যদল, সমাজ সেবামূলক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন সব ধরনের সংগঠনের ছেলেমেয়েই এখানে কাজ করছে। কারও কারও মধ্যে চেনাজানাও ছিল। আন্দোলনের সূত্রে এখন অবশ্য সবার জানাশোনা বাড়ছে।
শিববাড়ির নির্দলীয় মঞ্চের তরুণ-তরুণীরা কীভাবে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে জানতে চাইলে তারা বলল প্রতিটি বিষয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা। তাদের একটা বড় সময় কাটে মিটিং করে, পর্যালোচনা করে, মানুষের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করে, আন্দোলনের দাবি ও কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে। সংগঠকদের একজনের বাড়িতে রান্না হয়, আর সবাই পালা করে সেখানে গিয়ে খেয়ে আসে। সংগঠকদের প্রায় সবাই শিক্ষার্থী বলে ক্লাস বাদ দিয়ে তাদের আন্দোলনে যোগ দিতে হচ্ছে। তবে পড়াশুনার ক্ষতি নিয়ে তারা মোটেই ভাবছে না। কারণ তাদের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ আন্দোলন। যেন একাত্তর আবার আবির্ভূত হয়েছে ওদের মাঝে। মনে হল, অল্প ক'দিনে ওরা একটা বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিয়েছে যা রেখে এক পা-ও নড়া যাবে না।
জানা গেল, ঢাকা থেকে একটা টিভি চ্যানেল আন্দোলনের সমন্বয়ককে অনুরোধ করেছিল ঢাকায় গিয়ে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে। সহ-সংগঠকদের সঙ্গে আলাপ করে সমন্বয়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আন্দোলন রেখে সে একদিনের জন্যও ঢাকায় যাবে না। প্রয়োজন হলে চ্যানেলের টিম খুলনায় চলে আসুক। তরুণদের বক্তব্য, টিভি চ্যানেলগুলো নেতা হিসেবে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার প্রচার করে আন্দোলনের সব সংগঠককে সমানভাবে কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে, এতে অনেক সময় আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাই, ওদের মত হল, মিডিয়াকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এ আন্দোলনের ধরন বুঝতে হলে, এর শক্তি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে মাঠে নামতে হবে।
শিববাড়ির মোড়কে নিজেদের ঠিকানা বলে ঘোষণা করা তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফেরার পর, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি যে, এ গণজাগরণ নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, ওখানে ছেলেমেয়েরা ঘুমায় না, কারণ ওরা ওখানে বসে ইয়াবা খায়, তারপর নাস্তিকতা চর্চাসহ নানা অপকর্ম করে। অদ্ভুত! যেন এ আন্দোলন না হলে যাদের ইয়াবা খাওয়ার প্রয়োজন তারা ইয়াবা না খেয়ে বসে থাকত! যেন শুধু ইয়াবা খাওয়ার জন্যই তরুণদের আন্দোলন করতে হচ্ছে!
খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে জানতে চেয়েছিলাম, রাতে তরুণীদের কোনো অসুবিধা হয় কিনা সে সম্পর্কে। তাছাড়া অপপ্রচারগুলো তারা কীভাবে দেখছে সেটাও জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমাকে ওরা বলেছিল, বিষয়টি নিয়ে তারা দীর্ঘ আলোচনা করেছে। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে হলে নিজেদের অবস্থানে স্থির থেকেই লড়তে হবে। তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েরা রাতে শিববাড়ির মোড়েই অবস্থান করবে।
শিববাড়ি থেকে ফিরে মনে হল, একখণ্ড শাহবাগ দেখে এলাম যেন। যদিও শাহবাগের সঙ্গে শিববাড়ির অনেক পার্থক্য; শিববাড়ি মোড়ে মানুষের উপস্থিতি ঢাকার তুলনায় অনেক কম, কিন্তু তাদের নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে তারা ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগে অনেক বেশি মানুষ, মতও তাই অনেক। সে তুলনায় খুলনায় মতপার্থক্য অনেক কম। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের মতো খুলনার চারুকলা ইনস্টিটিউটও পিছিয়ে নেই। এখানকার শিক্ষার্থীরা নানা শিল্পকর্ম ব্যবহার করে মানুষের অব্যক্ত অনুভূতি তুলে ধরছে নির্দলীয় গণমঞ্চ প্রাঙ্গনে।
শিববাড়ির তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যে শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে, তার কেবল এক ঝলক দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। কিন্তু তাতেই আমি আশাবাদী যে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেকার এ জাগরণ ভবিষ্যতে আমাদের রাজনৈতিক জমিনে একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করবে। আন্দোলনের তাৎক্ষণিক ফলাফল যাই হোক না কেন, এটা তরুণদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে। ওরা প্রতি মুহুর্তে নিজেদের সংগঠিত হওয়ার শক্তির কথা জানতে পাচ্ছে। এ জাগরণ প্রমাণ করে, আমাদের তরুণ-তরুণীরা বারবার জেগে উঠবে। আরও অনেক মানবতাবিরোধী, জাতীয়-স্বার্থবিরোধী, পরিবেশ-দূষণবিরোধী, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে শরীক হয়ে তাদের তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগাবে।
তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ধরনে এরই মধ্যে পরিবর্তন এসে গেছে। দলমতনির্বিশেষে একীভূত শক্তিকে তারা আবিষ্কার করেছে এ গণমঞ্চে। সামনে তাতে আরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে সেটি নতুন রূপ লাভ করবে। তারা শনাক্ত করতে পেরেছে নির্যাতনকারী, মানবতাবিরোধী, গণহত্যাকারী রাজাকারদের রূপ। তারা বুঝতে পেরেছে যে, ধর্মকে ব্যবহার করে যারা নিজেদের অবস্থান ও নিরাপত্তা রক্ষা করে তারা দেশের শত্রু।
এসব উপলব্ধি ওদের নিয়ে যাবে রাজনীতি চর্চার অন্য একটি স্তরে। কোনো অস্ত্র বা সহিংসতা ওদের শক্তি নয়। ওদের শক্তি ওদের শ্লোগান, চেতনা ও মানবতা। জাতির প্রয়োজনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকা আত্মবিশাসী এ তরুণরা বিফল হলে জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পিছিয়ে যাব আমরা বহু বছর। এখনই সময় ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করার।
উন্নত এ শির যেন নত হয় না কোনোদিন।
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু : সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।