নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?

আকিমুন রহমান
Published : 1 July 2010, 03:38 PM
Updated : 1 July 2010, 03:38 PM

আকাশ-বাতাস, বই-কেতাব, প্রথা প্রচারণা, বিজ্ঞাপন, জনরব, লোককথা ও গাথাসমূহ আমাদের চিরকাল ধরে জানিয়ে আসছে এই কথা যে, নারীর মানবজন্ম পূর্ণ হয় মাতৃত্বে। যে নারী মা হতে পারে না, তার জীবন অসার্থক। জীবন তার ব্যর্থ, নিষ্ফল তার দেহধারণ। আরো জানিয়ে যাচ্ছে যে, 'মায়ের চেয়ে আপন কেহ নাই।' মা মমতা দেয়, আগলে রাখে, বাঁচায়, রক্ষা করে। তার ত্যাগ, মায়া, দরদ ও সহিষ্ণুতা তুলনা রহিত এবং স্বর্গীয়। দূর দেশে যেমন তেমন, আমাদের সমাজে সংসারে মা-প্রকৃতির আশীর্বাদ-সাক্ষাৎ দয়ারূপিনী, রক্ষাকারিণী, অভয়দায়িনী পূত-পবিত্রা, সংযতা-শক্তি এক।  লোকজন ধ্রুব সত্য বলে জানে, 'সংসারে মা নেই যার, কপাল পোড়া তার'।

ওই সত্যকে মানগণ্য করে যেতে যেতে, একেবারে গভীরভাবে চোখ বুজে মানাগোনা করে যেতে যেতে- হঠাৎ এ কী বিপাকের থাবড়া খেতে হলো আমাদের! থাবড়ার চোটে মুখ ও অন্তর থ্যাতাভোঁতা প্রবলরকম। চোখ খুলে তাকানি না দিয়ে তখন আর উপায় কী! থাবড়াটা দিলো দুই মা-জুরাইনবাসিনী মাতা রীতা ও আদাবর নিবাসিনী মা আয়শা হুমায়রা। দেশবাসী ও প্রবাসী সকল বাঙালি জানেন- তাদের দু'জনের দেয়া থাবড়া কী পোক্ত ছিল! মা রীতা দুই কিশোরবয়সী সন্তান পায়েল পবনসহ আত্মহত্যা করেছেন। মা আয়শা হুমায়রা তার প্রেমিক আরিফের সঙ্গে মিলে হত্যা করেছেন ছয় বছরের পুত্র সামিউলকে। পত্রিকা জানায়, প্রেমিক আরিফ যখন সামিউলের মুখ-গলা চেপে ধরেছিল, মা আয়শা তখন শক্ত হাতে চেপে ধরে রেখেছিল আত্মজের দুই পা; যাতে হত্যাকর্মটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারে প্রণয়ী আরিফ। দু'জনে মিলে সুচারু রূপেই সম্পন্ন করেছে আপদবিদায় পর্বটি। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের বিস্তারিতই জানায়, কীভাবে মা রীতা উদ্দীপিত ও প্ররোচিত করেছিল দুই বাচ্চা পায়েল পবনকে তার সঙ্গে আত্মহত্যাকর্মে শামিল হওয়ার জন্য। মায়ের স্নেহ ও মমতার তত্ত্বাবধানেই তারা দেয়াল চিত্রিত করেছে লাল অক্ষরে অক্ষরে, ব্যক্ত করেছে সংসার ও রক্তের সম্পর্কীয়দের প্রতি তাদের অভিযোগ ও ঘৃণা; লিখেছে নিজেদের মর্মযাতনার কথা । স্ট্যাম্পে লিখেছে নানা কথা, যে পিতা তাদের পরিত্যাগ করেছে তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে চিঠি। দীর্ঘ প্রস্তুতির পরে, সকল লেখালেখি অনেকদিন ধরে সম্পন্ন করে, বহু আয়োজন শেষ করে- প্রায় ঘটা করে মা রীতা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, সন্তান দু'জনকেও স্বেচ্ছাসঙ্গী(?) হিসেবে সঙ্গে পেয়েছে, গেছে একত্রে তিনজন।

এটা কী? এটা কী! হায় হায়- কী ভয়ানক! করছেটা কী, দ্যাখছ! হইতেছেটা কী দ্যাশে! উফ্, সোসাইটিটা শ্যাষ! জোরেসোরে এই কথা সকল ঠোঁটে। তবে নিচু স্বরে আরো কথা আছে- মা হইয়া এই কাজ করছে! সি ইজ সিক! সেক্স ক্রেজি সেক্স ক্রেজি! আহাহা- কী  নির্দয় পাষাণ দীল! গড! ক্যামন মা এইগুলা!

সত্যিই তো, কেমন মা এইগুলো! মা মানে তো অসীম করুণা, অপরিসীম তিতিক্ষা, অশেষ দুর্গতি ভোগ ও অনন্ত বাৎসল্য। কেমন মা তবে এই জুরাইনবাসিনী, কীরকম মা ওই আদাবরনিবাসিনী! সন্তানকে শেষ করে! মায়ের সম্পর্কে কিংবদন্তী কী! কিংবদন্তী এই যে; মা নিজে মরে, নিজে আত্মহত্যা করতে পারে, কিন্তু রক্ষা করে যায় বাচ্চাদের। নিজে মরে গিয়ে বাঁচিয়ে রেখে যায় সন্তানকে। গরিব, হতদুর্দশার, ঘরের না-খাওয়া মায়ের মতো হরদিশা হয়ে এই কাজ করছে কি মা রীতা? সেই অনাহারী, গন্তব্যহীন, ধড়ফড়ানো মা বাচ্চা নিয়ে মরে এই ভাবনায় যে, সে মরে গেলে পোলাপানগুলাও মরবে না খেয়ে আর লাত্থিগুঁতা খেয়ে। মরবে ধীরে। তার আগে যদি মা-ই নিয়ে যায়, তবে দুর্ভোগ কম পাবে ওইগুলা। মা তাই সঙ্গে নেয়ার কর্তব্যকর্ম সারে। পায়েল-পবনের জন্য কি দুর্গতি, অনাহারের অন্ধকার ভবিষ্যৎ ওঁত পেতে ছিল? পরিস্থিতি বলে যে, সমূহ আর্থিক দুর্গতির আশঙ্কায় মা তাদের সঙ্গে নিয়ে আত্মহত্যা করে নি। তবে কেনো! আর, মা আয়শার দয়িতমিলনের পথে কি ভয়ঙ্কর বিঘ্ন হয়ে উঠেছিল ছয় বছরের পুত্র? বিঘ্ন সরানোর নেশায় এতোই মাতোয়ারা হয়ে গেছিল মা, যে, বিঘ্নের বয়স টয়স কিছুই খেয়ালে আসে নি? সেটাই-ই যে হয়েছিল, ঘটনা তো তাই-ই বলে।

কামবাঞ্ছাতাড়িত তো পথের কাঁটা সরাবেই। সরিয়েছে। চিরকাল ধরে তো তাই-ই ঘটে এসেছে। আগে ঘটেছে বহু, এই এখন ঘটালো মা আয়শা, ভবিষ্যতেও এমন আরো ঘটবে। আমরা মা আয়শাকৃত ঘটনার এমন ব্যাখ্যা নিয়ে চিল্লাপল্লা করা বন্ধ করে দিতে পারি। আর মা রীতার বিষয়ে? শ্বশুরকুলের পীড়ন নির্যাতন (মানসিক) তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলছিল বলেই, নিরুপায় মা সন্তানাদিসহ শেষ হয়ে গেছে– এই ব্যাখ্যা মা রীতাই দিয়ে গেছেন। অইসব পীড়নকারীর উচিত শাস্তি হোক– এই জোর দাবি জানিয়ে আমরা অন্য কাজে মন দিতে পারি। প্রচার মাধ্যমগুলোও অন্য সংবাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারে, কারণ ওই সংবাদ দুটোকে ইতিমধ্যে দিয়ে দেয়া হয়েছে ঢের সময় ও মনোযোগ। অনেক সময় গেছে, আমরা এবার আবার চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারি।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ঘটনা দুটো আমাদের চোখ বন্ধ করে নিতে দিচ্ছে না। একদম দিচ্ছে না। বলছে যে, এ শুধু দু'রকম মৃত্যু বৃত্তান্তই নয়। আরো কিছু আছে, গূঢ় কিছু। ঘটনা দুটো আরো গূঢ় এক পরিস্থিতির দিকে আঙুল উঁচোচ্ছে। বলছে যে, এই হত্যা এই হনন প্ররোচণা বিচ্ছিন্ন, আকস্মিক উত্তেজনাপ্রসূত ঘটনামাত্র নয়। এই সমাজে এই সময়ে বহু রূপে ও বহু রকমে যে মনুষ্যত্বহীনতা, দুষ্কর্ম ও অপরাধ চর্চা চলছে, এ তারই অন্য এক রূপ, অন্য এক প্রকাশ। মনুষ্যত্বহীনতা ও নির্দয়তা  হিত ও অহিত বোধশূন্য করেছে এই সমাজকে- বহুদিন হলো, বহুদিন ধরে আমরা তার সঙ্গেই বেশ খাপ খাওয়ায়ে আছি না কি? আছি তো। মৎস্য ব্যবসায়ী মাছে মাখাচ্ছে ফরমালিন– মাছ আর পঁচবে না; থাকবে অবিকৃত। লোকে খেয়ে মরুক বাঁচুক- ব্যবসায়ীর কী!  তার লক্ষ্য- পয়সা। পয়সা ঘরে যাচ্ছে তার। কার্বাইডে চুবিয়ে নেয়া হচ্ছে ফল, সকল ঋতুতে। মানুষ বিষ-জর্জরিত হলে বাণিজ্যকারীর কী করার আছে! মানুষ জন্ম নেয় তো মরার জন্যই। হায়াত মউত আল্লার হাতে।

হাজা মজা পানিতে কেমিক্যাল গুলে সুশোভন প্যাকেটজাত করে চালানো হচ্ছে না কি দুধ নাম দিয়ে? শিশুর ওষুধের নামে বিক্রি হচ্ছে না বিষ? মুড়ি যে মুড়ি, তারে পোতানো থেকে বাঁচানোর জন্য, আর ফকফকা শাদা দেখানোর জন্য রাসায়নিক সার মেশানো চলছে তো দেদার। গরু খাচ্ছে বিষ, ধুপধাপ মোটা হচ্ছে। সেই বিষময় গোশত যেয়ে লোকের পাকস্থলীতে পাকস্থলীতে বিরাজ করছে। স্বাভাবিক প্রসব অবধারিত যেখানে, সেই সম্ভবাও বাধ্য হচ্ছে সার্জারিতে। নইলে ডাক্তার বেশি বেশি টাকা পাবে ক্যামনে! একটা টেস্টও দরকার নেই যখন, তখন গুচ্ছের টেস্ট করার জন্য দৌড়াচ্ছে অসুখগ্রস্তরা। ডাক্তার দেয় যে! ডাক্তারের তো কমিশন পাবার রাস্তা মসৃণ রাখতে হবে! বিদ্যুতের মিটাররিডার পাড়ায় পাড়ায় সকল ঘর থেকে এসে মাসের শেষে ক্যাশ টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কেনো? না, তাকে এই চাকরিতে ঢুকতে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সেই টাকা তো তাকে ঘরে ফেরত নিতে হবে, নাকি!

"
এই হত্যা এই হনন প্ররোচণা বিচ্ছিন্ন, আকস্মিক উত্তেজনাপ্রসূত ঘটনামাত্র নয়। এই সমাজে এই সময়ে বহু রূপে ও বহু রকমে যে মনুষ্যত্বহীনতা, দুষ্কর্ম ও অপরাধ চর্চা চলছে, এ তারই অন্য এক রূপ, অন্য এক প্রকাশ। মনুষ্যত্বহীনতা ও নির্দয়তা হিত ও অহিত বোধশূন্য করেছে এই সমাজকে- বহুদিন হলো, বহুদিন ধরে আমরা তার সঙ্গেই বেশ খাপ খাওয়ায়ে আছি না কি? আছি তো। মৎস্য ব্যবসায়ী মাছে মাখাচ্ছে ফরমালিন– মাছ আর পঁচবে না; থাকবে অবিকৃত। লোকে খেয়ে মরুক বাঁচুক- ব্যবসায়ীর কী! তার লক্ষ্য- পয়সা। পয়সা ঘরে যাচ্ছে তার। কার্বাইডে চুবিয়ে নেয়া হচ্ছে ফল, সকল ঋতুতে। মানুষ বিষ-জর্জরিত হলে বাণিজ্যকারীর কী করার আছে! মানুষ জন্ম নেয় তো মরার জন্যই। হায়াত মউত আল্লার হাতে।
"

এই সবের মধ্যে এবং এমন আরো বহু কিছুর মধ্যে আমরা আছি না? আটকাচ্ছে থাকাটা? ঘৃণা ও ক্রোধ আছে অবশিষ্ট কিছু? নেই। একদম নেই। থাকলে, এইসব গলিত পুঁজ ও নির্দয় অশুভ মনুষ্যত্বহীনতা এতখানি দাপটের সঙ্গে বিরাজ করতে পারে? শুভ শুধু পরাভূতই নয়, শুভ ও কল্যাণবোধ ও ন্যায়নীতি মৃত এইখানে। তাই মা প্ররোচিত করে দুই শিশুকে- মৃত্যুবরণ করার জন্য। কারণ , সে চায় শিক্ষা দিতে শ্বশুরকুলকে। সবংশে মরে, ওই ওদের শিক্ষা দিয়ে যাওয়ার ঝোঁকই তো ওই মৃত্যুবরণের মূলে, নাকি? রীতার জীবনবৃত্তান্ত জানায়– সে সামাজিক মানুষ ছিল খুব, ছিল বন্ধুবৎসল, মা ও আত্মীয়দের ঘনিষ্ঠ ছিল খুব। তবে, ওই বন্ধু বা বোন বা মা– তারা কি করেছে? সবাই জানতো ভালোরকম, যে, রীতার সংসারে স্বামী সমস্যা চলছে। তারা কোনো মানসিক শুশ্রুষা দেয় নি, কথা বলেন নি, বান্ধবের ভূমিকা পালন করে নি। করলে, মন থেকে ওই বিকার দূর হতো। জীবন ও বেঁচে থাকার সুস্থ পথ ও প্রক্রিয়াগুলোকেই সত্য মনে হতো। শিশু দুটোকে এইভাবে হত্যা করে নিজেকে শেষ করাকেই একমাত্র পথ বলে তার মনে হতো না। তাহলে এই সমাজে চলছেটা কি?

আর, স্বামী যদি সুখ ও সময় দিতে ব্যর্থ হয়, যদি অন্য কাউকে মনেই ধরে যায় মন ও শয্যাসঙ্গী হিশেবে, তখন কেনো থাকতে হবে স্বামীটির প্রযত্নে? স্বামীটির মুদ্রা ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য? তাহলে তা লোভ। অপরিমেয় লোভ ও লালসার কারণেই তবে এই পথে থাকা, এই স্বামীর সংসারে বসত ও গোপন প্রণয়ীর সঙ্গে শরীর যাপন করে চলা। সংসারে ও সমাজের সবখানে সর্বব্যাপ্ত যে লোভ- আয়শা হুমায়রাও তারই অংশী একজন- বিচ্ছিন্ন কেউ নয় সে। মাতৃভূমিকায় এই বঙ্গে নারী কি খুব একটা সুখে আছে এখন? একদম শাদা সত্য হচ্ছে এই যে- না, সুখে নেই। সুখেও নেই, গৌরবেও নেই। আয়শা-হুমায়রা ভালোই জানিয়ে দিয়েছে সেটা।