আমরাই নির্মাণ করি স্বপ্ন

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 14 Feb 2013, 08:41 AM
Updated : 14 Feb 2013, 08:41 AM

আমার মা, কত আর বয়স হবে তাঁর তখন, আঠারো কী বিশ, সদ্যবিবাহিতা। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে, আর তিনি দৌড়ে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামে, নিজের জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে। ছোটবেলায়, যখন স্কুলে পড়তাম, নিজের জগত নিয়ে অতটা ব্যস্ত হয়ে পড়িনি তখনও, কত যে শুনেছি সেসব গল্প। শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে চলে যেতাম। কখনও-সখনও ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতাম- মায়ের সঙ্গে আমিও দৌড়াচ্ছি, মায়ের আতঙ্কিত মুখ, মা প্রাণপণে আমার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। শৈশবের সে দুঃস্বপ্নে দেখা মায়ের মুখটা আবার দেখি প্রমত্ত যৌবনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে, যেখানে পরম শ্রদ্ধেয় তারেক (তারেক মাসুদ) ভাই প্রথম দেখালেন 'মুক্তির গান'। মানুষ ছুটছে। উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না। মায়ের হাতের মুঠি থেকে সন্তানের হাত ছুটে যাচ্ছে। আজও মনে আছে, মুক্তমঞ্চে আমি কাঁদছি, আশেপাশের সবাই কাঁদছে। আমি ভিড়ের মধ্যে খুঁজছি আমার মায়ের মুখ। সবগুলো মুখ মায়ের মুখের মতো লাগছে। আমি আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি সেদিন, করতে চাইওনি। আমার বেদনা, মায়ের অসহায়ত্ব আমাকে দিয়েছিল দ্রোহের শক্তি।

আমি যুদ্ধ দেখিনি। আমাদের প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেছে মায়ের চোখে, বাবার ক্রোধে। মা আমাকে প্রায়ই বলেন, 'জানিস, আমিও মুক্তিযোদ্ধা।' অবাক হয়ে দেখতাম, আমার অতিসাধারণ মায়ের গ্রীবা তখন অহংকারে উচ্চকিত হত, চোখের মণিতে কোথাও যেন পুরোনো কোনো রোমাঞ্চ খেলা করে যেত। বলি, 'কীভাবে মা, তুমি বুঝি অস্ত্র চালাতে পারতে?' মা শতগুণ আগ্রহ নিয়ে বলে উঠতেন, 'আরে না, কেবল অস্ত্র চালালেই বুঝি যুদ্ধ করা হয়? তোর নানাবাড়িতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। যুদ্ধের ন'মাস আমি ওদের জন্য রান্না করেছি। যুদ্ধ করতে শক্তি লাগবে না?' 'কী রাঁধতে মা?' মায়ের মুখটা একটু শুকিয়ে যেত, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, 'কী আর তেমন খাওয়াতে পারতাম ওদের। সকালে লাল চালের জাও আর চ্যাপা শুটকির বার্তা। তবে হ্যাঁ, যেদিন খিচুড়ি রান্না হত ছেলেগুলো অনেক খুশি হত রে।' অবুঝ মা আমার আপন মনেই বলে যেতেন, 'ইস্, ছেলেগুলোকে আবার যদি পেতাম একটু ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াতাম।' আমি হাসি, বলি, 'মা, ওরা আর এখন ছেলে নেই, ছেলের বাবা হয়ে গেছে।' মা আমার বাস্তবে ফিরে আসেন। বলেন, 'আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা, তাই না রে?' মায়ের নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকিয়ে গর্বে আমার বুক ভরে উঠত।

আমার মায়ের চোখে যে দেশ দেখে আমি বড় হয়েছি, সে দেশই তো আমার মা। তার কাছে আমার অনেক ঋণ। চল্লিশ বছর ধরে আপেক্ষা করে আছি সে ঋণ শোধ করার জন্য, মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আমি মায়ের অযোগ্য সন্তান, তাই এতদিনেও তার জন্য কিছু করতে পারিনি। এর মধ্যে কত কী হল। আমার ধর্ষিতা মায়ের ছিন্ন শাড়ি দিয়ে বানানো যে পতাকা, সে পতাকা উড়িয়ে রক্তচোষারা দাপিয়ে বেড়াল পুরো দেশ, আমি মায়ের চোখের দিকে তাকাইনি অনেক দিন। বেদনায় নীল হতে দেখেছি আমার এক বন্ধুকে, যার বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, তাকে যখন সরকারি চাকরির তাগিদে ওই নরপশুকে প্রটোকল দিতে হয়েছিল!

আমরা কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম? ৩৫০ খুনের বদলে একটা ফাঁসি, এটা চাইতে হল কেন? কেন এ জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে? দেশ-বিদেশের কোন্ আইন-আদালত বলবে যে, ৩৫০ খুনের বিনিময়ে একটা ফাঁসি দেওয়া যাবে না! আমাদের আবেগ নিয়ে যারা খেলায় মত্ত, ইতিহাস কিন্তু তাদের ক্ষমা করবে না। মাযের চোখে দেখে একাত্তরের বেঈমানদের ঘৃণা করতে শিখেছি আমরা। কেউ আমাদের শিখায়নি যে রাজাকার নামের পশুদের ঘৃণা করতে হয়, এটা আমরা শিখেছি আমাদের অস্তিত্বের অংশ হিসেবে। আমাদের যুক্তি আমাদের সবসময় জানিয়ে দিয়েছে যে, এ ঘৃণা যত তীব্র হবে, মা-মটি-মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা তত জোরালো হবে। রাজনীতিবিদদের হাতে আমরা তুলে দিয়েছিলাম আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আবেগ, আমাদের প্রতিশোধের আগুন। তবে আজ কেন আমাদের পথে নামতে হল?

পথে যখন আমাদের নামিয়েই ছাড়লে, তখন বার্তা কিন্তু স্পষ্ট। আশা করি বার্তা পৌঁছে গেছে সব সুবিধাবাদীর কাছে। এ প্রজন্মের কোনো নেতার দরকার হয় না, কারণ এরা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার উর্দ্ধে এসে দাবি করতে জানে। এরা যেমন বিশ্বাস বর্গা দিয়েছিল, তেমনি বিশ্বাস ফিরিয়ে নিতেও জানে। এ প্রজন্ম জানে, তাদের বিশ্বাস-আদর্শ-আবেগ কুক্ষিগত করতে হয় না, ছড়িয়ে দিতে হয় সবার মাঝে। যারা 'জনগণ জনগণ' বলে মুখে তুবড়ি ছোটান, জনগণের জন্য নাকি যারা দিন-মান উৎসর্গ করে বসে আছেন, জনগণের জন্য নাকি রাজনীতির মশাল বংশ-পরম্পরায় তুলে দেওয়ার জন্য শত কৌশল খুঁজে বেড়ান- তারা আজ কোথায়? তবে কি তারা বিচার চান না, প্রতিশোধ চান না? নাকি মনে করেন ওই স্বঘোষিত নরপশুরা নির্দোষ? আর কত মিথ্যার বেসাতি? আর কত চোর-পুলিশ খেলা? সাবধান, এ প্রজন্ম অনেক স্মার্ট। ধুম্রজালের গল্প শুনিয়ে পার পাওয়া যাবে না। উল্টো নিজেদেরই ধুম্রজালে পড়তে হবে।

সুবিধাবাদী আর নীতির রাজা যারা তাদের বলছি- আপনাদের সবার বাড়িতেই তো দামি বেলজিয়ান গ্লাস রয়েছে, একবার সেখানে নিজেদের মুখগুলো দেখুন। দেখবেন, সেখানে প্রতিটি বলিরেখায় রয়েছে একালের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা। শাহবাগের প্রত্যেক টগবগে তরুণ আপনাদের ঘৃণা করে। এ থেকে আপনাদের মুক্তি নেই। কারণ অমিত সম্ভাবনার এ প্রজন্মকে আপনারা কখনও আলো আর আশার পথ দেখাননি। তাই তারাই পথ খুঁজে নিয়েছে। নিজেদের পকেটের কথা না ভেবে, ব্যাংক থেকে কায়দা করে টাকা সরিয়ে নেয়ার কথা না ভেবে, শেয়ার বাজার থেকে লুটপাটের কথা না ভেবে, খাম্বা বানিয়ে বেচার কথা না ভেবে এ প্রজন্মকে নিয়ে যদি ভাবতেন- তাহলে আজ আমরা কত উঁচুতে থাকতাম!

সোনার বাংলা, সমৃদ্ধ বাংলা, গরীবের মুক্তি, মেহনতী মানুষের মুক্তি- সব মিথ্যা স্বপ্নের দিন শেষ। আমাদের স্বপ্ন এখন আমরাই দেখি, নির্মাণ করি। আপোষরফা দিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না, রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে সোনার বাংলা হবে না। মা জাহানারা ইমাম চলে যাওয়ার আগে বলে গেছেন, 'আন্দোলন ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার পাওয়া যাবে না।' প্রজন্ম চত্ত্বরের সব মুক্তিযোদ্ধাকে জানাই অভিনন্দন। বিজয় তোমাদের হবেই, যেমন হয়েছিল একাত্তরে। আজকের এ দিনগুলো একসময় ইতিহাসের উজ্জলতম দিন হিসেবে লেখা থাকবে। ইতিহাসের নির্মাণ এখন তোমাদের হাতে। হৃদয়ের সব আবেগ, সুধা আর নান্দনিকতা দিয়ে একে নির্মাণ কর। একদিন তোমাদের এ সময়ের জন্য তোমরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গর্বিত হবে, সম্মানিত হবে- যেমন আজ মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন।

এমন উত্তাল সময়ে পড়ে আছি দূর বিদেশে একা- মনটা তাই ওই প্রজন্মের কাছেই। জানি, সময় হয়তো একদিন এ অপারগতা ক্ষমা করবে না। বন্ধুরা অনলাইন লিঙ্ক পাঠিয়ে দিয়েছে, এখানে বসে শ্লোগান শুনি, মনটা ছটফট করে। ছটফট অস্থির মন নিয়ে অবাক হয়ে দেখি নতুন এক বাংলাদেশ, দেখি নতুন এক মাতৃভুমি, দেখি আজন্ম বিমর্ষ আমার মা কেমন অহংকারী হয়ে উঠছেন।

মাসুমা বিল্লাহ্ : গবেষক, এনএফপি রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিনগেন, দি নেদারল্যান্ডস্।

b_masuma@hotmail.com