বর্জ্য-কথা

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 29 June 2010, 03:29 PM
Updated : 29 June 2010, 03:29 PM

অনেকদিন আগে রমনা পার্কে হাঁটছিলাম। পথের ঠিক ওপরেই ঝোলভরা প্লাস্টিকের প্যাকেট দেখে, বিরিয়ানি খেয়ে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছে হবে, তুলে ময়লার পাত্রে ফেললাম। তা না হলে প্যাকেট পিছলে কেউ পপাত ধরনিতল হতে পারত। তারপর যথানিয়মে হাঁটছি, এমন সময় টের পেলাম কেউ আমার পিছু নিয়েছে। বিরক্ত হলেও কিছু না বলে হাঁটছি। লোকটিও পেছন পেছন আসছে। যখন ঘুরে তাকে মোকাবেলা করব বলে ভাবছি তখনই পেছন থেকে দ্বিধাজড়িত গলায় ডাক এল, "ম্যাডাম, একটু শুনবেন?" পেছন ফিরে আমার পশ্চাদ্ধাবককে দেখি–ষাটোর্ধ্ব নিরীহ এক ভদ্রলোক। এগিয়ে এসে বললেন, "ইয়ে, আপনি কি বিদেশে থাকেন?" এমন অদ্ভুত কথা মনে হওয়ার কারণ কী? আমাকে প্যাকেটটা তুলে ময়লার পাত্রে ফেলতে দেখে তাঁর এমন ধারণা হয়েছে।

পরে ভেবে দেখেছি ভদ্রলোকের বিস্ময়াভিভূত হওয়াটা হয়ত বাড়াবাড়ি ছিল না। আমাদের অবস্থা এমনই। আমরা বাইরের দেশে গিয়ে ময়লা-আবর্জনাহীন পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে দেশে এসে তার কথা লিখি, পঞ্চমুখে গল্প করি, সেই দেশে বাস করার জন্য পাগল হয়ে যা তা করি আর একইসঙ্গে পানি খেয়ে বোতলটা নির্দ্বিধায় রাস্তায় ছুঁড়ে মারি।

দেখে-শুনে মনে হয় নোংরা থাকাটা কোনো ব্যক্তিগত নয়, সম্ভবতঃ জাতিগত অভ্যাস। আমরা জাতিগতভাবে সেই অভ্যাসটা উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করি। নয়তো এত নোংরা, এত দায়িত্বজ্ঞানহীনরকম ময়লা একটি পুরো জনগোষ্ঠীর পক্ষে হওয়া সম্ভব না। অনেকে নোংরা থাকার ব্যাপারটাকে আবার আঞ্চলিক বলে মনে করতে চান। বেশি দূর না যাই, আমার আম্মা উত্তরবঙ্গের মানুষ, গর্বভরে প্রায়ই বলে থাকেন–"এই ভাটিয়াগুলাই দুনিয়ার নোংরা!" ভাটিয়া অর্থাৎ ভাটির দেশের মানুষ। উত্তরবঙ্গের অধিবাসী উজানের মানুষ আর ময়মনসিংহ, নোয়াখালি এসব এলাকা ভাটির দেশ। এসব জায়গার বহু নদীভাঙা বা সাতচল্লিশের দেশভাঙা মানুষ উত্তরবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। ভাটিয়া প্রতিবেশীর সঙ্গে থাকতে থাকতে আম্মাদের এ ধারণা হয়। আর এ ব্যাপারে আম্মার সঙ্গে দেখেছি উত্তরবঙ্গের আরো অনেকেই একমত। আমি নিজে অবশ্য উত্তরবঙ্গ ঘুরে তাঁদের সঙ্গে একমত হওয়ার মতো তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। বিশেষতঃ আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই "গিদর" লোক খুব কম নেই (হিন্দিমূল শব্দটি রংপুর-দিনাজপুরের ভাষায় "নোংরা" অর্থে ব্যবহৃত)।

"
পনের কোটি মানুষের দেশে বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজারহাট ইত্যাদি সাধারণ মানুষের নিত্য বিচরণের জায়গাগুলোতে যে আবর্জনা তৈরি হয় তার ব্যবস্থাপনা কত বড় শিল্প হতে পারে সেটাই মাঝে মাঝে ভাবি।… এই ময়লা-আবর্জনা ঠিকভাবে ফেলা বা প্রক্রিয়া করার জন্য দরকার শত শত কর্মীর, দরকার এক বিরাট কর্মযজ্ঞ নির্মাণের। এর সঙ্গে প্রত্যেকটা মানুষের নিত্যদিনের স্বভাব বদলানোর প্রসঙ্গ যেমন জড়িত তেমনি স্থানীয় ও জাতীয় প্রশাসনকেও এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়ানো দরকার।… ময়লা কীভাবে ও কোথায় ফেলতে হবে তা একটি ধরে ধরে শেখা ও শেখানোর বিষয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ পরিবারে তা শেখানো হয় না। আর তার ফলেই আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি।
"

আবার অনেকে এর মধ্যে লিঙ্গগত তফাৎও খুঁজতে যান। নারী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও গোছালো কারণ সে ঘরে থাকে, ঘর সামলায় আর বহির্মুখী পুরুষ ঈষৎ নোংরা, অগোছালো। হায়, তা-ও যদি সত্যি হতো। এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে রাস্তার ধারে চারতলার সেই মহিলার নারকেলের বিশাল এক পাপোশ সজোরে ছুঁড়ে মারার দৃশ্য। বিদ্যুতের তারে লেগে সেটির বেগ কিছুটা প্রশমিত হয় এবং তুলনামূলক ধীরে সেটি অবতরণ করে। নয়তো সেটার অতর্কিত ঘায়ে পথচারীর উল্টে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিংবা আমার প্রতিবেশী খালাম্মার ঘরের ভেতর থুথু ফেলার অভ্যাস। অবশ্য ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেখার পর সে অভ্যাস তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিল। আর সেই কাজের মেয়েটার কাঁঠালের চামড়া আর ভুতিসুদ্ধ দেয়ালের এপাশ থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে মারা যেটা গিয়ে পড়েছিল অফিসগামী এক লোকের গায়ে? সুতরাং আমি অন্ততঃ এ ব্যাপারে লৈঙ্গিক তফাৎ মানতে রাজী নই। এ ব্যাপারে নারী-পুরুষ সমানে সমান।

তবে একটা কথা মনে হয় আমার যে, হয়ত আমরা গ্রামদেশ আর জল-জঙ্গলের মানুষ বলেই আবর্জনা সম্পর্কে এতটা উদাসীন। এর কারণ একসময় তো মূলতঃ জৈব আবর্জনাই তৈরি হতো আমাদের ঘর-গেরস্থালিতে। সেগুলো ব্যাকটেরিয়ার কল্যাণে মাটিতে মিশে যেত, আলাদা প্রক্রিয়াকরণের কথা আর ভাবতে হতো না। ফলে নগরবসতির বিপুল ও সামষ্টিক আবর্জনা যখন উৎপন্ন হলো যার মধ্যে আবার অজৈব বর্জ্যর পরিমাণ বিশাল, সেটার প্রক্রিয়াজাত করার যে একটা আলাদা পোক্ত ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার আর তার জন্য যে ঘরে ঘরে ব্যক্তির অভ্যাসের বদল দরকার সে কথাটা হয়ত আমাদের মাথায় আসেনি।

ইতিহাসের কথা, পরিষ্কারের পরাকাষ্ঠা বলে আজকে যারা পরিচিত সেই ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ বা তাদের শহরগুলো এই কয়েকশ' বছর আগেও ছিল আবর্জনার আগার। আজকের ফকফকা লন্ডন শহর গড়ে উঠেছে ১৬৬৬ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর। বলা হয় ঐ আগুনে লন্ডনের বস্তিগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বলেই আজকের তিলোত্তমা লন্ডন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। প্যারিসের পরিষ্কারগিরির ইতিহাসও শ' দু'-আড়াই বছরের বেশি না।

সুতরাং আশা করাই যায় যে, একসময় আমরাও ঐ পথে হাঁটব। আমাদের শহর আর রাস্তাঘাটগুলোতে জায়গায় জায়গায় বর্জ্যপাত্র থাকবে আর মানুষ বাদামের ঠোঙা বা কোকের কাগুজে কাপটা রাস্তায় না ছুঁড়ে "আমাকে ব্যবহার করুন" লেখা পাত্রে ফেলবে। পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়েদেরকে শেখানো হবে যে, যত দেখনদার জামাকাপড়ই পরো না কেন রাস্তায় পিচিক করে থুথু ফেলেছ কি সব মাটি,  সব স্মার্টনেস শেষ। তোমার জামার তলায় যে একটা লেজ লুকানো আছে সেটা সবাই বুঝে ফেলবে। সুতরাং কফ-থুথু যা ফেলার বেসিনে কি বাথরুমে ফেলে ধুয়ে দিয়ে তারপর বাইরে পা রাখো। রাস্তায় রাস্তায় মূত্র-ঝর্না বইবে না অথবা সময়মতো বাথরুম যেতে না পেরে মেয়েদের কিডনির বারোটা বাজবে না কারণ সারা শহর জুড়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় গণ-শৌচাগার থাকবে।

বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবস্থাপনা আজকের পৃথিবীতে যে বিরাট একটা শিল্প এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। শুনেছি জাপানে কম্পিউটার কিনতে যেমন তেমনই ফেলতেও খাজনা অর্থাৎ কর গুণতে হয়। আর গাড়ির তো কথাই নেই। সেজন্যই বোধহয় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কিংবা কম্পিউটারের এমন রমরমা ব্যবসা। পুরানো জিনিস ফেলার খরচ থেকে তৃতীয় বিশ্বে পাঠানোর খরচ হয়ত বা কম। বড় বড় দেশগুলো শিল্প স্থাপন কিংবা ব্যবসার নামে কীভাবে গরিব দেশগুলোর ঘাড়ে নিজেদের শিল্পবর্জ্য চাপায় সে এক বিরাট রাজনৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়ের বিতর্ক। ওদিকে গেলে লেখাটা ছড়িয়ে পড়বে, প্রসঙ্গও পাল্টে যাবে। এ লেখায় কেবল আবর্জনা নিয়ে আমাদের নিত্যদিনের স্বভাব ও সম্ভাবনার কথাই লিখতে চাই।

পনের কোটি মানুষের দেশে বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজারহাট ইত্যাদি সাধারণ মানুষের নিত্য বিচরণের জায়গাগুলোতে যে আবর্জনা তৈরি হয় তার ব্যবস্থাপনা কত বড় শিল্প হতে পারে সেটাই মাঝে মাঝে ভাবি।

এই ময়লা-আবর্জনা ঠিকভাবে ফেলা বা প্রক্রিয়া করার জন্য দরকার শত শত কর্মীর, দরকার এক বিরাট কর্মযজ্ঞ নির্মাণের। এর সঙ্গে প্রত্যেকটা মানুষের নিত্যদিনের স্বভাব বদলানোর প্রসঙ্গ যেমন জড়িত তেমনি স্থানীয় ও জাতীয় প্রশাসনকেও এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়ানো দরকার।

ময়লা কীভাবে ও কোথায় ফেলতে হবে তা একটি ধরে ধরে শেখা ও শেখানোর বিষয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ পরিবারে তা শেখানো হয় না। আর তার ফলেই আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি। মনে আছে, ছোটবেলা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত আনন্দমেলা নামে ছোটদের পত্রিকাটি পড়তাম। সেখানে কলকাতা সিটি করপোরেশন থেকে ময়লা ফেলা নিয়ে সুন্দর ছোট ছোট বিজ্ঞাপন-গল্প দেওয়া হতো যাতে বিষয়টি সম্পর্কে শিশুরা তো বটেই তাদের অভিভাবকরাও সচেতন হন।

অর্থাৎ যেখানে পরিবার নিজেই অসচেতন সেখানে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হয় মানুষের অভ্যাস পাল্টানোর চেষ্টা নিয়ে। প্রচারপত্র দিয়ে, পত্রপত্রিকায় সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে, পথসভা করে মানুষকে সচেতন করতে হয়। আবর্জনা ফেলার আইন করতে হয় এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করতে হয়। দূর-বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই, কলকাতাতেই দেখেছি রাস্তার হকার বিশেষ করে যাঁরা খাবার বিক্রি করেন তাঁদের সঙ্গে একটা করে ময়লা ফেলার ড্রাম জাতীয় পাত্র থাকে। ক্রেতারা খেয়ে ঠোঙাটা সেখানেই ফেলছেন। ভীষণ ঘিঞ্জি রাস্তা বা ফুটপাথেও দেখা যাবে একই দৃশ্য। একপাশ দিয়ে লোক হাঁটছে, অন্যপাশে খাবার বিক্রি করছেন হকার, সঙ্গে ময়লার পাত্র। আমরা এখানে ফুটপাথ দখলের বিরুদ্ধে চীৎকার করে গলা ফোলাই, অথচ পরিচ্ছন্নভাবে, ভদ্রভাবে জায়গাটি ব্যবহার করলে গরিব লোকটিরও পেট বাঁচে আবার পথচারীও চলাচল করতে পারে। ভদ্রতা ও শালীনতার প্রসঙ্গটি আলাদা। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য ভিন্ন পরিসর প্রয়োজন।

আমি ফুটপাথের হকার দু-একজনের সঙ্গে বিষয়টি যে আলাপ করিনি তা না, কিন্তু তাঁরা আমার কথা শুনবেন কেন? এজন্য নিশ্চিত চাই আরো বড় চেষ্টা।

বাসাবাড়ির আবর্জনা সংগ্রহে এখন কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গড়ে উঠেছে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি। ওয়েস্ট কনসার্নের মতো মাঝারি মাপের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দু-একটি আছে আর আছে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এরকম ছোট ছোট আরো অনেক উদ্যোগ গড়ে ওঠা উচিত যেগুলোর নেতৃত্বে থাকতে পারে শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ছোট-বড় শহরের বাসাবাড়ির শুধুমাত্র আবর্জনা সংগ্রহের কাজটাই বহু মানুষের জীবিকার চমৎকার উৎস হতে পারে। আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করা থেকে কর্মসংস্থানের কথা তো বলাই বাহুল্য।

শেষ করি আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলে। বছর দশেক আগে এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হয়ে ঢাকা শহরের প্রান্তবর্তী এক এলাকায় টোকাইদেরকে নিয়ে এক গবেষণা করেছিলাম। সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ফেলা হয় সেখানে। বাচ্চাগুলো সেই ময়লার গাদায় আবর্জনা কুড়াত। গবেষণা শেষে আমার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম আমার দলের শিশুদের পরিবারগুলোকে জড়িত করে একটা ছোট সমিতি জাতীয় প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে যারা এলাকার আবর্জনা সংগ্রহ আর প্রক্রিয়াকরণের কাজ করবে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা থাকবে পরিবারগুলোরই হাতে, লাভ ভাগাভাগি হবে। সমিতির ঐক্য পরিবারগুলোর সামাজিক নিরাপত্তাও বাড়াবে। কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছাড়া আর পথ কোথায় যাতে সকলেরই উপকার হয়? আমার কর্তৃপক্ষ, বলাই বাহুল্য, তাতে কান দেননি। বছরখানেক অনেক লাখ টাকা খরচ করে লোকজন পুষে, বিরাট অফিস ভাড়া দিয়ে, অফিসের কর্মী আর তিরিশ-চল্লিশ জন পথশিশুকে দুপুরে মুরগির আস্ত ঠ্যাং খাইয়ে তারপর একদিন হঠাৎ অফিস গুটিয়ে ফেললেন। ময়লার টোকাই ময়লার গাদাতেই ফিরে গেল।