পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

জাহিদুল ইসলাম
Published : 7 Feb 2013, 04:33 PM
Updated : 7 Feb 2013, 04:33 PM

এ বছর, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে গিয়েছিলাম কানাডার উইনিপেগে, পানিসম্পদ নিয়ে দু'দিনের এক কর্মশালায় যোগ দিতে। উইনিপেগ কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের রাজধানী। আলবার্টা, সাসকাচোয়ান আর ম্যানিটোবা এ তিন প্রদেশকে একসঙ্গে বলা হয়ে থাকে 'প্রেইরি প্রভিন্স'।' প্রেইরি শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করা কঠিন, তবে এটি জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতিকগত দিক দিয়ে এক ধরনের সমতল অঞ্চল যেখানে গাছপালা তূলনামূলকভাবে কম; মূলত তৃণভূমি, এবং জলবায়ু বেশ শুষ্ক। এ তিন প্রেইরি প্রভিন্সের সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত পানিবিজ্ঞানী ও পানিপ্রকৌশলীদের নিয়ে এ কর্মশালার আয়োজন করেছিল 'প্রেইরি প্রভিন্স ওয়াটার বোর্ড' নামে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থা। কানাডায় একেকটি প্রদেশের পানিসম্পদ তার নিজের, কিন্তু এ অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন চুক্তির নিরূপণ, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেইরি প্রভিন্স ওয়াটার বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য ছিল পানিসম্পদ-বিষয়ক সাধারণ সমস্যা নিয়ে প্রাদেশিক সরকারগুলোর পানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, সে সঙ্গে পানিসম্পদের ক্ষেত্রে এক প্রদেশের অর্জন অন্য প্রদেশের পানিবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শেয়ার করা। আমি ব্যাক্তিগতভাবে আলবার্টা প্রদেশে কর্মরত, কিন্তু কর্মশালায় যোগ দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ তিন প্রদেশের পানিসম্পদগত বিভিন্ন সমস্যা, সমাধানের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ ভালো একটি ধারণা পেলাম।

ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম, এবারে ধান ভানার ফিরিস্তি। উপরের অনুচ্ছেদে যে গুটিকয়েক তথ্য দিলাম তা একটু বিশ্লেষণ করি।

এক. কানাডার মতো একটি অভিন্ন দেশেও প্রদেশগুলোর মধ্যে পানিসম্পদ নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। সে সব নিরসনেই তারা পরস্পরের সঙ্গে চুক্তি করে। তাছাড়া একটি সাধারণ সংস্থা সমস্যা সমাধানে বা পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে।

দুই. সাধারণ অববাহিকা অঞ্চলের পানিবিশেষজ্ঞদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও তথ্যপ্রবাহ সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক উন্নয়নের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। এর কারণ একটাই, আর তা হল নদী-অববাহিকার সীমারেখা, তা একই দেশে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যেই হোক বা এক বা একাধিক দেশের মধ্যেই হোক- কখনও রাজনৈতিক সীমারেখা মেনে চলে না। ভূ-প্রকৃতিকগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নদী অববাহিকার একদম শেষে। অন্যদিকে নেপাল, ভারত ও চীনের অবস্থান একদম উজানে যেখানে নদীর জন্ম হয়েছে, অথবা মাঝামাঝিতে। এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি নদী এসেছে মিয়ানমার থেকে। তাই বাংলাদেশের পানিসম্পদ নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একইসঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র (বা যমুনা) নদীর অববাহিকায় রয়েছে চীন, ভারত, তিব্বতের অঞ্চল এবং গঙ্গা (বা পদ্মা) নদীর অববাহিকায় রয়েছে নেপাল ও ভারতের অঞ্চল, সেহেতু সবক'টি দেশই বাংলাদেশের পানিসম্পদ সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ দেশগুলোকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে ভারতের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক পানিসমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদের এত কাঠখড় পোহাতে হয় সেখানে এতগুলো দেশ নিয়ে আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠন কতটা বাস্তবসম্মত চিন্তা? আমার ব্যক্তিগত মত হল, এটি মোটেই আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। এশিয়ারই 'মেকং নদী কমিশন' এরকম আঞ্চলিক একটি সংস্থার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবন্টন নিয়ে কাজ করা ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনও ছোট আঙ্গিকে একটি আঞ্চলিক সংস্থা।

প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বাংলাদেশ যেমন ভারতের ভাটিতে, তেমন ভারত চীনের ভাটিতে অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানিবন্টনের ক্ষেত্রে ভারতকে যত উদাসীন দেখা যায়, একই ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ভারত ঠিক ততটাই উদ্বিগ্ন থাকে। উজানে কোনো পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বাংলাদেশে এর কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে ভারত সেটি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। কিন্তু চীন যদি উজানে কোনো প্রকল্প হাতে নেয় তাতে ভারতের স্বার্থের যেন বিঘ্ন না ঘটে সেটা চীনকে ঠিকই মনে করিয়ে দেয়।

ভাটি আর উজানে অবস্থিত দু'দেশের সঙ্গে একই ধরনের ইস্যুতে ভারতের দ্বৈত অবস্থান এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, সব দেশই নিজের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু পানিসম্পদ নিয়ে অন্তর্জাতিক কনভেনশনে পানিসম্পদ ইস্যুতে সাম্যতার কথা বলা হয়েছে, হোক তা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েই। তাই একটি আঞ্চলিক পানি উন্নয়ন বোর্ড হলে একই টেবিলে সব ক'টি পক্ষের সামনে এরকম দ্বৈতস্বত্ত্বার প্রদর্শন ভারতের জন্য কঠিক হবে বৈকি।

এছাড়া, গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই ভারত গঙ্গায় পানির প্রবাহ বৃদ্ধির বাংলাদেশি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছে। প্রস্তাবটি হল, গঙ্গানদীর উজানে নেপালে বাঁধ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি সঞ্চয় করে শুষ্ক মৌসুমে তা প্রবাহিত করা। এতে দুটি সুফল আছে। এক, ফারাক্কায় শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে যা কিনা ২০২৬ সালের পর (২০২৬ সালে গঙ্গা-চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে) পুনরায় গঙ্গা-চুক্তির নবায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দুই, আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নেপালে বাঁধের সঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হলে এর সুফল তিন দেশই ভোগ করতে পারবে।

পানিসম্পদ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠনের সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে উপরের অনুচ্ছেদগুলোতে কেবল সংকট বা বিরোধ নিষ্পত্তির কথাই বলা হল। এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের পানিসম্পদের অধিকাংশই আসে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার মাধ্যমে। এ অববাহিকা চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তৃত। এ অববাহিকার পানিচক্র বা হাইড্রোলজিকাল সাইকেলের ভৌত প্রক্রিয়াগুলোকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন একটি কার্যকরী গাণিতিক মডেল। এ মডেল একইসঙ্গে অববাহিকার বর্তমান অবস্থা উপস্থাপন করবে। সে সঙ্গে অববাহিকায় সম্ভাব্য জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সার্বিক পানিসম্পদের উপর এর বিরূপ প্রভাব নিরূপণের জন্য ব্যবহৃত হবে।

এরকম একটি গাণিতিক হাইড্রোলজিকাল মডেল তৈরি করতে প্রয়োজন প্রচুর উপাত্তের যার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাব। যেহেতু এ অঞ্চলের অববাহিকাগুলোর জন্য আঞ্চলিক কোনো সংস্থা নেই, তাই দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক কোনো উপাত্ত জনসাধারণ তো দূরের কথা, হয়তো সরকারগুলোর কাছেও নেই। অথচ উপাত্তগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত হলে এ অঞ্চলের পানিবিশেষজ্ঞদের গবেষণা এবং সর্বোপরি আঞ্চলিক পানিসম্পদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড গঠিত হলে তা এ অঞ্চলের একটি তথ্য ও উপাত্ত ভান্ডার হিসেবেও কাজ করবে।

জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক (বেন) এর যৌথ আয়োজনে ঢাকায় হয়ে গেল দক্ষিণ এশীয় পানিসম্পদ নিয়ে ক'দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ কনফারেন্সে যোগদান করতে পারিনি, তবে গঙ্গা-চুক্তি নিয়ে ড. মো. খালিকুজ্জামান ও সারফরাজ আলমের সঙ্গে যৌথভাবে আমার লেখা একটি প্রবন্ধ এতে উপস্থাপিত হওয়ায়, খুব কাছে থেকে এর কার্যক্রম দেখা হয়েছে। মূল যে বিষয় কনফারেন্সে উঠে এসেছে তা হচ্ছে, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে যত মতবিরোধই থাকুক না কেন, পানিসম্পদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই, অন্তত বৈজ্ঞানিক মহল সেটাই মনে করেন।

প্রস্তাবিত আঞ্চলিক পানি বোর্ড স্থাপন সহযোগিতা বৃদ্ধির পরিকল্পনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবে বলে আমার বিশ্বাস।

ডঃ জাহিদুল ইসলাম: পানিবিশেষজ্ঞ ও লেখক।