মদনটাক পাখির দেশের বস্ত্রবালিকারা

আরিফ জেবতিক
Published : 29 Jan 2013, 03:09 PM
Updated : 29 Jan 2013, 03:09 PM

আসন্ন বিজিএমইএ নির্বাচন নিয়ে সরগরম বস্ত্রপাড়ার রথী-মহারথীরা যখন শনিবার ছুটির দিনে নগরীর পাঁচতারকা হোটেল আর অভিজাত ক্লাবগুলোর বৈঠকখানা ভাড়া করে ফেলোশিপ লাঞ্চে বসে প্যানেল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, তখন এ নগরীরই মোহাম্মদপুরের এক বদ্ধ কারখানায় পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন সাত পোশাককর্মী। তবে আপাতত এসব পুড়ে যাওয়া মূর্খ শ্রমিকরা মৃত্যুর সময়ও বিজিএমইএ-কে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন। কারণ জানা গেল পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানা 'স্মার্ট এক্সপোর্ট গামেন্টস' এর বিজিএমইএ-র সদস্যপদ ছিল না। সদস্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নিহত পোশাককর্মীদের জন্য বিজিএমই দুই লাখ টাকার একটি করে বরাদ্দ দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু এ সাত পোশাককর্মী এ চৌদ্দ লাখ টাকাও বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেন।

স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস নামের এ পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠানের মালিক আসলেই স্মার্ট লোক, এমনভাবে ব্যবসা করছিলেন যে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, এ মৃত্যুর দায়ভার কারও ঘাড়েই বর্তাচ্ছে না। বিজিএমইএ-র সদস্য নয়, সুতরাং তারা দায় না নিলেও পারবে। আগুনলাগা ভবনটি নাকি রাজউকের আওতাধীন এলাকায় নয়, সুতরাং এ ভবন তৈরির কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি- বাড়ির মালিক ভদ্রমহিলা খুব আরাম করেই সাংবাদিকদেরকে এ তথ্য জানিয়ে নিজের হাত মুছে ফেলেছেন।

যাদের কাজ চলছিল সে বায়াররা বলেছে, তারা জানতই না যে তাদের কাজ ওই দুষ্টু কারখানায় চলছিল। সুতরাং তারাও নিষ্পাপ। বাকি থাকত আমাদের সরকার। সে সরকার বাহাদুরের কর্তাব্যক্তি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই ধরনের বড় ঘটনা তাজরিন গার্মেন্টসের ব্যাপারেই জানিয়েছেন যে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য মালিকদের গ্রেপ্তার করা আসলে সমস্যার সমাধান নয়! তাহলে দেখা যাচ্ছে, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক রাষ্ট্র তৈরি করেছি যেখানে অর্থনীতির চাকা চালু রাখা শ্রমিকরা বেওয়ারিশ হিসেবে ঘোষিত হচ্ছে, তাদের আয়ের ভাগ আমরা সবাই পেতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের লাশের ভার নিতে কেউই রাজি নয়।

এ জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি বাংলাদেশের একজন নিরীহ নাগরিক হিসেবে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, তাহলে এ মৃত্যুর দায়ভার আসলে কার? আমি আমার পাঠকদের ভাবতে অনুরোধ করি যে এরকম মৃত্যু কি আমরা চলতে দিতেই থাকব নাকি এ নরকযজ্ঞ প্রতিরোধে আমরা সবাই একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠব? আমেরিকান ডলার কি আমাদের কাছে এমনই মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা আমাদের নিজের দেশের নাগরিকদের পুড়ে কয়লা হয়ে যেতে দেখলেও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছি?

আমরা সবাই যদি দায়ভার ঝেড়ে ফেলি তাহলে এ হত্যাযজ্ঞ থামবে না। আমি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিভাবক সরকারের কাছে তাই জোর দাবি জানাই যে, এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আপাতত যেহেতু মূল মালিক পলাতক, তাই প্রথমেই গ্রেপ্তার করা হোক ভবনের মালিককে। কেন তিনি নিজে একটি অবৈধ ভবন তৈরি করলেন যেখানে পর্যাপ্ত প্রশস্ত সিড়ি ছিল না? কীভাবে তিনি একটি অনুমোদনবিহীন কারখানাকে তার ভবন ভাড়া দিলেন?

এ কারখানায় কাজ চলছিল স্পেনের বিখ্যাত রিটেইল জায়ান্ট ইন্ডিটেক্স-এর। ইন্ডিটেক্-এর মালিক বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধনী। আমার দেশের দরিদ্র মানুষ পুড়ে পুড়ে তাকে বিশ্বের সেরা তিন ধনীর একজনে পরিণত করেছে। ঢাকার স্থানীয় ইন্ডিটেক্স অফিস জানিয়েছে যে তারা সরাসরি স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টসে কাজ দেয়নি, বরং তাদের কাছ থেকে অন্য একটি পোশাক প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়ে ওখানে ইন্ডিটেক্সের অগোচরে সাবকণ্ট্রাক্ট করিয়েছে। ঘটনা সত্যি হতে পারে, কিন্তু সেটি ইন্ডিটেক্সের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় না। বায়ারদের স্থানীয় অফিসের দায়িত্বই হচ্ছে কোনো গার্মেন্টস কারখানায় কাজ দিলে সেখানে কর্মপরিবেশ ঠিক আছে কিনা সেটি নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া। একই সঙ্গে যে কাজ দেওয়া হচ্ছে সে কাজ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা ওই কারখানার আছে কিনা সেটি নিশ্চিত হয়েই কাজ দেওয়া হয়।

এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ইন্ডিটেক্স-এর লোকেরা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এসব এড়িয়ে যাওয়ার কারণেই কিন্তু এসব অনুমোদনহীন রুগ্ন গার্মেন্টস কারখানায় ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর, যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে হাজার হাজার শ্রমিক। কারখানাগুলো অনুমোদনের তোয়াক্কা করছে না, কারণ সাবকণ্ট্রাক্ট প্রাপ্তি সহজ হয়ে গেছে। একই ধরনের কাণ্ড চলছিল তাজরীন গার্মেন্টসেও, সেখানেও সাবকণ্ট্রাক্ট কাজ করছিল তাজরীন এবং ওয়ালমার্ট কর্তৃপক্ষ 'আমরা জানতাম না' বলেই কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছেন।

সুতরাং সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে এসব বায়ারদের বাংলাদেশ অফিসের কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা। বেআইনি কারখানায় কাজ চলার বিষয়টি তারা আদৌ জানতেন না নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন সেটি নিশ্চিত হতে হবে। বাংলাদেশ থেকে শুধু বিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিলেই তো চলবে না, 'হত্যা-পরিবেশ' উৎসাহিত করার দায়ও তাদের নিতে হবে, এবং সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য হতে হবে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে যাদের গ্রেপ্তার করা জরুরি, তারা হচ্ছে বিজিএমইএ-র সদস্য সে পোশাক মালিকরা, যারা এসব অবৈধ সাবকণ্ট্রাক্ট করিয়ে নিজেরা মুনাফা লুটছেন। এ হত্যার দায়দায়িত্ব তাই তাদেরই বেশি। এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনলে এসব অবৈধ সাবকণ্ট্রাক্ট দেওয়া দ্রুত বন্ধ হয়ে আসবে।

হতাশার বিষয় হচ্ছে এ ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বন্ধে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ বা সদিচ্ছা আছে বলেই মনে হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যেই বলেছেন যে, গার্মেন্ট মালিকদের গ্রেফতার করা সমস্যার সমাধান নয়। আমি জানতে চাই, মাননীয় মন্ত্রী, তাহলে আপনিই বলুন সমস্যার সমাধান কোনটি? আপনি যে সমাধান বলবেন সেটিই আমরা মেনে নেব। কিন্তু সমাধান তো করতেই হবে, তাই না? বিজিএমইএ সভাপতি সাংবাদিকদের বলেছেন যে, স্বল্প মজুরির কারণে কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত করা যাচ্ছে না। তিনি বলেছেন, পোশাকপ্রতি মাত্র ২০ সেন্ট মজুরি বৃদ্ধি করলেই রাতারাতি কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স বা কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটে যাবে। হয়তো সত্যি কথা, কিন্তু কেন যেন বিশ্বাস হয় না।

যখন ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার ছিল ৪০ টাকা, তখনও কর্মপরিবেশ উন্নত হল না আর যখন এক ডলারে ৮০ টাকা পাওয়া গেল তখনও কর্মপরিবেশের উন্নতি হল না, আর মাত্র ২০ সেন্টের জন্য কি আর আটকা পড়ে আছে? অভ্যাসগত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কারখানাগুলোকে মরণকূপ হিসেবে রেখে দেওয়া লোভীরা যে ওই ২০ সেন্টও পকেটে ঢুকাবেন না, এমনটা বিশ্বাস করার মতো ঈমানী জোর বাংলাদেশে খুব কম লোকেরই হবে। তাই রাতারাতি কর্মপরিবেশ উন্নত করার পদ্ধতি আসলে একটিই- দায়ী প্রত্যেক মানুষকে বিচারের মুখোমুখি করা।

আমি জানি না আমাদের এসব চিৎকার চেঁচামেচি আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে নাকি আগের অসংখ্যবারের মতোই অরণ্যে রোদন হয়ে থাকবে। পোশাক শ্রমিকদের মৃত্যু এতই নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এসব নিয়ে আর লিখতেও ইচ্ছে হয় না, কেমন যেন ক্লান্তি লাগে। তবু আবারও লিখতে বসলাম একটি কারণে। সোমবারের পত্রিকায় পোশাক শ্রমিকদের বিষয়ে ফলোআপের সঙ্গে পত্রিকার ভেতরের পাতায় আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় একটি আহত মদনটাক পাখি জবাই করেছিল দুই তরুণ। খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওইদিনই দুই তরুণকে গ্রেফতার করে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির আহমদ মোবাইল কোর্ট বসিয়ে দুজনকে ৬ মাসের জেল ও ৬০০ টাকা জরিমানা করেছেন।

খবরটি পড়ে আমার খুশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি বিষন্ন হয়েছি। হায়, আমরা এমন এক রাষ্ট্র তৈরি করেছি যেখানে একটি মদনটাক পাখি খুন হলেও দুই আসামী গ্রেপ্তার হয়ে ৬ মাসের জেল খাটে, কিন্তু সাত সাতজন পোশাক শ্রমিক খুন হলেও কারও ৭ দিনের শাস্তি হবে না- এ উপলব্ধি আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

আরিফ জেবতিক : ব্লগার ও সাংবাদিক।