বাজেট ২০১০-১১: উপেক্ষিত কৃষি

এম এ সোবহান
Published : 22 June 2010, 10:50 AM
Updated : 22 June 2010, 10:50 AM

বাজেটে কৃষিকে সঠিভাবে মূল্যায়ন করা হ্য় নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় পরিষ্কার ভাবে বলেছেন "কৃষিকে আমরা আলাদা করে দেখছি না।" গ্রামীণ অকৃষি খাতসহ পল্লী উন্নয়নের সকল কিছুই যদি কৃষি খাতের আওতায় আনা হয় তাহলে কৃষক এবং ফসলের সুনির্দিষ্ট সমস্যা কী করে সমাধান করা হবে? এই দুটি খাত যে এক নয় তা বাজেটের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত না করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে মিলিয়েছেন, যা মোটেও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হতে পারে না।

কৃষিতে বরাদ্দের পরিমান ৭৪৯২ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৫.৪%। এই বরাদ্দের নির্দিষ্ট ভাগ দেখলে আরো বোঝা যায় যে এই বাজেট মোটেও কৃষক ও ফসল-বান্ধব নয়।

আমরা জানি কৃষি মানেই কৃষক এবং তার জীবন ও জীবিকা। আমরা অবাক হয়ে দেখেছি যে কৃষকের কথা খুবই সংকীর্ণ অর্থে, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কৃষি উপকরণ সহায়তা -কার্ড বোরো মৌসুমে বিতরণ করা হয়েছে ১ কোটি ৯২ লক্ষ কৃষক পরিবারে। ২০০৯-১০ সালে দেয়া এই বিতরণকে সরকার সাফল্য বলে দাবি করছে । মাত্র ১০ টাকা দিয়ে কার্ড করে এই সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে।বাজেটে কৃষককে কার্ডধারী, কিংবা কৃষক বিপণন দলের সদস্য, কৃষক সদস্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই ধরনের ভাষা স্বাধীন পেশার কৃষকের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না, বরং শুধু কোম্পানির সাথে জড়িত কৃষকের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়।  আমাদের কৃষি কি সেই দিকেই ছুটছে?

আমরা উদ্বিগ্ন যে, অসাংবিধানিক তত্ত্ববাধায়ক সরকার (২০০৭ – ২০০৮) কৃষক এবং জনগণের  কথার তোয়াক্কা না করে হাইব্রিড বোরো ধান চাষের যে ব্যাপক প্রচলন করেছিল তা কৃষকের অনেক ক্ষতি করেছে। এবার বাজেটে (২০১০ – ২০১১) অর্থ বছরে ১২ লক্ষ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ করার পরিকল্পনা করেছে। অথচ বিভিন্ন গবেষণা ও পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেছে যে, কৃষক এই বীজ নিতে চান না, কারণ মৌসুমের সামান্য তারতম্য হলে ফলন ভাল হয় না, ধানের মানও ভাল নয়, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে  পারে না, এবং বেশি খরচের জন্য কৃষক ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত এলাকার ৫০% জমিতে লবণাক্ততা প্রতিরোধক ব্রী ৪৭ ধান আবাদের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্থানীয় জাতের ধান, যার মধ্যে অনেক উচ্চ ফলনের সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কালা বোরো, খৈয়া বোরো, চৈতা বোরো এবং টোপা বোরো। এই সব দেশীয় জাতের ধান স্থানীয় আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারে।

সরকার এমন ধান উৎপাদনে সহযোগিতা না করে বিদেশ থেকে আহরিত অজানা উৎসের নতুন ধান প্রচলন করছেন, যা ইতিমধ্যে কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। এমন কি, ২০০৯-১০ বোরো মৌসুমের ও উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ব্রীধান ৪৭ এর ফসলহানি ঘটেছে। এ প্রসংগে ব্রীর উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‍‍"এবারে কলাপাড়া বা অন্য কোথাও মারা গেছে। পরের বার হয়তো আরো অনেক জায়গায় মারা যাবে। তাই কৃষি পরিকল্পনাবিদদের এদিকে খেয়াল রাখা জরুরী (যায়যায় দিন, ১৬ মে, ২০১০,''| এ প্রসঙ্গে আরো জানিয়েছেন, "ব্রীধান ৪৭ এর মারা যাওয়ার কারণ ছলি (অধিক) লবণাক্ততা (কালের কণ্ঠ, ১৭ জুন, ২০১০।"

এ বাজেটে প্রস্তাবিত ৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ব্রীধান আবাদ করতে ২০১০-১১ বোরো মৌসুমে হেক্টর প্রতি ২৫ কেজি বীজ হিসাবে ১২,৫০০ টন বীজের প্রয়োজন হবে। যার বাজার মূল্য প্রতি কেজি বীজের দাম ৫০ টাকা হিসাবে ৬২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। এছাড়া লাগবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, পানি সেচ জমিচাষ সহ অন্য উপকরন খরচ। লবণাক্ততাসহ অন্যান্য প্রতিকূলতায় ফসলহানির আশংকা মাথায় নিয়ে উল্লেখিত জমির প্রচলিত ফসল বাদ দিয়ে ব্রীধান ৪৭ আবাদের পিছনে কী যুক্তি এবং কার স্বার্থ নিহিত আছে তা আমরা বুঝতে পারছি না। তবে এর  ফলে স্থানীয় কৃষকদের যে ফসলহানির আশংকা দেখা দেবে এবং আমাদের খাদ্য সার্বভৌমত্ব যে হুমকীর সম্মুখীন হবে তা ভেবে আমরা আতঙ্কিত।