আমাদের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বাচাল

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
Published : 23 Jan 2013, 06:19 PM
Updated : 23 Jan 2013, 06:19 PM

আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন সরকারের সময় যাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁরা একেকজন একেকটি 'ক্যারেক্টার।' তাঁদের আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁরা যেভাবে বিরোধীদের দমন-পীড়ন করেছেন পরে সেসব নিপীড়ন তাঁদেরও সইতে হয়েছে, তাঁরা বিরোধীদের জন্য কারাগারে যেসব প্রকোষ্ঠ বানিয়েছেন– সেসব প্রকোষ্ঠে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও তাঁদের থাকতে হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা যে ছিন্ন হল না বর্তমানে সেটাই আরও স্পষ্ট হচ্ছে।

তথ্যমন্ত্রীরা কথা একটু বেশি বলেন। কারণ মিডিয়া সবসময় তাঁদের কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমাদের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই একটু বাচাল হয়ে থাকেন। তাঁদের এ বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করা দরকার।

তবে একেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি কিন্তু একেক রকম। আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শব্দচয়নের দিক থেকে অসাধারণ। খুব বেশি শিক্ষিত লোক না হলে তাঁর বক্তব্য বোঝা মুশকিল। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে তাঁর কথার মর্ম বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। তিনি বেশ দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করেন। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর পুরো বাক্যটির মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের বেশ আকৃষ্ট করে রাখেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন আমলা ছিলেন, এবং অত্যন্ত সুদক্ষ ও স্বনামধন্য ছিলেন। আমলারা যে স্টাইলে নোট লিখেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর বয়ান ও শব্দচয়নে সে স্টাইল প্রতিফলিত হচ্ছে।

এমনিতে তিনি কিন্তু খুবই সজ্জন একজন ব্যক্তি। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম ইন্টারাকশন হয় ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে। তখন ভুমি-সংস্কারের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছিল। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরশাদ সরকারের একজন প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষেতমজুরদের অধিকার নিয়ে আমাদের সঙ্গে বেশ খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। সে সময় তিনি আমাদের চমৎকার সহযোগিতা করেছেন একথা স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন যার অনেক কিছুই জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। একটি উদাহরণ দিই। আমরা সিপিবি-বাসদ যৌথভাবে হরতাল ডেকেছিলাম ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন হরতাল সফল হওয়ার পর উনি অযাচিতভাবে জনসমক্ষে আমাদের ধন্যবাদ জানালেন। আমরা কিন্তু তাঁর কাছে থেকে ধন্যবাদ-প্রত্যাশী ছিলাম না। বরং ওই হরতাল ডাকার পেছনে আমাদের তিনটি দাবি ছিল। প্রথমটি ছিল, দেশকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। দ্বিতীয়টি ছিল, জ্বালানি তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবি। এটি কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে। তৃতীয়টি ছিল, হলমার্ক ইত্যাদি কেলেঙ্কারির তদন্ত করে দায়ীদের বিচার দাবিসংক্রান্ত। এটিও কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে।

সুতরাং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধন্যবাদ যদি এতটাই আন্তরিক হত, তাহলে তিনি জ্বালানি তেল বা বিদ্যুতের দামসহ বাড়িভাড়া, বাসভাড়া না বাড়ানোর দাবি মেনে নিতেন। আসলে হয়েছে কী, আমাদের ডাকা হরতালের অভূতপূর্ব সাফল্য আঁচ করতে পেরে তিনি একে দলীয়ভাবে পকেটস্থ করতে চেয়েছেন মাত্র, অন্য কিছু নয়।

তিনি অন্যান্য দলকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেছেন যে, কীভাবে একটি সফল হরতাল করতে হয় সে শিক্ষা যেন তারা সিপিবি-বাসদের হরতাল থেকে নেন। এ শিক্ষা অন্যদের নিতে না বলে তিনি নিজে নিলে আমরা বেশি লাভবান হতাম। কারণ এরপর গত ৯ জানুয়ারি আমরা যে হরতাল করেছি সেটিও আমরা ১৮ ডিসেম্বরের ভঙ্গিতেই করেছি। কিন্তু সেদিন পুলিশ বিনা উস্কানিতে আমাদের ওপর পেপার স্প্রে ব্যবহারসহ যেসব বর্বরতা চালিয়েছে তেমনটি ঘটার কোনো কারণ ছিল না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পেপার স্প্রে প্রয়োগের কারণ সম্পর্কে বেশ মজাদার কর্থাবার্তা বলেছেন। তাঁর মতে, এটা লাঠিচার্জের বিকল্প– লাঠিপেটা করা এক ধরনের বর্বরতা। এর বদলে তিনি পেপার স্প্রে প্রয়োগের মতো 'সুসভ্য পথ' বেছে নিযেছেন! ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম যে, দা-শাবল-বল্লম দিয়ে মানুষ হত্যা করা বর্বরতা, কিংবা, দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা 'অসভ্য পথ'– এর চেযে বরং লেথাল ইনজেকশন বা ইলেকট্রিক শক দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা 'সুসভ্য উপায়।' থ্রি নট থ্রি দিয়ে যুদ্ধ করা 'বর্বরতা'– বরং আণবিক বোমার ব্যবহারই ভালো, তাতে কীভাবে লাখ লাখ লোক মরে গেল কেউ টেরই পাবে না!

এ ধরনের চিন্তাভাবনার জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এটা এক ধরনের মানসিকতার প্রকাশ। হয়তো এটা দাবি করা হতে পারে যে, এটা 'অ্যানালগ' পদ্ধতিতে আন্দোলন দমনের বিপরীতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে উত্তরণের একটি প্রয়াস! আমি অবশ্য এটা অস্বীকার করব না যে, এ সরকার অন্য ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলেও দমন-পীড়নের অস্ত্র ও উপাদান পদ্ধতি ব্যবহারে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। এটাই দিনবদলের নমুনা কিনা জানি না। মানুষকে এ নিয়ে বেশ ভাবতে হবে। তবে আমি বলব, দিনবদল মানে আমরা দিন বদলে পেছনে যেতে চাই না- সামনে এগুতে চাই। আমরা চাই সেখানে যেতে যেখানে মানুষের দৈনন্দিনের অধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকবে, অবারিত হবে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাজনীতিতে একটি সুস্থ সংস্কৃতি থাকবে।

সাধারণত ব্যুরোক্রেসি এ ধরনের মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। মন্ত্রীরা অনেক সময় আমলাদের লেখা নোট জনসমক্ষে বলে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমলাতন্ত্রের নির্দিষ্ট কিছু শব্দ রযেছে যা দিয়ে সবকিছুকেই জাস্টিফাই করা যায়। যেমন- 'উস্কানি মোকাবেলা করতে গিয়ে', 'পুলিশ আক্রান্ত হযেছিল বলে' ইত্যাদি ধরনের।

বিষয়টি সে রকম ছিল কিনা জানি না, গত পরশুদিন জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন একটি মন্তব্য করলেন যা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এরকম একটি সন্দেহ এবং অভিযোগ ছিল যে, পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ ২০১১ সালে বিএনপির ডাকা একটি হরতালের দিন বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুককে পিটিয়েছিলেন। এমন একটি ছবিও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এখন সে কর্মকর্তাকেই রাষ্ট্রপতির পদক দেওয়া হল। এমন একজন লোককে পদক দেওয়া কি ঠিক হল, এ প্রশ্নের উত্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ সাহসের সঙ্গেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, 'এ বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল।'

এ কথার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ওই পুলিশ কর্মকর্তার অন্য ক্ষেত্রে পারদর্শিতা না থাকলেও বা পদক পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জনের ক্ষেত্রে কোথাও ঘাটতি থাকলেও, সেটি ওই হুইপ-পেটানোর মাধ্যমে পূরণ হয়ে গেছে। বিরোধী দলের হুইপকে পেটানো একটা ক্রেডিট পয়েন্ট হিসেবে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব বক্তব্যের মাধ্যমে সরকারের চিন্তা সম্পর্কেও জনগণের মনে একটা ধারণা জন্মে।

সাধারণ একটি স্পেকুলেশন হচ্ছে যে, জামায়াত-শিবির দমন করতেই বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সে ব্যাপারে তিনি কতটা পারদর্শিতা প্রকাশ করেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এরই মধ্যে জামায়াত ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তবে বামপন্থীদের ওপরই আমাদের পুলিশ পেপার স্প্রে প্রয়োগ করেছে, করেছে শহীদ মিনারে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ওপর।

আমরা সবসময়ই বলে এসেছি যে, পুলিশি অ্যাকশন দিয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রোখা যাবে না। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক অ্যাকশন। সে রাজনৈতিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর। আর ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লগের ওপরই এ দায়িত্ব বর্তায়। তারা যদি ভালোভাবে দায়িত্বটি পালন করে তাহলে তাতে দেশের উপকার হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটি কথা বলেছেন অসাধারণ শব্দচয়নের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন যে, জ্বালানির দাম বাড়ানো নিয়ে হরতাল ডাকার কোনো 'নৈতিক যুক্তিসঙ্গতা' আমাদের নেই। কোন কাজটির নৈতিক যুক্তিসঙ্গতা আছে আর কোনটির নেই সে ব্যাপারে যদি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়, তাহলে একটি দেশে গণতন্ত্র থাকে কী করে? আসলে এ বিচারের ভার জনগণের হাতে। এখন যদি কেউ একটা ডিক্রি জারি করে বলে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ আঁকড়ে থাকার কোনো নৈতিক যুক্তিসঙ্গতা উনার নেই তাহলে কি উনি পদত্যাগ করবেন? উনার যেমন যেকোনো বিষয়ে জাজমেন্ট করার অধিকার আছে, জনগণেরও রয়েছে। উনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে একশজন একশটা মত দিতেই পারেন।

আসলে এগুলো কোনোমতে গণতন্ত্র তো নয়ই, এমনকি মানুষের মতামতকে আমলে নেয়ার মানসিকতারও প্রকাশ এখানে হয়নি। এটা সেই টিপিক্যাল আমলাতান্ত্রিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।