শুভকামনা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 12 Jan 2013, 06:53 AM
Updated : 12 Jan 2013, 06:53 AM

আজ ১২ জানুয়ারী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাঝে লাল অবয়বে সম্পূর্ন ভিন্ন স্বকীয়তা নিয়ে রাজধানী থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহা সড়কের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আজকে বসবে নবীন আর প্রবীনের মেলা । বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের সাথে আজকে আমিও আবেগাপ্লুত, মনে পড়ছে ক্যাম্পাসের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। আজকের এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের জানাই শুভেচ্ছা, আর যারা এখনও ক্যাম্পাস আলো করে আছে তাদের জন্য রইলো অপার ভালোবাসা ।


আবাসিক হওয়ার কারনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটি থেকে কিছুটা আলাদা। অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে আসা মেধাবীদের মিলন মেলা। অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে। এ কারণে কেবল মেধাবীরাই এই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পায়। সুতরাং প্রতিটি নতুন বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাত্রা শুরু করে মেধাবী প্রজন্মকে নিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অপার সৌন্দর্যের মাঝে প্রতিটি শীতে সাইবেরিয়া থেকে জীবনের তাগিদে ছুটে আসে একদল অতিথি পাখি, আর দেশের আনাচ কানাচ থেকে প্রজ্ঞা আর মননের তাগিদে ছুটে আসে একদল মেধাবী তরুন তরুনী। সে এক অপূর্ব সাদৃশ্য, পাখিগুলো চলে যায় শীতের শেষে, আর শিক্ষার্থীরা পাঁচটি বছর পাঁচবার পাখিগুলোকে বিদায় দিয়ে তবে নিজেরা বিদায় নেয় । এক বুক স্বপ নিয়ে তারা আসে, আর এক পাহাড় স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে যায় । পাঁচ বছরে শানিত হয় ব্যক্তিত্ব, নিজের মেধা আর শিক্ষকের প্রজ্ঞার মিশেলে অর্জিত হয় স্বকীয়তা, নিজের চারপাশে তৈরি হয় নতুন জগত যেখানে সে একা নয়, আছে সহপাঠী, আছে বন্ধু, আছে অগ্রজ, আছে অনুজ, আর থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অমলিন স্মৃতি ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্যতম স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার ছাত্রী সমাজ। আবসিক হওয়ার কারনে এখানে ছাত্রী হলের আসন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ছাত্রীদের জন্য আলাদা ভর্তি সিট নির্ধারিত থাকে। এই বিচারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রনী ভূমিকা রেখে চলছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ঐতিহ্যগতভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যেও সমুজ্জল, কারন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো আর প্রতিবাদমূখরতার সংস্কৃতি এই বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্রীদের ব্যক্তিত্ব গঠন এবং মননের ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় নিঃসন্দেহে । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অত্যন্ত যৌক্তিক কিছু আন্দোলনের ঐতিহ্য এবং প্রায় সবগুলো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ছাত্রীহলগুলো থেকে। ছাত্রীরা এখানে সর্বদা সচেতন, বলিষ্ঠ, নির্ভীক এবং প্রতিবাদমূখর । যতবার ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর ছাত্র সংগঠন এখানে আস্তানা গাড়তে চেয়েছে, ততবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তা রুখে দাড়িয়েছে এবং ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল আন্দোলনের অগ্রভাগে। আজ সারা দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার যে দাবী উঠেছে, আমারা আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করেছিলাম '৯০ এর দশকে ।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসলেই পাঠকের মনে সর্বপ্রথমেই যে ঘটনার কথা মনে পরে, তা হচ্ছে, নব্বই দশকে ঘটে যাওয়া ধর্ষন বিরোধী আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বলে উঠার কথা। আজকে বাংলাদেশে চলমান নারী নির্যাতনের হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে ঐ আন্দোলন অত্যন্ত তাৎপর্য রাখে বৈকি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপূষ্ট ছাত্র সংগঠনের কিছু বিপথগামী ছাত্রের পৈশাচিক তান্ডবকে গুড়িয়ে দিয়েছিল ঐ আন্দোলন এবং বলা বাহুল্য ঐ আন্দোলনে ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ।

অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল বীরকন্যা প্রীতিলতা আর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে দুটি ছাত্রী হলের নামকরন করতে। শহীদ মাতাকে সম্মান দেখানোর মাধ্যমে আজকে বিশ্ববিদ্যালয় নিজেও সম্মানিত।

এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আজকে দেশে বিদেশে স্বনামে সমুজ্জল। আমাদের মুশফিকুর দেশকে নেতৃত্ব দেয়, আমাদের মোস্তাক আফ্রিকায় আলো ছড়ায়। আমাদের সেলিম আলদীন বাংলা নাটকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যে যেখানে আছে এখনও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। দেশের তেল গ্যাস লুটে নেয়ার বিদেশী বেনিয়াদের বিরূদ্ধে তাদের কন্ঠস্বর এখনও বলিষ্ঠ শিক্ষক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে। পৃথিবীর যে প্রান্তে গেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্তন কারো দেখা পাওয়া মাত্রই পেয়েছি নিবিড় ভালোবাসা । এখনও কোথাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে সফল হতে দেখলে গর্বিত হয়ে উঠি। এ এক অব্যক্ত অনুভুতি, এ এক আশ্চর্য প্রেম। এখনও আরিচা মহাসড়ক পাড় হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এসে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেই, দূরে তাকিয়ে দেখি সবুজের মাঝে কিছু স্বপ্নের হেটে বেড়ানো ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান যে পরিচিতি, শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানকে এগিয়ে নেয়া, সে উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাক এই কামনা করি। স্বপ্ন দেখি এ বিশ্ববিদ্যালয় নতুন নতুন গবেষনার মাধ্যমে জাতিকে চমকে দিবে এবং জ্ঞানের আলো ছড়াবে দেশে বিদেশ ।

বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আমাদের জ্ঞানার্জনের উপাসনালয় তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূতিকাগার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদের যে সংস্কৃতি তা যেন অমলিন থাকে চিরকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত সব প্রতিবাদ এই বার্তা দিয়ে গেছে যে, খুনি ধর্ষক চাঁদাবাজ সে যত ক্ষমতাবানই হোক না, যত বড় রাঘব বোয়ালের আশীর্বাদে পুষ্টই হোক না কেন – সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত প্রতিবাদে নিপাত যেতে বাধ্য এবং ইতিহাস তাদের নিক্ষেপ করে আস্তাকুড়ে। প্রতিবাদ কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, প্রতিবাদ অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে, সকল প্রকার ফ্যাসিস্ট আচরনের বিরুদ্ধে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কখনও খুনি, ধর্ষক, ফ্যাসিস্ট, মৌলবাদিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে পারেনি, পারবেও না, সাধারণ ছাত্র সমাজ এখানে সদা জাগ্রত, সর্বদা প্রতিবাদী।

মাসুমা বিল্লাহ্ : প্রাক্তন ছাত্রী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এন এফ পি রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিনগেন, দি নেদারল্যান্ডস্।