সাঈদীগেট এবং সংবাদমাধ্যমের বিস্ময়কর নীরবতা

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 4 Jan 2013, 08:17 AM
Updated : 4 Jan 2013, 08:17 AM

এই লেখা তৈরির আগে গণমাধ্যমে পরিচিত বেশ কজন সাংবাদিককে ফোন করেছিলাম। খুব কমন একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে: "দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নাকি একটা অডিও টেপ এসেছে বাজারে?"

"আরে, আপনি জানেন না! কেলেংকারি ঘটনা!… বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে সাঈদীর ফোনালাপের রেকর্ডিং… শুনলে হাসতে হাসতে মরে যাবেন… ইউটিউবে পাবেন… অনলাইনে সার্চ দিলেই তো লিংক মিলে… ইত্যাদি ইত্যাদি।"

কয়েকজন সহৃদয় সাংবাদিক আমাকে লিংক এমনকি অডিও ক্লিপ মেইল পর্যন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই সরল জিজ্ঞাসার একটি উদ্দেশ্য ছিল। দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর একটা টেপ বাজারে এসেছে। যেখানে বিদেশি যে কোনো যৌন কেলেংকারির লাইন বাই-লাইন আমাদের পত্রিকাগুলো ছাপায়, ট্যাবলয়েডগুলো যেখানে কোনো ধর্ষণের খবর উত্তেজক মোড়কে পরিবেশন করে, সেখানে এই নীরবতা যথেষ্ট বিস্ময় জাগায়। ফেসবুক-ব্লগ যেখানে এই বিষয় নিয়ে সোচ্চার সেখানে মূলধারার পত্রিকাগুলোর এই নীরবতা রহস্যজনকও বটে। সাংবাদিকরা জানেন কিন্তু খবরটা ছাড়ছেন না!

অথচ সাম্প্রতিক সময়েই ঠিক উল্টোটা আমরা দেখেছি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সঙ্গে একজন বিদেশি আইন উপদেষ্টার স্কাইপি আলাপনের রেকর্ডিং আমাদের পত্রিকাগুলো ফলাও করে ছাপিয়েছে। প্রতিদিন সম্পূরক খবর এসেছে যাকে আমরা ফলোআপ বলি। কিন্তু এখন এই নীরবতার মানে কী? স্কাইপিতে কারও ব্যক্তিগত কথোপকথন গোপনে সংগ্রহ করে প্রকাশ নিঃসন্দেহে ব্যক্তি গোপনীয়তার মারাত্মক লঙ্ঘন। কিন্তু পত্রিকাগুলো সে এথিকসের ধার ধারেনি। ৮ টাকার পত্রিকাও দুই টাকার পত্রিকার মানে নামতে দ্বিধা করেনি সে সংলাপের রসালো এবং হাইলাইটেড পরিবেশনায়। মোটের ওপর খবর এসেছে প্রতিটি পত্রিকাতেই।

সেই তারা কেন নীরব? কেন নীরব সরকারপক্ষের বলে চিহ্নিত হওয়া মিডিয়াগুলো?

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, স্কাইপি কেলেংকারিতে সংশ্লিষ্ট বিচারক শুধু পদত্যাগই করেননি, সেই সঙ্গে স্থগিত হয়ে আছে বহুলপ্রতীক্ষিত একটি রায়। সেই রায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের মামলার রায়। আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি যখন সোল্লাসে এই কেলেংকারি উদযাপন করছে, সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের জন্য নোবেল পুরস্কার দাবি করছে, তার মধ্যেই এই টেপ বাজারে এসেছে। কিন্তু এক যাত্রায় এই ভিন্ন ফলের মানে কী?

এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামীর যাবতীয় বাজি সাঈদীর ওপরেই। কারণ গোলাম আযম কিংবা নিজামীদের যেমন সরাসরি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে দলীয়ভাবে সেই তুলনায় সাঈদী একটু পিছিয়ে। সে যুদ্ধাপরাধ করেছে নিজের উদ্যোগে, জামায়াতের হয়ে নয়। পরে সে জামায়াতে যোগ দিয়েছে, নিজেকে তাদের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সারাদেশে জামায়াতের পক্ষে যেটুকু গণসমর্থন সেটুকু এই সাঈদীর সৌজন্যেই। তাই সাঈদীর রায় হলে জামায়াত ও ছাত্র শিবির সারাদেশে আগুন জ্বালানোর জন্য কিছু অরাজনৈতিক লোককেও সঙ্গে পাবে যারা সাঈদীর ভক্ত।

কিন্তু এই টেপ তা ভণ্ডুল করে দিতে পারে। বিভিন্ন দেশ থেকে সাঈদীকে রক্ষা করতে তার ভক্তকুল যে কোটি কোটি টাকা অনুদান হিসেবে পাঠাচ্ছে তা মুহূর্তেই থেমে যাবে। কোনো প্রমাণিত লম্পটের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে পাপের ভাগিদার হতে চাইবে কোন ঈমানদার!

অনলাইনে টেপগুলো ছাড়ার পর প্রাথমিকভাবে সাঈদী-ভক্তদের প্রতিক্রিয়া ছিল এইগুলো বানোয়াট– অভিনয় করে, সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানানো। স্কাইপি কেলেঙ্কারির সময় যেটা তাদের একবারও মনে হয়নি সেই সন্দেহটাই এবার বেশ তীব্রভাবে জানান দিয়েছে। এমনকি বাংলালিকস নামে যে সংগঠনটি এসব টেপ ভুয়া প্রমাণ করতে পারলে এক লক্ষ ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে, তাদের অনলাইন ঠিকানা এবং মেইলিং এড্রেস দিয়েছে– সেটাও আমলে নিচ্ছে না তারা। আমার ছবি দিয়ে সেখানে বাড়তি টেক্সট জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, আমি নাকি সাঈদীর অডিও টেপ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি করে বাজারে ছেড়েছি।

এইরকম একটা ঘৃণ্য ও মিথ্যে অভিযোগের মাধ্যমে আমার ও আমার পরিবারকে যে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল তার দায় কে নেবে? কাল বা পরশু আমাকে হত্যা করা হলে, তারপর ধামাচাপা পড়ে যাবে এই কেলেংকারি? আমি মিথ্যা অভিযোগে বলির পাঠা হয়ে আমৃত্য এক কলংক বয়ে বেড়াব। আমি প্রয়োজনে আদালতে যাব এই অন্যায় অভিযোগের প্রতিকার খুঁজতে, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

কিন্তু তার আগে জানতে হবে সংবাদমাধ্যমের এই নীরবতার উৎস কী। কোন অদৃশ্য হাতজোড়া তাদের মুখচাপা দিয়ে রেখেছে? ট্রাইব্যুনালে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে তার মধ্যে অভিযুক্তদের একটা বড় অংশ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এদের অর্ধেকেরও বেশি সাংবাদিক ছিলেন। তাদের পরিচিতি দিয়ে ঢাকা প্রেস ক্লাবের বাইরে একটা বড়সড় স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। আফসোস, এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাতেও ছিলেন একজন সাংবাদিক।

বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিকরা সেই নিহতদের বিচারের চেয়ে মনে হয় অভিযুক্তকে রেহাই দিতে বেশি মরিয়া। তাদের আচরণ সেই নির্দেশনাই দিচ্ছে। তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। টেপটি সত্য কিংবা ভুয়া এই বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়ে তাদের অন্তত এর প্রকাশের খবরটি অন্তত জানানো উচিত জনগণকে।

আমার অবিচুয়ারির জন্য অপেক্ষা করাটা উচিত হবে না।