যুদ্ধাপরাধের বিচার ও স্মৃতিতে একাত্তর

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী
Published : 20 Dec 2012, 07:22 PM
Updated : 20 Dec 2012, 07:22 PM

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তো বাঙালিরা বুঝে গেল তারা প্রতারিত হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ভিন্ন ধরনের ভিন্ন চেহারার শাসকদের দ্বারা বাঙালিকে আবার সেই একই শোষণ ও দমনের চক্রে বেঁধে ফেলল। বাঙালি বুঝল, প্রভু বদল হয়েছে মাত্র, তাদের অবস্থার বদল নয়। তাই প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানের জন্মের এক বছরের মধ্যেই। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের বীজ পোঁতা হয়ে গেল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে পাকিস্তানের তখনকার জাতীয় নেতা বা জাতির জনক হিসেবে অভিহিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের বক্তব্য 'উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। আর প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন এদেশের ছাত্র-জনতা।

এরপরের আড়াই দশক পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের নানাভাবে নিপীড়িত হওয়ার করুণ গল্প। সে গল্পের পথ ধরেই না আমাদের স্বাধীনতালাভের অনিবার্যতা, একটি যুদ্ধের মাধ্যমে অনেক অর্জনের স্বত:স্ফুর্ততা।

একাত্তরের প্রতিটি দিনের স্মৃতিই যেন আমার কাছে এই সেদিনের মতো। বাঙালি তখন কী বিপুল আবেগে অপেক্ষা করছে স্বাধীনতার জন্য। আশা ছিল আলোচনার মাধ্যমেই পাকিস্তানের বাঙালি-অধ্যুষিত অংশটি আলাদা একটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবে। যেভাবে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান।সে লক্ষ্যেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা চলছিল। আলোচনা যখন ভেস্তে গেল তখন সাধারণ মানুষই বুঝে গেলেন একটি যুদ্ধ অনিবার্য।

বাঙালি জাতি কিন্তু এই যুদ্ধের ব্যাপারে মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। তাই ৩ মার্চেই ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুর হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চের সেই অতর্কিত হামলার বিষয়টি ছিল আমাদের অজানা। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার হামলার পরকল্পনা করেছিল।তারা ওই রাত থেকে শুরু করে সারা বাংলায় যে বিরাট পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছিল- যে হত্যাযজ্ঞে পাক হানাদার বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিল এদেশেরই রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী, এটা তো ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা।

এটুকু ইতিহাস বাঙালি জানেন। নতুন করে বলার কিছু নেই। তবু আজ বারবার ভাবতে হয়, বলতেও হয় যখন যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্তদের পক্ষে কাউকে কাউকে সাফাই গাইতে দেখি। যখন শুনি এদেশের জনগণের ওপর যে ব্যাপক ও পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার জন্য দায়ী জামায়াত ইসলামীর নেতারা দায়ী নন। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর যে ঘৃণ্য তৎপরতা আমাকে নিজের চোখে দেখতে হযেছে, যাদের বর্বর সহযোগিতায় আমার স্বামী আলীম চৌধুরী নিহত হয়েছেন- আজ ক্ষোভের সঙ্গে দেখতে হয়, শুনতে হয় তারা নাকি কোনো অন্যায়ই করেনি! তারা সুফি, ধর্মপ্রাণ মুসলমান! তাদের অহেতুক বিচারের মুখোমুখি করে হয়রান করা হচ্ছে। আমার মতো শহীদ পরিবারগুলোর পক্ষে এ ধরনের কথা শোনা যে কত কষ্টের তা বলে বা লিখে বোঝানো মুশকিল।

পঁচিশে মার্চের কালরাত ও তার পরের ন'মাসের কিছু স্মৃতি এখানে তুলে ধরছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় অনেকেই ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। আমরা যাইনি নানা কারণে। আমরা তখন থাকতাম পুরানা পল্টনে। বাবা ছিলেন অসুস্থ। পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্থ। তাই তাঁকে নিয়ে ওই মুহুর্তে ঢাকার বাইরে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল। তাছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওই রাতে তিনি তাঁর বাসা ছেড়ে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁকে রক্ষা করা তখন আমাদের একটি দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে দেখলাম, ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছেন। মুখটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। দেশ একটি বড় বিপর্যয়ৈর মুখে, এ ভাবনা তাঁকে আলোড়িত করছিল।

আমরা দেখলাম, আমাদের বাসায়ও তিনি নিরাপদ নন। কারণ তাঁর আত্মীয়ের বাসা বলে তাঁকে খুঁজতে পাকবাহিনী এখানে চলে আসতে পারে। তাই তাঁকে নিরাপদে সরিয়ে ভারতে পাঠানোর পরিকল্পনা হল। আমার মা আর শাশুড়ি তখন তাঁকে বোরকা-শাড়ি পেরিয়ে, মাথায় খোঁপা বেঁধে দিয়ে, পায়ে মেয়েদের জুতো পরিয়ে দিলেন। পরে আমার ভাই তাঁকে রিকশায় করে অলি-গলি ঘুরে ঘুরে হোসেনী দালানে পৌঁছে দিলেন। ওখান থেকে তিনি পরে চলে গেলেন ভারতে।

এ ঘটনার পরও আমরা পুরো ন'মাসই ওই বাসায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। আমার স্বামী ডা. আলীম চৌধুরী তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই এ বাসায় এবং চেম্বারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার সুযোগ করে দিতেন। তাই সবাই এ বাসার কথা জানত। পঁচিশে মার্চ রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি অনেককে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসেছেন।

তাই পরের মাসগুলোতে আমাদের ঠিকানা ছিল অনেকের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। বিপদ দেখলে আলীম কখনও কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে শুইয়ে রেখে দিতেন রোগী বানিয়ে। টাকা-পয়সা তো সবই দিয়ে দিয়েছি। তখন বেশিরভাগ দেশপ্রেমিক বাঙালিই তাই করতেন। শুধু নিজেদের চলার টাকাটা রেখে বাকিটা যুদ্ধের জন্য বিলিয়ে দিতেন।

আমাদের বাসায় এভাবে লুকিযে আশ্রয়-প্রশ্রেয় পেতেন বলেই কিনা কে জানে, জুলাইয়ের এক বৃষ্টির দিনে বাসায় এসে হাজির হল একজন। তার নাম মওলানা মান্নান, সেই ইনকিলাবের মান্নান। সে ছিল আশ্রয়প্রার্থী। বলল, পাকিস্তানিরা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, ছেলেমেযে নিয়ে কোথায় যাবে, চার-পাঁচ দিন থাকতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আলীম রাজি হয়ে গিযেছিলেন। কিন্তু আমার একদম প্রথম দেখাতেই লোকটাকে ভালো লাগেনি। তাই বেঁকে বসলাম, না, এর জায়গা হবে না। তিনি খুব অবাক হলেন। কারণ কত মানুষকে আমরা এ বিপদে সাহায্য করেছি, আর মান্নানের বেলায় আপত্তি কেন? তিনি বুঝতে পারছিলেন না। পরে আমার শাশুড়ি যখন আমাকে এসে এ কথাটা বললেন, তাঁর মুখের ওপর আর 'না' বলতে পারলাম না। কিছু করতে না পেরে অঝোরে কাঁদলাম। মনে হচ্ছিল কী যেন একটা সর্বনাশ হযে গেল আমার। মানুষের বোধহয় সিক্সথ সেন্স থাকে!

মান্নান তো ওই ক'টা দিন থাকল না, পরে আমাদের নিচতলাটা ভাড়া নিয়ে নিল। ক'দিন পর জানাল, সে আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক।আমাদের সদর দরজা পাহারা দিতে শুরু করল পাকিস্তানি আর্মির সহযোগী ওই বাহিনীর সদস্যরা। পরনে আলবদরদের পোশাক। ছাই রঙের প্যান্ট আর নীল শার্ট। হাতে অস্ত্র। আলীম খুব বিরক্ত হতেন। আর মান্নান বলত, 'আপনার বাসায় আছি বলে মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে মারবে না, তাই আলবদররাও এ বাড়ি পাহারা দেয়।' পরে বুঝেছিলাম, আলীমের আশ্রয়ে থেকে সে আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে বেঁচে গিযেছিল।

এরপর কয়েক মাস এভাবে কেটে গেল। আলীমকে মাঝে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হল। উনি কিছুদিন ওখানে থেকে পরে আবার পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে বদলি হয়ে মিটফোর্ডে চলে এলেন। কারণ আমি তখন দুই শিশুকন্যা নিয়ে অসহায়। বাবা বিছানায়। এ অবস্থায় উনি তো দূরে থাকতে পারেন না। আলীমকে বদলি করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জন্যই। আলীম অনেককে সাহায্য করছেন এ খবর প্রশাসনের কাছে নিশ্চয়ই ছিল।

তিনি ফিরে এলেন ৩ নভেম্বর। ডিসেম্বরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। ভারতীয় মিগ আকাশজুড়ে চক্কর দিচ্ছে, বোমা ফেলছে দেখে আলীম বলতেন, 'পাকিস্তানিরা বোকার স্বর্গে বাস করছে। ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র বুঝি সপ্তম নৌবহর নিয়ে এসে ওদের যুদ্ধে জিতিয়ে দেবে। এটা হবে না। শিগগির আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি।'

এরপর এল ১৫ ডিসেম্বর। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আলবদরদের একটি গাড়ি এসে থামলিআমাদের বাড়ির সামনে। এরকম রোজই আসে। আমরা আলাদা করে কিছু ভাবিনি। আমরা দুজন বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। ওরা আলীমকে নিয়ে যেতে চাইল, এক কাপড়ে, শীতবস্ত্র ছাড়া। আলীম তখন নিচে মান্নানের বাসার দরজায় আঘাত করতে লাগলেন। মান্নান সবসময় বলত, 'আমি আছি তো, আলবদররা আপনাকে কিছু বলবে না।' অথচ তখন আলীমের এত ধাক্কাধাক্কির পরও দরজা খুললই না। বরং ভেতর থেকে বলে দিল, 'আপনি যান, কোনো ভয় নেই।'

আলীমকে ওরা নিযে চলে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম তার বাসায়। আমাকেও বারবার আশ্বাস দিয়ে রাখল সে। নির্ঘুম, দুশ্চিন্তায় ঘেরা একটি রাত কাটানোর পর এল ১৬ ডিসেম্বর। সকালে দেখলাম ঢাকা জুড়ে এক উৎসবের আমেজ। মানুষ জাতীয় পতাকা নিয়ে চলাফেরা করছে। বুঝলাম আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। কিন্তু আলীম কোথায়? আমি পথে পথে ঘুরে তাকে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। মান্নান পালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বাসায় এলেন। বললেন, কোথায় সে মান্নান যে আলীমকে খুন করেছে!

আমি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি আলীম নেই। এক পরিকল্পিত ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনি। এরপর তো তাঁর লাশই পেলাম।

মওলানা মান্নান ধরা পড়েছিল। আবার ছাড়াও পেয়েছে। আসলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই। তাই বুঝি পরে একটা প্রজন্মকে আমরা কোনো ইতিহাস জানতে না দিয়ে বড় করে তুললাম। এ প্রজন্ম ঠিকঠাক ইতিহাস জানতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কথা শোনেনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা বোঝে না। একচল্লিশ বছরেও রাজাকারদের বিচার হয়নি বলে ওরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে। জিয়া, এরশাদ আর খালেদা জিয়ার সরকার ওদের পুনর্বাসন করেছেন।

এখন বিচার ওদের হতেই হবে। নইলে আমরা জাতি হিসেবে অস্তিত্বের সংকটে পড়ব। এই যে হ্যাকিং করছে ওরা, বিচার বানচালের চেষ্টা করছে, কোটি কোটি টাকা দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে বিচার ভিন্নখাতে নিতে চাচ্ছে- এসব চলতে দেওয়া যাবে না। সব ষড়যন্ত্র দূর করে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারব বলেই আমি আশাবাদী।


শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী
: লেখক, শিক্ষাবিদ।