স্বাধীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 19 Dec 2012, 08:47 AM
Updated : 19 Dec 2012, 08:47 AM

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমকে 'চতুর্থ স্তম্ভ' বলে মনে করা হয়। তাই নানা সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা কম হয় না। গণমাধ্যম কি শুধু সংবাদ পরিবেশন করবে নাকি জনমতও গঠন করবে এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। ফলে দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই থাকে।

আমাদের দেশের মিডিয়ার পথচলা মুলত ব্রিটিশ পিরিয়ডেই। তখন থেকেই আমাদের সংবাদপত্রগুলো পাশাপাশি দুটো ভূমিকা পালন করে এসেছে। একটি হল সংবাদ পরিবেশন, দ্বিতীয়টি হল জনমত গঠন। তার মানে, গণমাধ্যম একইসঙ্গে জনগণের মধ্যে চেতনা তৈরি করেছে এবং জনগণের ভাবনাগুলো তুলে ধরেছে। ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের মিডিয়া এসব ভূমিকা পালন করে এসেছে।

এদেশে সংবাদপত্রের পথচলা শুরু ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের হাত ধরে। এই ভূখণ্ডে প্রথম যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, এর নাম ছিল 'সমাচার দর্পণ।' সেটা ১৮১৮ সালের কথা। তবে এ পত্রিকা প্রকাশের পেছনের উদ্দেশ্যটা ছিল ভিন্ন। প্রথমত খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে প্রচার চালাতে এটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

প্রথম যিনি সমাজের মানুষের মধ্যে মতামত গঠনের চিন্তা থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন তিনি সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়। তাঁর দুটো পত্রিকা ছিল। একটি হল 'মিরাতুল আখবার।' এটি ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা। এর অর্থ হল 'মিরর অব দ্য নিউজ' বা খবরের দর্পণ। ১৮২২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

তাঁর আরেকটি পত্রিকার নাম ছিল 'সংবাদ কৌমুদী।' এটি প্রকাশিত হত বাংলাতেই। প্রকাশকাল ১৮২১ সাল। পত্রিকাটি বিরাট সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে। তদানীন্তন হিন্দু সমাজের কুসংস্কারগুলো দূর করার জন্যই তিনি পত্রিকাটি বের করতেন। সংস্কারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলায় 'সংবাদ কৌমুদী' বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

রাজা রামমোহন রায় মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই পত্রিকা দুটো বের করেছেন। ফার্সি পত্রিকাটি বেশ ক'বছর চলেছে। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতবর্ষের ওপর তখন নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। এরই অংশ হিসেবে পত্রিকার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হল। তখন দৃঢ়চেতা রামমোহন রায় 'সংবাদ কৌমুদী' পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন।

সংবাদপত্রের ইতিহাসের পরবর্তী যুগও নানা ঘটনায় টালমাটাল ছিল। উনিশ শতকের শুরুতে রাজা রামমোহনের ওই প্রয়াসের পর আরও কিছু পত্রিকা বের হয়েছে। সেগুলোর উদ্দেশ্যও ছিল জনমত গঠন ও জনমতের প্রতিফলন। কারণ সময়টা ছিল খুব জটিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে নীল বিদ্রোহ হল। তখনও ব্রিটিশ সরকার অনুভব করল যে কিছু তথ্য জনগণের কাছ থেকে লুকোতে হবে। ফলে প্রেসের ওপর বিধিনিষেধ জারির প্রক্রিয়া শুরু হল। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে সিপাহী বিপ্লব ( সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত) হলে ব্রিটিশ সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৮৫৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার এক আদেশবলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ সরকার নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এরপর থেকে ভারতের রাজনীতিতে আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ব্রিটেনে প্রধানত দু'ধারার সরকার ক্ষমতায় থাকে। একটি রক্ষণশীল ধারার, অন্যটি উদারপন্থী। এখন যাদের লেবার পার্টি বলা হয়, তারা উনিশ শতকে ছিল লিবারেল। ওদিকে এখনকার টোরিদের তখনকার নাম ছিল হুইগ। লিবারেলরা ব্রিটেনের ক্ষমতায় থাকলে সংবাদপত্র তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। অন্যদিকে হুইগরা সবসময় চাইত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে। এর ফলে ভারতে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হত, সেগুলোও নানাভাবে ব্রিটিশ আইনের দ্বারা প্রভাবিত হত।

১৮২৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন জন অ্যাডাম। তখন প্রেসের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে রাজা রামমোহন রায় 'সংবাদ কৌমুদী' বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আবার ১৮৩৫ সালে লিবারেল সরকারের নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের সময় প্রেস অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকে। তখন পর্যন্ত ভারতবর্ষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, ব্রিটেনে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখানে গভর্নর জেনারেল বদল হতেন। ফলে প্রশাসনেও পরিবর্তন দেখা যেত।

১৮৭৮ সালে টোরিরা ক্ষমতায় এলে ভাইসরয় লর্ড রিটন ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট করলেন। এর অধীনে ভারতীয় যেকোনো ভাষায় কিছু ছাপা হলে তা সরকারের নিযুক্ত লোকদের দেখাতে হত। তবে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই বা পত্রিকার ব্যাপারে এ নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

এ সময় একটি মজার ঘটনা ঘটল। আসলে এটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে বাংলার সংবাদপত্রসেবীদের দৃঢ়চিত্ততার উদাহরণ। তখন 'অমৃতবাজার' পত্রিকা বের হত বাংলায়। এটি বের করতেন শিশির ঘোষ। নতুন অ্যাক্ট পাশের পর পত্রিকাটি ইংরেজিতে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। এরপর থেকে বাংলা নামের পত্রিকাটি ইংরেজিতেই প্রকাশিত হতে থাকল। পত্রিকার সংবাদকর্মীদের এই দৃঢ়চিত্ততার স্বীকৃতি হিসেবেই বোধধহয় যশোরে একসময় একটি রেলস্টেশনের নাম ছিল 'অমৃতবাজার পত্রিকা।'

উনিশ শতক এরকম নানা ঝড়ঝাপটায় উত্তাল হলেও, বিশ শতকে ভারতে সংবাদপত্র শিল্প মোটামুটি স্বাধীনতা ভোগ করেছে।

তবে ইতিহাসের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে গভীর অনুসন্ধান থেকে আমার মনে হয়েছে যে, ব্রিটিশ সরকারগুলো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে খুব বেশি স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করত না। সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদির মতো গণতান্ত্রিক টুলগুলো ভারতে তারাই আমাদের দিয়েছে। ওরা ওদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। ভারতের স্বায়ত্তশাসন ছিল ব্রিটেনেরই অবদান। আমি লক্ষ্য করেছি, ফরাসী সরকারগুলো তাদের উপনিবেশকে অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করেছে। ব্রিটেন এটা না করায় দেখা গেছে, ভারত দুশো বছর ব্রিটিশের দ্বারা শাসিত হলেও, নানা সময় ওদের সঙ্গে ভারতের নেতারা আলোচনায় বসেছেন, নিজেদের দাবিগুলো আদায় করেছেন। এভাবে নেগোশিয়েসনের মাধ্যমে ভারত একসময় স্বাধীনতাও লাভ করেছে।

আমাদের দেশে আগে পত্রিকা বের হওয়ার পেছনে সামাজিক স্বার্থের বিষয়টি বেশি কাজ করত। এর বড় উদাহরণ 'সংবাদ' নামের পত্রিকাটি। এখন বড় বড় ব্যবসায়ীরা পত্রিকা বের করছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এদেশে এ ধারা শুরু হয়। তবে ব্যবসায়ীদের মালিকানায় সবচেয়ে বেশি পত্রিকা বের হওয়া শুরু হয়েছে বাংলাদেশের গত দেড়-দুশতকে।

আমাদের দেশে কিছু আলোচিত ব্যবসায়ী আছেন যারা গণমাধ্যমের মালিক হচ্ছেন। তাদের অনেককে নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে মালিকপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছেন। নিজেদের স্বার্থে সংবাদ তৈরি ও পরিবেশনে সাংবাদিকদের বাধ্য করছেন। তবে বিপরীত চিত্রও আছে। কিছু কিছু গণমাধ্যমের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে থাকলেও তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন না বা তাদের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশনের মতো ঘৃণ্য কাজ করতে সাংবাদিকদের বাধ্য করছেন না। এটি গণমাধ্যমের জন্য সুখবর।

জামায়াত-সমর্থিত কিছু গণমাধ্যমও এদেশে রয়েছে। এটা আছে কারণ এখানে মূলত দুটো শক্তি প্রাধান্যশীল। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। মিডিয়াও এর ফলে কখনও কখনও দুটো শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।

আমি মনে করব, এ যুগে মিডিয়া একইভাবে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি জনমত গঠন করে যাচ্ছে। তবে এখন এর দায়িত্ব আরও অনেক বেশি। দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন থেকে মিডিয়াকে বিরত থাকতে হবে। এটা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে আদায় করা ঠিক হবে না, মিডিয়াকেই বুঝতে হবে তার দায়িত্ব। মিডিয়ার এখন আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। অসংকোচে সত্য প্রকাশ করতে হবে, করার সাহস রাখতে হবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলব, এখন আমাদের দেশে গণমাধ্যম খুবই শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ স্বাধীন। এদেশে নানা সময়ে সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। তখন সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরার চেষ্টা করা হত। সেদিক থেকে আমরা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সময় পার করছি। ফলে এখন গণমাধ্যম নানা ইস্যুতে জনমত গঠন করছে, জনগণকে সচেতন করছে। এই যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আমাদের মিডিয়ার একটি শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের ধরন-ধারন ও ব্যাপকতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বলে এখন সাধারণ মানুষও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।

আমাদের গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক ধারায় নতুনত্ব নিয়ে এসেছে সব ধরনের ইলেকট্রনিক মিডিয়া (টেলিভিশন ও রেডিও)। আরও হাল সংযোজন অনলাইন সংবাদপত্র। মিডিয়ার এ ব্যাপক বিস্তৃতির চিত্রটি দেখে আমার ভালো লাগে। তাই বলব, সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার দাবি করার পাশাপাশি সমাজও তাদের কিছু দাবি পূরণ করবে। সবচেয়ে প্রথম যে দাবি রয়েছে তা হল পেশাগত জীবনে সাংবাদিকের নিরাপত্তা।

আমাদের গণমাধ্যমের এখন সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। খুলনার মানিক সাহা হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিকের সাগর-রুনি হত্যা পর্যন্ত দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনাটি তদন্তাধীন। আমি আশা করব, এ হত্যার সঠিক বিচার হবে। গণমাধ্যমকর্মীরা সবসময়ই একটা হুমকির মুখে থাকেন। তাদের নিরাপত্তা বা আলোচিত খুনের ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করা সরকারের দায়িত্ব। অথচ এদেশে এ পর্যন্ত যতজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন তাদের কারও খুনেরই বিচার হয়নি। যারা খুন হয়েছেন তারা নিশ্চয়ই কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে কোনোভাবে আঘাত করেছেন। আর এজন্যই তাদের খুনের বিচার হওয়া খুব জরুরি।

অন্তত একটি উদাহরণ তৈরি হোক। তা না হলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যকর্মীদের মনে নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করা যাবে না। সেক্ষেত্রে সত্যপ্রকাশে অসংকোচ সাহস তারা কীভাবে পাবেন?

সালাহউদ্দিন আহমেদ : জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ।