মিসরের রাজনৈতিক সংকট: চার ব্যাখ্যা

Published : 3 Dec 2012, 02:01 PM
Updated : 3 Dec 2012, 02:01 PM

মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোরসির ২২ নভেম্বর জারি করা ডিক্রির ফলে। এর আওতায় প্রেসিডেন্ট অনেক বিষয়ে একক ক্ষমতার অধিকার লাভ করেছেন। এটা তাকে আদালতে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে স্থাপন করেছে। ডিক্রিতে বলা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্টের নেয়া সিদ্ধান্ত ও দেশের সংবিধান-পরিষদের ব্যাপারে সাংবিধানিক আদালত কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না এবং প্রেসিডেন্ট ও পরিষদের সদস্যরা দায়মুক্তি ভোগ করবেন। প্রেসিডেন্টের এসব ক্ষমতা 'সাময়িক' বলে প্রেসিডেন্ট এবং ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তবে সেটা যে অধিকাংশ মিসরীয়কে সন্তষ্ট করতে পারেনি তা চলমান ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট।

দেশের সাংবিধানিক আদালত সংবিধান-পরিষদ এবং দেশের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বাতিল করে দিতে পারে এমন আশংকার মুখে প্রেসিডেন্ট এ ডিক্রি জারি করেন। তাতে সংবিধান-পরিষদকে বরাদ্দ করা সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন পরিষদ খুব তাড়াহুড়ো করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংবিধানের একটি খসড়া তৈরি করে প্রেসিডেন্ট মোরসির হাতে তুলে দেন।

ক্ষমতা থেকে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের অপসারণের সময় গণতন্ত্রায়নের যে রোডম্যাপ সবাই মিলে তৈরি করেছিলেন, সে-অনুযায়ী খসড়া সংবিধানের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানের কথা। প্রেসিডেন্ট মোরসি ১৫ ডিসেম্বর গণভোট অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণাও করেছেন। কিন্ত ইতোমধ্যে দেশের সব বিচারক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকছেন। সাংবিধানিক আদালত তাঁদের নির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হতে পারেনি সরকার সমর্থকদের চাপের কারণে। আগামী কয়েক দিনে তাঁরা কোনো অধিবেশন করতে পারবেন কিনা বা পারলেও তা ক্ষমতাসীনরা গ্রহণ করবেন কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। মিসরের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট যে কতটা অভূতপূর্ব তা বোঝার জন্য রাজপথের উত্তেজনার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করছি। আদালত ও বিচারকরা এর আগে সর্বশেষ এ ধরনের কর্মবিরতি পালন করেন ১৯১৯ সালে যখন দেশটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চলছিল।

সংকটের সূচনা প্রেসিডেন্ট মোরসির ক্ষমতা-সম্প্রসারণের সিদ্ধান্তের কারণে হলেও, এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা যে একেবারেই ছিল না তা নয়। সংবিধান তৈরির জন্য যে একশ' সদস্যের সংবিধান-পরিষদ গঠন করা হয় তার ভেতরে যেসব ঘটনা চলছিল আশঙ্কাটা সেখান থেকেই এসেছিল। গত মাসগুলোতে সংবিধান-পরিষদ থেকে একে-একে সব কপ্টিক খৃষ্টান এবং উদারপন্থী (বা সেক্যুলার) সদস্য পদত্যাগ করেছেন। গোড়াতেই এ পরিষদে ইসলামপন্থীদের আধিপত্য ছিল। শেষ পর্যন্ত এ পরিষদ হয়ে পড়ে ইসলামপন্থীদের নিজস্ব সভা!

শেষ অধিবেশনে যখন সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয় তখন উপস্থিত ছিলেন ৮৫ সদস্য– সবাই মুসলিম ব্রাদারহুড বা তার সহযোগী দলের সদস্য; যে চার নারী সদস্য ছিলেন তাঁরাও সবাই ব্রাদারহুডেরই সদস্য। খ্রিষ্টান এবং উদারপন্থী (বা সেক্যুলার)-দের ক্রমাগত পদত্যাগের কারণ ছিল পরিষদে ইসলামপন্থীদের অসহিষ্ণু আচরণ। দেশের সেক্যুলার ও খ্রিষ্টান গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগের মুখে মোবারক-আমলে নিয়োগ করা সাংবিধানিক আদালত যে এ পরিষদ বাতিল করে দেবেন– ব্রাদারহুডের নেতৃবৃন্দের এ আশংকা একবারে অমূলক ছিল না।

অতীতে দেশের নিম্ন-পরিষদ বাতিলের উদাহরণ তাঁদের সামনেই ছিল। অন্যদিকে মোবারক-বিরোধী সেক্যুলার-গণতন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল যে, এ পরিষদ এখন আর মিসরের বিপ্লবের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাঁরা যে সংবিধান তৈরি করবেন তা বিপ্লবের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। প্রায় একদলীয় এ পরিষদের বিরুদ্ধে তাঁদের পথ ছিল একটাই- আর তা হল এটা বাতিল করে নতুন পরিষদ গঠন করে তার মাধ্যমে সংবিধান তৈরি করা।

প্রেসিডেন্ট মোরসি একটু আগেই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। তা করতে গিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা এতটাই বাড়িয়ে ফেলেছিলেন যে বিরোধীরা যথার্থভাবেই তাকে সাবেল স্বৈরশাসকদের চেয়ে 'বেশি-ক্ষমতাবান' বলে বর্ণনা করছেন। এতদিন ধরে তার বহুধা-বিভক্ত বিরোধীরা– যাদের অধিকাংশই হলেন সেক্যুলার-রাজনীতিবিদ– তাঁরা এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। ফলে এখন মোরসি কেবল যে আদালতের বিরাগভাজন হয়েছেন তা নয়; রাজপথে সাধারণ মানুষের প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। ক্ষোভ প্রশমনের জন্য সংবিধানের গণভোট ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। এ বর্ণনা থেকে সংকটের কারণের ইঙ্গিত পেলেও সংকটের কোনো ব্যাখ্যা পাই না। এ সংকটে বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কার কী ভূমিকা তা আমরা বুঝতে পারি না।

তবু চলমান সংকটকে চারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম ব্যাখ্যা হল, এটা হচ্ছে সোজা-সাপ্টা ক্ষমতার লড়াই। এ লড়াই দেশের চারটি শক্তির মধ্যে – ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী (মোরসি ও ব্রাদারহুড); নির্বাচনে পরাজিত সেক্যুলার দলগুলো (আল বারাদাই ও অন্যরা); সাবেক মোবারক সরকারের অবশিষ্টাংশ (আদালত) এবং সেনাবাহিনী (যারা পেছন থেকে সুতো টানছে কিংবা সময়ের অপেক্ষায় বসে আছে)। এরা প্রত্যেকেই চায় নিজ-নিজ পক্ষের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে। এ লড়াইয়ে যার হাতে যে অস্ত্র আছে সে তাই ব্যবহার করছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি শক্তি অন্যের ওপর আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারছে, কিংবা শক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের মেরুকরণের মধ্য দিয়ে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে– ততক্ষণ পর্যন্ত সংকট কাটানো যাবে না।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হল যে এটি হচ্ছে গণতন্ত্রায়নের পথে সাবেক ক্ষমতাসীনদের অবশিষ্টাংশের শেষ লড়াই। মোরসি এবং ব্রাদারহুড লড়ছেন যাতে করে গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ পায়। সেখানে আদালত চেষ্টা করছে গোটা প্রক্রিয়া ভন্ডুল করে দিতে। আদালত যদি সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ করে দিতে পারে তবে তাঁদের ক্ষমতাই কেবল টিকে থাকবে তা নয়- এটাও প্রমাণিত হবে যে মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিন এবং ইসলামপন্থীরা হচ্ছে এতে সবচেয়ে বড় বাধা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই সংকটের সমাধান না হলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আদালতের জন্য সম্ভবত সেটি মুসলিম ব্রাদারহুডের শাসনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।

এ ব্যাখ্যার আলোকে কেউ-কেউ বলছেন যে, রাজপথে যে মানুষরা বিক্ষোভ করছেন তাঁদের মোরসির সঙ্গেই থাকার কথা। লক্ষ্যের দিক থেকে মোরসি ও ব্রাদারহুডের সঙ্গে তাঁদের কোনো পার্থক্য নেই। যে পার্থক্য তা হল প্রক্রিয়াগত – মোরসি যেভাবে ক্ষমতার পরিসর বাড়িয়েছেন তা বিক্ষোভকারীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ফলে মোরসি যদি তার ডিক্রির পরিসর কমিয়ে আনেন এবং ব্রাদারহুড যদি তাঁদের আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারে তবে এ পরিস্থিতির অবসান সম্ভব। গণভোট সামনে রেখে দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়লে সরকার-বিরোধীরা চাইবেন না যে গণভোট ব্যর্থ হোক। ফলে তাঁরা শেষপর্যন্ত খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না।

তৃতীয় ব্যাখ্যা হল, এটা ইসলামপন্থীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রমাণ। মিসর ইরানের পথে অগ্রসরমান বলেই এ ব্যাখ্যার প্রবক্তারা বলতে চান। একবার ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এলে তাঁরা নির্বাচনী ও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে তাঁদের অনুকূলে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে এরপর নির্বাচন হল কিনা তাতে কিছুই যায় আসে না। 'নির্বাচন, কিন্ত একবার মাত্র' – ইসলামপন্থীরা এ আদর্শে বিশ্বাস করে বলে যারা এতদিন ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তি হাজির করছিলেন তাঁরা এ পরিস্থিতিকে প্রমাণ হিসেবে তুলে করছেন। তাঁদের দেওয়া সমাধান কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়: যেকোনো মূল্যে তারা ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডকে ঠেকানোর পরামর্শ দেবেন; কেননা অতীতে তাঁরা সেই পরামর্শই দিয়েছেন- পরিণতি ভালো হোক কী মন্দ।

চতুর্থ ব্যাখ্যাটি হল যে, এটি হল আদর্শিক লড়াই – ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেক্যুলারপন্থীদের লড়াই। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে সেক্যুলারপন্থীরা প্রকৃতপক্ষে ইসলামপন্থীদের চেয়ে ভালো করেছিল, কিন্ত বিভক্তির কারণে তাঁরা ফলাফলকে ইতিবাচক রূপ দিতে পারেনি। বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক এবং ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মোরসির মধ্যে যখন বেছে নিতে হয়েছে, তখন তাঁরা সাবেক শাসকের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াকেই বিবেচকের কাজ মনে করেছে।

কিন্ত নির্বাচনের পর থেকেই তাঁরা রাজনীতিতে শক্তি-প্রদর্শনের সুযোগ খুঁজছিল। মোরসির ডিক্রি তাঁদের সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাছাড়া খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন ধারা নারী অধিকার, মানবাধিকার এবং সেক্যুলার চিন্তাধারার জন্য বিপদজ্জনক বলে তাঁরা এখন রাজপথে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন। তাঁদের লড়াইয়ে আদালতের ভূমিকা এবং সেনাবাহিনীর মৌন অবস্থান থেকে কারো কারো ধারণা যে, এ প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে একধরনের আদর্শিক মিল রয়েছে। কোনো-না-কোনো পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা গড়ে উঠতেও পারে। সেটা গড়ে না উঠলেও তাঁদের রাজনৈতিক এবং আদর্শিক অবস্থান থেকেই তাঁরা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবেন। এর অর্থ হল, সাময়িকভাবে এক ধরনের সমাধান হলেও খুব শিগগিরই সংকটের সুরাহা হবে না।

এ সবের যেকোনো একটি ব্যাখ্যাই সম্পূর্ণভাবে সঠিক এমন কথা কেউই হলফ করে বলতে পারবেন না। কিন্ত চারটি ব্যাখ্যার বিভিন্ন উপাদান আমাদের মনোযোগ দাবি করে। সংকটের ফলে আগামী দিনগুলোতে মিসরের রাজনীতি কোনদিকে অগ্রসর হবে তা বোঝার ক্ষেত্রেও এ ব্যাখ্যাগুলো সাহায্য করবে বলে মনে হয়।

ইলিনয়, ৩ ডিসেম্বর ২০১২

আলী রীয়াজ : আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।