ওঁরা মরেন-আমরা শোক দিবস পালন করি-কিন্তু কতবার?

এম এম আকাশ
Published : 5 Sept 2015, 02:44 PM
Updated : 29 Nov 2012, 04:24 AM

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরিন গার্মেন্টসের দুর্ঘটনা আমাদের গার্মেন্টসের ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ড। এর আগে ১৯৯০-২০১০ এই বিশ বছরে ২১২ বার এধরনের ঘটনা ঘটেছে, তাতে ২৭৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনা এর আগে ঘটেনি। এত বেশি প্রাণহানি(১১২ জন) দেখার দুর্ভাগ্যও আমাদের হয়নি। বারে বারে যখন একই ধরনের "দুর্ঘটনা" ঘটে তখন সেটা আর ব্যতিক্রমী বিষয় থাকে না। আমাদের তাই খতিয়ে দেখতে হবে কেন এধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে ?

দুর্ঘটনার পরেই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। সেটি হল দুর্ঘটনাটি কেন ঘটেছে বা কীভাবে ঘটেছে। এর কারণ অনুসন্ধান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হয়। আমাদের দেশে বরাবরের মতো এবারও গার্মেন্টসের আগুন নিয়ে বেশ ক'টি "হাইপোথিসিস" বা পূর্বানুমান তৈরি হয়েছে। প্রধানত দুটো "হাইপোথিসিস" নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর দুটোই 'ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব।'

প্রথম ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব বলছে, বিশেষ কোনো চক্রের ইন্ধনে কাজটা হয়েছে। এই তত্ত্বের পক্ষে যারা তাদের কথা হল, আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বিরাট বিকাশের সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। চীন ও ভারত নিচু মানের গার্মেন্টস পণ্য তৈরির দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে। তাই বাংলাদেশে এখন এ শিল্প কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। দেশের ভেতরেই একটি মহল চাচ্ছে বাংলাদেশে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে। সেজন্যই গার্মেন্টসগুলোতে আগুন দেওয়ার হার বাড়ছে।

এ বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে কথা বলেছেন। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতারাও একইভাবে বলেছেন। তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের দুদিন পর গত সোমবার আশুলিয়ার আরেকটি কারখানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ডেবোনেয়ার নামের ওই কারখানাটিতে আগুন দিতে চেয়েছিল সুমি নামের এক কর্মচারি এবং তাকে নাকি কাজটি করতে বলেছিল জাকির নামের আরেক কর্মচারি। ধরা পড়ার পর সুমি জানিযেছে যে, জাকির তার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকি দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। কারখানার সিসিটিভিতে সুমির আগুন দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সত্তরের দশকে আমাদের পাটশিল্পের বিকাশের সময় প্রায়ই পাট গুদামে আগুন ধরে যেত। নাশকতার উদ্দেশ্যেই সেসব আগুন লাগানো হত বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানাচ্ছেন যে, একটি মহল এখন আবার আমাদের গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস করে দেশকে পঙ্গু করতে চায়। প্রথম 'ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে' মোটামুটি এটাই উঠে আসছে।

দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো গার্মেন্টস কারখানা দায়ী হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাজরিন গার্মেন্টস ছিল একটি কমপ্লায়েন্স কারখানা। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট এখান থেকে পণ্য কেনে। তাই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত যেকোনো প্রতিষ্ঠান এখানে নাশকতা চালিয়ে থাকতে পারে। এর সপক্ষে যারা বলছেন তাদের কথা হল, এটি একটি কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠান। এখানে আগুন নেভানোর জন্য যন্ত্রপাতি আছে। তিনটি সিঁড়ি আছে। শ্রমিকদের আগুন ধরার পর কী করতে হবে সে বিষযে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে অনেকবার। তাই আগুন লাগার পরপরই ফায়ার অ্যালার্মও বেজে উঠেছিল। কিন্তু এসব পূর্বসতর্কতা বজায় থাকা সত্তেও শ্রমিকরা রেহাই পেল না-এত অস্বাভাবিক সংখ্যায় তাদের মৃত্যু হোল! ভেতরের কর্মচারিরা কেউ কি কোন অন্তর্ঘাতে জড়িত ছিলেন?

ষড়যন্ত্রের ধারণাটি এ কারণেই শক্তিশালী হচ্ছে যে, ফায়ার অ্যালার্ম শুনে শ্রমিকরা নেমে আসতে চাইলে কারখানার কর্মচারিরাই তাদের জানাল যে এটা একটা মহড়া। এরপর ওরা গেট বন্ধ করে দেয়। সে ক্ষেত্রে বিকল্প ছিল ছাদের ওপর আশ্রয় নেয়ার সুযোগ। কিন্তু দেখা গেছে, চারতলার ওপরে কলাপসিবল গেটেও তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই তালা কে বা কখন লাগিয়েছে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাই অনেক শ্রমিক তিনতলা ও চারতলার মধ্যে আটকে পড়েছে। শেষে করুণভাবে পুড়ে মারা গেছে। দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র তত্ত্বটির কথা যারা বলছেন তাদের কথা হল, এভাবে ইচ্ছে করেই মৃতের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে যাতে প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়।

অবশ্য শ্রমিক নেতাদের কারও কারও দিক থেকে তৃতীয় আরেকটি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথাও শোনা যাচ্ছে। সেটি হল, ঋণে জর্জরিত কারখানাটির মালিক দায়মুক্ত হওয়ার আশা থেকেই নিজেদের কারখানায় নিজারাই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এসব নানামুখী বক্তব্য থেকে একথা বোঝা যায় যে আমরা কেউই কাউকে আর বিশ্বাস করছি না। আমাদের সমাজ আজ এক সর্বগ্রাসী আস্থাহীনতার সংকটে পতিত হয়েছে।

এভাবে নানা তত্ত্বের মাধ্যমে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশনের আগুন-লাগার কারণ ব্যাখ্যা করা হচ্ছে- হতে থাকুক! আমার কথা হল, ষড়যন্ত্র-তত্ত্বগুলোর যেকোনোটিই সত্যি হোক না কেন- এর পেছনে তথ্যপ্রমাণ লাগবে। তাই প্রথম কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু আস্থাভাজন তদন্তের ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে জানা যাবে আসলে কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন একটি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছেন, তখন সরকারও এখানে একটি পক্ষ অবলম্বন করছেন। কিন্তু "সুমীর ঘটনার" সিসিটিভী চিত্র এখনও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি তাছাড়া অনুরূপ ঘটনা যে তাজরিন গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হবে না। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে যদি সত্যই কোন গুরুত্বপুর্ন গোপন রিপোর্ট থাকে তাহলে তা তিনি প্রকাশ করছেন না কেন? কেন তিনি দেশের বিরুদ্ধে এসব হীন ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে দিচ্ছেন না?

এসব বিতর্কেও পাশাপাশি এখন আমাদের যে কাজটি জরুরীভাবে করতে হবে তা হল, যে দরিদ্র মানুষেরা পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মালিক, সরকার ও বিজিএমইএ-কে নিতে হবে। সাধারণত এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে বিরাট ক্ষোভ তৈরি হয়। শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে গার্মেন্টস শিল্পের মুনাফা আসে। সে মুনাফা দিয়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রাও আসে। আমরা প্রয়োজনের সময় ওদের ব্যবহার করি, আর তারা যখন আগুনে পুড়ে করুণভাবে মারা যায় তখন আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারব না তা তো হয় না।

আমাদের অন্য যে কাজটি করতে হবে তা হল, গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরন। নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজিডির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাজরিনের কারখানায় তিনটি সিঁড়ি ছিল। কিন্তু এ সব সিঁড়ির পাশে প্রচুর সূতা স্তূপ করে রাখা ছিল। এর ফলে আগুন যে কারণেই লেগে থাকুক তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

আরেকটি বিষয় দেখা গেছে, তাজরিন গার্মেন্টসের অবস্থান এমন একটি জায়গায় যেখানে আগুন লাগার পর দমকল বাহিনীর গাড়ি ভালোভাবে কাজ করতে পারেনি। রাস্তা ছিল বেশ সরু। তাছাড়া পেছনের বা আশেপাশের কোনো দিক দিয়ে গাড়ি ঢোকার পথ ছিল না। ফলে দমকল বাহিনী অনেক চেষ্টা করেও দ্রুততম সময়ে আগুন নেভাতে পারেনি। আর তাই সারারাতে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন শত প্রাণ।

এ জন্য প্রতিটি কারখানাকে কমপ্লায়েন্স কারখানা হলেই শুধু হবে না, ন্যূনতম যে কয়েকটি প্রতিব্যবস্থা আগামী ৬ মাসের মধ্যে গ্রহন করার জন্য সরকার ও মালিকদের সচেষ্ট হতে হবে ( সেজন্য যেসব কারখানা লাভ করছে তাদেরকে প্রতি ১০০ ডলার আয় থেকে ৫ ডলার এই নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করতে হবে। আইনানুযায়ি শ্রসিক কল্যানে এটুকু ব্যয় তাদের করারই কথা-কিন্তু খুব কম জনই তা করেন।) এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: প্রতিটি কারখানায় অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখা, আগুন লাগলে কী করতে হবে সে ব্যাপারে শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, জরুরি পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বেরিয়ে আসার জন্য একাধিক সিঁড়ি রাখা, কারখানার নিচে বা সিঁড়ির পাশে এমন ধরনের কিছু না রাখা যাতে আগুন লাগলে এর তীব্রতা বেড়ে যায় এবং শ্রমিকরা নিরাপদে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে বাধা পায় এবং কারখানাগুলোর অবস্থান এমন জায়গাতে হওয়া নিশ্চিত করা যেখানে প্রয়োজনে দমকল বাহিনীর গাড়ি সহজেই চতুর্দিক থেকে প্রবেশ করতে পারে।

তাজরিনের দুর্ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এত মানুষের পুড়ে কয়লা হওয়ার পর বেদনা আমাদের অভিভূত করেছে। সরকারও তাই বলছেন, তারা কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখার কাজ শুরু করবেন। যে সব কারখানায় একাধিক সিঁড়ি থাকবে না সেগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হবে। সত্যিই যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকরী হয়,তাহলে সেটা দিয়েই আমাদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

আমাদের দমকল বাহিনীকেও আরও অনেক বেশি আধুনিক করা দরকার। এখনও এ বাহিনীর হাতে ক্রেনসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি নেই। তাই উন্নত বিশ্বের এ ধরনের বাহিনীগুলোর মতো খুব দ্রুত এবং যেকোনো জায়গায় পৌঁছে আগুন নিভিয়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

মোটকথা, এখন তিনটি কাজ করা আমাদের জন্য জরুরি। তদন্ত করে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করা। সেক্ষেত্রে কোনো ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নেয়া। তৃতীয়ত, এই শিল্পের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা। যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয় তার জীবনের মূল্য অনেক। এখানে একেকটি প্রাণ অনেক মূল্যবান। তার পরিবারের কাছে তো বটেই, দেশের কাছেও।

কিন্তু আমরা যত আবেগভরে শোকদিবস পালন করলাম তত সিরিয়াসলী কি এসব কাজে ব্রতী হব?

আরেকটি কথা, গার্মেন্টস শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রায় অনুপস্থিত। হাতেগোণা কিছু কারখানায় এর স্বীকৃতি রয়েছে। শ্রমিকদের এ অধিকারের স্বীকৃতি সরকারও দিচ্ছে না। মালিকপক্ষও আগ্রহী নয়। আমি সবসময় বলে এসেছি যে শ্রমিকদের সংগঠন থাকলে যেকোনো পরিস্থিতিতে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ একসঙ্গে বসে আলোচনা করে সমাধানে পৌঁছাতে পারে। আর ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার না দিলে শ্রমিকদের ক্ষোভই শুধু প্রকাশ পায়, সমাধানের দিকনির্দেশ হয় না।

এম এম আকাশ :অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়।