Published : 27 Nov 2012, 05:12 PM
Updated : 27 Nov 2012, 05:12 PM

মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবকে পুড়িয়ে মারতে তৈরি করা হয়েছিল মরণ-ফাঁদ জতুগৃহ। তাতে পঞ্চপা-বের মৃত্যু হয়নি। আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল অসহায় নিষাদ সন্তানরা আর তাদের মা। নিষাদরা দরিদ্র ও অনার্য বলে তাদের মৃত্যু নিয়ে কেউ কোনো হা-হুতাশ করেনি। তারা স্বর্গে গেল না নরকে গেল তা নিয়েও চিন্তিত হয়নি কেউ। অসহায় ও নিরপরাধ ওই নিষাদদের মৃত্যুর দায়ভার নিয়েও কোনো মুনি ঋষি মাথা ঘামাননি। স্বয়ং গ্রন্থকারও বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেননি। অথচ আর্য শাসিত বারণাবতের প্রজা ছিলেন নিষাদরা। তাদের শ্রমেই মুখের গ্রাস জুটতো শাসক আর্যদের।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো যেন সেই জতুগৃহের বর্তমান সংস্করণ। এ কালের শ্রমিকরা সেই জতুগৃহের অসহায় বলি। মহাভারতের নিষাদদের মতো তাদের মৃত্যুতেও যেন কারও কিছুই যায় আসে না। যদি তাদের মৃত্যুতে সত্যিই কারও কিছু যায় আসতো তাহলে বারে বারে এমন ঘটনা ঘটার পরও কেন সত্যিকারভাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না! আগুনে পুড়ে গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু তো এদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও ঘটেছে একই রকম ঘটনা। আগুন থেকে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে শ্রমিকরা দেখেছে তাদের বাইরে যাবার পথে তালা ঝুলছে। অসহায়ভাবে পুড়ে মরা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাদের সামনে। কি নির্মম! কি বর্ববরতা! যেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা ক্রীতদাস! কারখানায় প্রবেশ-নির্গমন পথে তালা লাগিয়ে রাখা হয় পাছে শ্রমিকরা কিছু চুরি করে নিয়ে যায় এই ভয়ে। যেন তারা সব চোর, অপরাধী, জেলখানার কয়েদি। তাদের বের হবার রাস্তায় তালা মেরে রাখতে হবে!

কারখানার ভিতরে থাকবে না কোনো আধুনিক অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা। কারণ কি দরকার খরচ বাড়িয়ে। না হয় শতাধিক শ্রমিক পুড়েই মারা গেছে। তাতে আর এমন কি ক্ষতি হয়েছে। এই গরিব মানুষগুলোর জীবনের এমন কি বা মূল্য আছে। তারা তো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নয়। এমনকি কোনো ছাত্র সংগঠনের পাতি কর্মীও নয়। নিতান্তই সাধারণ মানুষ। তারা কারও সন্তান নয়, ভাইবোন নয়, বাবা মা নয়। তাদের মৃত্যুতে যদি পরিবারে কেয়ামতও নেমে আসে তাতেই বা কার কি এসে যায়। শোক প্রকাশ, দুঃখ প্রকাশ চলবে কয়েকদিন, তারপর আমরা সবাই ওদের কথা ভুলে যাবো। আগামীতে আবারও ঘটবে এমন ঘটনা। আবারও কয়েকদিন দুঃখ প্রকাশ, লেখালেখি। ব্যস। শ্রমিকদের পুড়ে মরা ছাড়া আরও কতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে দেশে বিদেশে।

শুধু একটা বিষয় একটু মনে রাখা দরকার, এই যে সাধারণ শ্রমিক যারা পুড়ে মারা গেলেন তাদেরই শ্রমে, ঘামে, রক্তে কিন্তু পোশাক শিল্পের চাকাটা চলছে। এরাই কিন্তু উপার্জন করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। এরাই কিন্তু দেশের তথাকথিত 'মাথা'দের পোলাও-কোর্মার জোগান দিচ্ছেন। তাদের দামি গাড়ি চড়ার সুখটুকু কিন্তু এনে দিচ্ছেন ওই দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষরাই।

বাংলাদেশে শ্রম আইন রয়েছে। রয়েছে কারখানা নিরাপত্তা আইন। কিন্ত কাজীর গরু কেতাবেই অছে, বাস্তবে নেই। এতোবার কারখানায় আগুন লাগা ও শ্রমিক পুড়ে মরার ঘটনা ঘটার পরও কেন কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয় না। যে কারখানায় যথোপযুক্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই সেগুলো কিভাবে ব্যাংক ঋণ পায়, কিভাবে তাদের লাইসেন্স থাকে! শোনা যায় কয়েকদিন আগেই নাকি ওই কারখানায় অগ্নি নির্বাপন মহড়া হয়েছে। তাহলে কিভাবে সেখানে আগুন লাগার সময় গেটে তালা মারা থাকে। এমন মহড়ার প্রহসনের কি প্রয়োজন!

এই মৃত মানুষগুলোকে নিয়ে এখন চলছে আরেক খেলা। মৃতের সংখ্যা নিয়ে চলছে নানা রকম ভাষ্য। সরকারি ভাষ্য, বেসরকারি ভাষ্য। সব সময় তাই হয়। কাউকে কাউকে বলা হচ্ছে 'নিখোঁজ'। নিখোঁজ মানে কী? যে মানুষটি সকালে কারখানায় কাজে এলো সে নিখোঁজ কেন হবে? সে মৃত। এটুকু তো একজন শিশুও বোঝে। কিন্তু শিশু যা বোঝে আমাদের 'মাথা'রা তা বোঝেন না। বুঝবেন কিভাবে? বুঝলে যে ক্ষতিপূরনের অংক বেড়ে যাবে। যতক্ষণ লাশ পাওয়া না যায় ততোক্ষণ মৃত ঘোষণা করা চলবে না। হ্যা, এ নিয়ম সারা পৃথিবীতেই আছে। সেই নিয়মেরই সুযোগ নেয় সরকার ও মালিকপক্ষ। কারণ মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই শুধু যে ক্ষতিপূরণের চাপ বৃদ্ধি তা তো নয়, সেই সঙ্গে মানসিক চাপ বৃদ্ধিও। এতো মানুষের মৃত্যু তো বিবেকের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। তাই যতদূর সম্ভব সংখ্যা কমিয়ে বলতে পারলেই ভালো।

বলা হচ্ছে নাশকতার কথা। বুঝলাম নাশকতা। কিন্তু আগুন লাগার পর বের হবার দরজায় তালা না থাকলে তো অসহায় মানুষগুলো অন্তত প্রাণে বাঁচতো।

আশুলিয়ার মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় শোক। কিন্তু জাতীয় শোক ঘোষণার ফলে মৃত মানুষরা ফিরে আসেনা। মৃতদের পরিবারের অসহায় স্বজনদের শোকের চেয়েও বেশি প্রয়োজন অন্ন সংস্থান।

কোনো মানুষের জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। ক্ষতিপূরণ হয় না স্বামী, স্ত্রী, বাবা মা, ভাইবোনের মৃত্যুর। কোনো মানুষের মৃত্যু হলে তার শূন্যতা সেই পরিবারে অপূরণীয়। যে শিশুরা এতিম হলো তারা কি আর কখনও বাবা মায়ের স্নেহ মমতা ফিরে পাবে? মমতার কি কোনো ক্ষতি পূরণ হয়? হয় না। তাদের বাবা মাকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তাদের জীবন ধারণের নিশ্চয়তাটুকু অন্তত দেওয়া সম্ভব। তাদের বেঁচে থাকার চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের মৃত্যু যেন ভবিষ্যতে আর কখনও না ঘটে নিশ্চিত করতে হবে সে বিষয়টি। তা একান্ত জরুরি, সবচেয়ে জরুরি।

বাংলাদেশকে সচল রাখতে হলে পোশাক শিল্পের চাকাটা সচল রাখতে হবে। একের পর এক এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে পোশাক শিল্পের সর্বনাশ হতে আর দেরি হবে না। পোশাক শিল্পের সর্বনাশ মানে শুধু খেটে খাওয়া শ্রমিকের সর্বনাশ নয়। পোলাও কোর্মা খাওয়া মাথাদেরও সর্বনাশ।

আশুলিয়ার ওই কারখানাটিতে যে আগুন জ্বলেছে তা কিন্তু বাংলাদেশের কপালের সর্বনাশের আগুন। এই জতুগৃহে শ্রমিকদেরই শুধু মৃত্যু হয়নি, তা অশনি সংকেত বয়ে এনেছে আমাদের রপ্তানি বাজারের জন্যও। দেশ বাঁচানোর জন্যই এই ধরনের আর একটি জতুগৃহের ঘটনাও যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে কুরুক্ষেত্রের সর্বনাশ কেউ রুখতে পারবে না।


শান্তা মারিয়া
: কবি ও সাংবাদিক।