জামায়াতের সন্ত্রাস ও স্ববিরোধিতা

আবু সালেহ সেকেন্দার
Published : 24 Nov 2012, 05:06 PM
Updated : 24 Nov 2012, 05:06 PM

সম্প্রতি সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের কর্মী সমর্থকরা সারা ত্রাস সৃষ্টি করেছে। গেরিলা স্টাইলে হঠাৎ করে রাজপথে ঝটিকা মিছিল, ভাংচুর, ট্রাফিক সার্জেন্টদের মারধর এবং পুলিসের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়াসহ বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত করে জনমনে আতংক তৈরি করেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আসার আগে পালিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত অথবা একা দায়িত্বপালনকারী পুলিশ সদস্যদের উপর অতর্কিতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

ইসলামের নবী শত নির্যাতন সত্তেও নিরপরাধ কোন 'কাফেরকে' অর্তকিত আক্রমণ করেন নি। তিনি সবসময় ধৈর্য্যধারণ করেছেন এবং গোপনে নয় প্রকাশ্য সমরে আক্রমণকারী 'কাফেরদের' মোকাবেলা করেছেন। কিন্তু আজ জামায়াত-শিবির যা করছে তা ছিলো জাহেলিয়া যুগে বর্বর আরবদের বৈশিষ্ট্য। পি কে হিট্রি তাঁর হিস্টি অব আরবস গ্রন্থে বলেছেন যে, জাহেলিয়া যুগে মরুবাসী আরবরা প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর মনে ভয় তৈরি করতে 'ওয়া আল কার ওয়া আল ফার' অর্থাৎ আক্রমণ কর ও পালায়ন-কর-নীতি অনুসরন করত। কিন্তু ইসলাম জাহেলিয়া যুগের অনেক নীতি গ্রহণ করলেও এই নীতিটি অনুমোদন করেন নি। আর আজ জামায়াত নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে সেই 'আক্রমণ-কর-পালায়ন-কর-নীতি' গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে, মতিউর রহমান নিজামী তাঁর ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদ গ্রন্থে The World Book Encyclopedia-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, "সাধারণ অপরাধীরা অর্থ বা অন্যবিধ স্বার্থ হাসিল করতে চায়। বেশীরভাগ সন্ত্রাসীরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই অপরাধ ঘটিয়ে থাকে।" তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, "সাধারণত সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা অপহৃত ও নিহতদের মধ্যে রয়েছে কূটনীতিবিদগণ, ব্যবসায়ীবৃন্দ, কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিচারপতিবৃন্দ ও পুলিশ।" এখন উক্ত জামায়াত নেতার কাছে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে তিনি সন্ত্রাসীদের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন বর্তমান জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম সেই সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে কিনা? সন্ত্রাসী বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সন্ত্রাসীরা সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটিত করে এবং সন্ত্রাসী তারাই যাদের দ্বারা রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশসহ অন্যন্যারা আক্রান্ত হয়। আজ জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে আক্রমণ করছে। ইতিমধ্যে, তারা আইনমন্ত্রীর গাড়িতে হামলা অথবা সারাদেশে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের উপর নগ্ন আক্রমণ চালিয়েছে। তাই নিজামীর বক্তব্য অনুসারে আজ জামায়াত-শিবির কর্মীরা যা করছে সেই কার্যকলাপ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে এমন দাবি করা অসঙ্গত হবে না।

তবে জামায়াতের কথা ও কাজে মিল না থাকার এই চরিত্র নতুন নয়। জামায়াত ইসলাম নামক দলটি জম্মগতভাবে এই বৈচিষ্ট্য পেয়েছে। ১৯৩৩ সালে ক্যাম্বব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমত আলী ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিয়ে পৃথক একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি উত্থাপন করেন। তার প্রস্তাব অনুযায়ী পাঞ্চাব, আফগান (উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ), কাশ্মীর, ইন্দাজ (সিন্ধু) এবং বেলুচিস্তান নিয়ে এই রাষ্ট্র গঠিত হবে। উক্ত এলাকার প্রথম অক্ষর নিয়ে নবগঠিত রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান (অর্থ 'পবিত্র ভূমি')। মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই প্রস্তাব লুফে নেন এবং মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের লাহোর সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক ভারতে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। অতঃপর মুসলিম লীগ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির শ্লোগান তুলে নতুন আন্দোলন জোরদার করে। কিন্তু উক্ত মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুসলিম লীগের প্রস্তাবের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন জামায়াত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। ১৯৪১ সালে মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলাম এই অভিমত ব্যক্ত করে যে, 'আধুনিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি ইসলামী নীতি আর্দশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল।' কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে আইনের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে জামায়াতে ইসলাম তার ভোল পাল্টায়। ড. মো. মাহবুবর রহমান তাঁর বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯৪৭-৭১) গ্রন্থে বলেন, "যদিও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে এই দল পাকিস্তানকে দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।" আর ১৯৪৭ থেকে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহনের পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্যে সেই পাকিস্তানের প্রতি জামায়াত নেতাদের আনুগত্য আমরা দেখেছি। তাছাড়া, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে পাক-বাহিনীকে সহায়তায় জামায়াতের ভূমিকা সবার জানা।

একদা জামায়াত যেমন পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল তেমনি তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ভারত বিভক্তির পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে জামায়াত নেতারা নিজেদেরকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে দেখাতে শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এবং গোলাম আযমের পুন:রায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানে সংযুক্ত করার অপতৎপরতা ব্যর্থ হলে তারা বাংলাদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ প্রদান করলে জামায়াত স্বনামে আর্বিভূত হয়ে এবং ১৯৯১ সালে গোলাম আযম হাইকোর্টের রায়ে এদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পেলে এই দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। তখন থেকেই জামায়াত এই দেশের জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা দিতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা বাদ দিয়ে ভাষা আন্দোলনে তার অবদানকে সামনে নিয়ে আসে। সর্বশেষ ২০০১ সালে বিএনপির সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে জেগে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরা বিছিন্নতাবাদী ও ভারতের এজেন্ড হিসেবে অভিহিত করলেও জামায়াত কখনও এর প্রতিবাদ করেনি। আর আজ সেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি জামায়াত নেতাদের শ্রদ্ধায় অবনত হতে দেখলে হাসি পায়। নিজামী তার ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কূটকৌশল গ্রন্থে বলেছেন, "মরহুম শেখ মুজিবকে আমি শ্রদ্ধা করি।" যদিও ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের প্রতি নিজামীর এই শ্রদ্ধার কথা কেউ শোনেন নি।

আসলে, জামায়াত কখনও তাদের দুমুখো নীতি পরিত্যাগ করেনি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ও এই নীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ তারা দেখিয়েছে। জামায়াত স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। আবার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন জোরালো হলে জামায়াতের ১০ জন সংসদসদস্য পদত্যাগ করেছে। ১৯৯১ সালে সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সাথে জামায়াতের এই আতাঁত টিকে থাকেনি। ফলে ৯৬-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাববধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে জামায়াত অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, ২০০১ সালে আবারও বিএনপির সাথে প্রকাশ্য জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে হঠাতে মাঠে নামে। অর্থাৎ জামায়াতের চরিত্র হচ্ছে যখন যে দলের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করা যাবে তখন সেই দলের সাথে রাজনীতির ময়দানে থাকা। আজ বিএনপি নেত্রী যে সন্দেহ করছেন জামায়াত তলে তলে আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগ রাখছে। সেই আশংকাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনও হতে পারে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি না গেলেও জামায়াত জোট ত্যাগ করে অংশগ্রহণ করতে পারে। যদি তাদেরকে এমন নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে যুদ্ধোপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতাদের মুক্তি দেওয়া হবে। আর এমনটি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ১৮ দলীয় জোটের সর্বশেষ বৈঠকে জামায়াতের কোন কেন্দ্রিয় নেতা উপস্থিত না থাকাতে এই সন্দেহ আরো দানা বেঁধেছে যে জামায়াত নিজেদের স্বার্থে বিএনপিকে ত্যাগ করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অন্যদিকে, জামায়াত একদা নারী নেতৃত্বের বিরোধিতায় সরব ছিল। বিশেষ করে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জামায়াত নেতা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেটগুলো শুনলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে যোগদান ও পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী সভায় জামায়াতের দুই নেতার মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর সাঈদী সাহেব উক্ত বিষয়ে চুপ হয়ে যান। তখন জামায়াতের কোন নেতাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলত এটি হুদায়বিয়ার সন্ধির অনুরূপ। মহানবী (স.) যেমন হুদায়বিদাতে 'কাফেরদের' সাথে চুক্তি করছিলেন। ইসলামের স্বার্থে তেমনি জামায়াত বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে গমন ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছে।

আমার বিশ্বাস বিএনপির সাথে কোয়ালিশন ভেঙে গেলে জামায়াত আবারও এমন আওয়াজ তুলবে যে, ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। তাই আসুন ইসলাম রক্ষার্থে আপনারা জামায়াতকে ভোট দিন।

জামায়াত তার গঠনতন্ত্রের একদিকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহর আইন মান্য করার কথা বলেছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের কথা বলেছে। জামায়াতের এই ধরণের স্ববিরোধিতা অনেকটা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র মতো। একদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের এই কথা বোঝানো যে তারা ইসলামী আইন বাস্তবায়নে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে, পুঁজিবাদীদের সৃষ্টি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সর্মথন করছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। ইসলামী আইনে সার্বভৌম একমাত্র আল্লাহর এবং ইসলামের সংবিধান আল-কুরআন। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান মানব সৃষ্ট। তাই জামায়াতের উপরোক্ত ইসলাম রক্ষার স্বার্থে রাজনীতি করার তত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সাথে এক ধরণের ধোঁকাবাজি।

জামায়াত ইসলামের কথা ও কাজে মিল না থাকার বহু প্রমাণ আছে। এই সব কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই জানে। কিন্তু নানা সময়ে তারা এসব স্ববিরোধিতা এড়িয়ে জামায়াতকে সাথে নিয়ে একে অপরের স্বার্থ সিদ্ধি করেছে। আজ আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরোধিতা করলেও ভবিষ্যৎ-এ জামায়াতকে সাথে নিয়ে বিএনপিবিরোধী আন্দোলন করবে কিনা আমরা জানি না। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক তরুণ প্রজম্মের সমর্থনে ক্ষমতায় যেতে হলে উভয় দলকেই জামায়াতকে পরিত্যাগ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আবু সালেহ সেকেন্দার: শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।