মওলানা ও ভাসানীর সম্মিলন

আনু মুহাম্মদ
Published : 16 Nov 2012, 03:59 PM
Updated : 16 Nov 2012, 03:59 PM

মওলানা ভাসানী বলে যাকে আমরা চিনি সে ব্যক্তির প্রকৃত নাম তা নয়। তাঁর নামে এই দুই শব্দের কোনোটিই ছিল না। মওলানা ও ভাসানী এ দুটো শব্দই তাঁর অর্জিত পদবী বা বিশেষণ। মওলানা ছিল তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার পরিচয়, আর ভাসানী ছিল সংগ্রাম ও বিদ্রোহের স্নারক। তাঁর জীবন ও জীবনের কাজ এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যাতে পদবী আর বিশেষণের আড়ালে তাঁর আসল নামই হারিয়ে গেছে। আসলে তাঁর নাম ছিল আবদুল হামিদ খান। ডাক নাম ছিল চ্যাগা। শৈশবে এ নামই ছিল তাঁর পরিচয়।

প্রাচুর্য্য-বিত্ত-বৈভব-আভিজাত্য যেগুলো রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সাধারণত কাজে লাগে সেগুলোর কোনোটাই তাঁর ছিল না। যাত্রাদল থেকে শুরু করে দেওবন্দ মাদ্রাসা- জীবনের সব অভিজ্ঞতাই তিনি ধারণ করেছিলেন। এ সবের মধ্যে তাঁর সাধারণ যে প্রবণতা তাঁকে পরবর্তীকালে বিশিষ্ট করে তুলেছিল তা হল তাঁর গণসম্পৃক্ততা। এই গণসম্পৃক্ততা তাঁকে নিজের ও চারপাশের সমষ্টির জীবনকে এক করে দেখার ক্ষমতা দান করেছিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদকে দেখেছিলেন উপর থেকে নয়- চারপাশের পিষ্ট মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। দারিদ্র-অসহায়ত্ব-মানবেতর জীবন যে নিয়তি নয়; নির্দিষ্ট কিছু কারণ, ব্যবস্থা ও ক্ষমতা এগুলোকে সৃজন করে, টিকিয়ে রাখে এই উপলব্ধি তাঁকে আর সব মওলানা ও পীরের চেয়ে ভিন্ন করে ফেলে। এ জগতে তিনি হয়ে পড়েন নি:সঙ্গ আর জনতার মধ্যে তিনি পরিণত হন মজলুম জননেতায়।

মওলানা-পীর-মাশায়েখরা আমাদের সমাজে এমনিতেই খুব ক্ষমতাবান। শাসক ও শোষকেরা এদের সবসময়ই পৃষ্ঠপোষকতা দেয় নিজেদের ভিত্তি শক্ত রাখবার জন্য। আর অন্যদিকে বহু মানুষ নিজেদের অসহনীয় জীবনকে সহনীয় করবার জন্য এই ধর্মীয় নেতা বা পেশাজীবীর কাছেই হাজির হন। দোয়া, ভরসা, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ দিয়ে তারা শরীরের অসুখ সারাতে চান, সন্তানের নিরাপত্তা চান, বিপদে-আপদে আল্লাহর আশ্রয় চান, জমিদার-জোতদারসহ বিভিন্ন কায়দার জালেমের হাত থেকে বাঁচবার জন্য কোনো অলৌকিক সহায়তার প্রার্থনা করেন। যেখানে চিকিৎসার পয়সা নেই, ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই; যেখানে নিজেদের আলাদা শক্তি আছে সেই বোধ স্পষ্ট নয়; যেখানে নদীভাঙন, জমিদার-মহাজন কিংবা জুলুমবাজ ক্ষমতাবানদের অত্যাচার-শোষণে বর্তমান রক্তাক্ত ভবিষ্যৎ ভীতিকর, সেখানে এ পথ ছাড়া মানুষের সামনে আর কী পথ আছে?

পীর-মওলানারা পয়সা নেন, খাওয়া-দাওয়া করেন, এ সব বিষয়ে দাওয়াই দেন এবং মানুষকে ধৈর্য্য ধরতে বলেন, সবর করতে বলেন, কপাল আর বরাত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলেন। নিজেরা নানা গ্রন্থিতে আটকে থাকেন তাঁদের সঙ্গেই যারা সংখ্যালঘু কিন্তু জালেম ক্ষমতাবান। এদের উপরই তাদের নির্ভরতার মধ্য দিয়ে পরস্পর পরস্পরকে রক্ষা করে। সে জন্য এই পীর-মওলানারা মানুষকে ইহকালের দুর্বিষহ জীবনের কারণ নির্দেশ করতে অপারগ এবং অনিচ্ছুক থাকে। নানা ঝড়ঝাপটা আর আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত মানুষদের কাছে তাঁদের একমাত্র বক্তব্য, পরকালের অসীম সুখ পাবার জন্য ইহকালের বিষয়ে ধৈর্য্য ধারণ করা।

মওলানা ভাসানীও পীর ছিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর মুরিদ ছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদ না থাকাতে তাঁর কাছে কারও আসতে বাধা ছিল না। বিভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ এবং বলাই বাহুল্য গরীব মানুষ যাঁরা জমিদার-মহাজন আর মালিকশ্রেণির শোষণ-পীড়নে বিপর্যস্ত-ক্লিষ্ট, তাঁর কাছে এসে হাজির হতেন। অন্যান্য ধর্মজীবীর মতো এইসব মানুষের দু:খ-দুর্দশা মওলানার আয়-উপার্জনের উৎস ছিল না। মওলানা দোয়া-পানিপড়া-ঝাড়ফুঁক সবই দিতেন, কিন্তু অসুখ বেশি হলে পরামর্শ দিতেন ডাক্তার দেখাতে, প্রয়োজনে ওষুধ কেনার জন্য টাকাও দিতেন।

আরও যে জায়গায় এসে তিনি অন্যদের থেকে শুধু আলাদা নয়, প্রায় বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন নিজেকে সেটিই এক মওলানাকে যুক্ত করেছিল এক ভাসানীর সঙ্গে। মানুষ তাঁর কাছে ভরসা চাইতেন আর বলতেন কিংবা জীবন্ত স্বাক্ষর হিসেবে হাজির হতেন অবর্ণনীয় অন্যায় এবং অবিচারের। এই জীবন নিয়তির বিধান, আল্লাহ এভাবেই বেশিরভাগ মানুষের জীবন নরক করে নির্ধারণ করেছেন আর সব ক্ষমতা সম্পদ দান করেছেন লম্পট জালেমদের হাতে, এই বিশ্বাসচর্চা থেকে তিনি সরে এসেছিলেন অনেক আগেই। বরং তাঁর অবস্থান ছিল এই যে, এই নারকীয় অবস্থা নিয়তি নয়, এটা আল্লাহ-প্রদত্ত বিধান নয়, আর সর্বোপরি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে এ অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম। এই ভিন্ন অবস্থানের কারণেই তিনি তরুণ বয়স থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত এটা তাঁর জীবনের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ইসলাম ধর্ম তাই অন্য প্রতিষ্ঠিত শাসকেদের পেয়ারা পীর-মওলানা থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন বিশ্লেষণে উপস্থিত হয়েছিল মওলানা ভাসানীর জীবনে, উচ্চারণে ও সংগ্রামে। যা ইসলাম ধর্মের মালিকানায় অধিষ্ঠিত তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র, সামরিক শাসক, জোতদার, মহাজন, সামন্তপ্রভু, তাদের পেয়ারা পীর-মওলানাদের ক্ষিপ্ত করেছিল। তিনি অভিহিত হয়েছিলেন 'ভারতের দালাল', 'লুঙ্গিসর্বস্ব মওলানা' এমনকি 'মুরতাদ' হিসেবে। শাসক-শোষকদের এ ক্ষিপ্ততা আসলে ছিল একটা শ্রেণিগত রোষ। পোষাকে, জীবনযাপনে, বয়ানে, আওয়াজে, সবদিক থেকেই ভাসানী ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। এবং লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই অভিজাত ইসলামের বিপরীতে তাঁর কাছে অন্য ইসলামের ভাষা তৈরি হয়। ধর্ম যেখানে শাসক জালেমদের একচেটিয়া মালিকানাধীন নিরাপদ অবলম্বন- সেখানে মওলানা ভাসানী সে নিরাপদ দুর্গকেই হুমকির মুখে নিক্ষেপ করেছিলেন।

অন্যায়-অবিচার তো বিমূর্ত নয়; দু:খ-দুর্দশাও অজানা গ্রহ থেকে নেমে আসা ব্যাপার নয়। দায়িত্ব আর সংবেদনশীলতা দিয়ে মানুষের এ সব অভিজ্ঞতা দেখলে উন্মোচিত হয় এক বিরাট রহস্য। আবিষ্কার করা যায় মানুষের মানবেতর জীবনের কারণ, শনাক্ত করা যায় এর পেছনের সামাজিক ব্যবস্থা বা নিয়ম-বিধি। পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করা যায় সে সব শ্রেণি-গোষ্ঠী যারা এ সব ব্যবস্থার উপরই দাঁড়িয়ে থাকে, এ সব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করে, ধর্মও যা থেকে বাদ যায় না। এ থেকে সার্বিক মুক্তিলাভের লড়াই তাই অনির্দিষ্ট হতে পারে না, লক্ষ্যহীন হতে পারে না। এ জন্য দরকার এমন একটা সমাজের চিন্তা করা, স্বপ্ন দেখা ও দেখানো- যার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানুষ এ নারকীয় অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করবে। ভাসানী তাই লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন সমাজতন্ত্র। সৌদী আরব নয়- যে সমাজ মানুষকে হাসি দিতে পারে মানবিক জীবন দিতে পারে সে রকম সমাজই তিনি লক্ষ্য হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত করেছিলেন।

সুতরাং অন্যায়-অবিচার আর দু:খ-দুর্দশা থেকে মানুষের মুক্তির জন্য দোয়া-দরূদ নয়, দরকার সমষ্টিগত লড়াইয়ের রাস্তা তৈরি করা, এই উপলব্ধি মওলানাকে একইসঙ্গে সক্ষম করেছিল সংগ্রামের প্রতীক ভাসানী হয়ে উঠতে। যে ভাসানী সবরকম জালেমদের প্রবল দাপট আর আগ্রাসনের সামনে লক্ষ মানুষের স্বর নিজের কন্ঠে ধারণ করে পাল্টা ক্ষমতার প্রবল শক্তিতে রুখে দাঁড়াতেন, এক কন্ঠে জনতার ভেতর থেকে উঠে আসা অসীম শক্তিকে মূর্ত রূপ দিতেন। ক্লান্ত-বিবর্ণ-ক্লিষ্ট মানুষ শুধু নয়- প্রকৃতিকেও প্রাণবন্ত তরতাজা করে তুলত জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের হুশিয়ারি: 'খামোশ'!

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।