সময়ের কথা:পরিমাপের বিবর্তন

Published : 15 Nov 2012, 03:22 PM
Updated : 15 Nov 2012, 03:22 PM

ঘড়ি নিয়ে কিছু কথাঃ
ঘড়ি আমরা হাতে পড়ি, দেয়ালে টাঙ্গাই, টেবিলে রাখি। আগে পকেট ঘড়ির চল ছিল, আমার এক কাকার চমৎকার একটা পকেট ঘড়ি ছিল, চকচকে ধাতব রূপালি, সাদা প্রেক্ষাপটে কালো রোমান হরফে সংখ্যা লেখা, কালো সূতো দিয়ে ওনার খদ্দরের পাঞ্জাবীর পকেটে বাঁধা থাকত। সেই কাকা – যাকে আমি রাঙ্গা কাকা বলতাম – বৃটিশ সময়ে আন্দোলন করতেন। তাঁর স্মৃতি আমার কাছে সেই পকেট ঘড়ির সঙ্গে অচ্ছেদ্য। এখন আমি আর কাউকে পকেট ঘড়ি ব্যবহার করতে দেখি না। সেই রাঙ্গা কাকা ও তার পকেট ঘড়ি সময়ের সাথে হারিয়ে গিয়েছে।

সময়ের দৈর্ঘ্যঃ
সময়ের গতিকে জানা আমাদের বাঁচার জন্য অপরিহার্য, ঘড়ি আমাদের সময়ের স্টেশন, ঘড়ির মধ্যে সময়ের কাঁটা ঘোরে, আর ১, ২, ৩, ৪ লেখা স্টেশনগুলো পার হয়ে যায়। ঘড়ি আমরা ব্যবহার করি, কিন্তু ঘড়ি কেমন করে চলে তা নিয়ে আমরা ভাবি না, যেমনটা আমরা ভাবি কম্পিউটার, ফোন, গাড়ি, রেলগাড়ি বা বিমান নিয়ে, বেতার, টেলিফোন বা টেলিভিশন নিয়ে, হাসপাতালের এক্স রে বা সিটি স্ক্যান মেশিন নিয়ে। কিন্তু সব যন্ত্রই অচল হবে যদি না তার মাঝে সময়কে সঠিক ভাবে মাপার কোন পদ্ধতি না থাকে। অন্যদিকে সময়ের দৈর্ঘ্য কতখানি হবে সেটা না জানলে ঘড়ির পর্যায় কাল (পিরিয়ড) ও কম্পাঙ্ক ঠিক করে দেওয়া যাবে না। আমরা যে সময়ের এককের দৈর্ঘ্য এখন ব্যবহার করি সেটাতে পৌঁছাতে মানব সভ্যতাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে এবং বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানে, বিশেষতঃ পদার্থবিজ্ঞানে, অগ্রগতি না হলে সেই সময়ের স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছানো যেত না। এখন আমাদের সময়ের ধারনার সাথে কোয়ান্টাম ও আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেক পাঠকই এটা শুনে হয়তো আশ্চর্য হবেন যে আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন আপনার সময় এখন নির্ধারিত হয় পারমাণবিক ঘড়ি বা Atomic Clock দিয়ে । সেই পারমাণবিক ঘড়ির সিজিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রনের ঝাঁপ থেকে নির্গত আলোর কম্পাঙ্ক থেকে আমরা আমাদের ঘড়ির সময় ঠিক করি।

এ' বছরের নোবেল পুরস্কারঃ
২০১২ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার যে দুজনকে দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর National Institute of Science and Technologyতে কর্মরত গবেষক ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড, অপরজন হচ্ছেন সের্ঝ হারোশ, প্যারিসে Collège de France এ অধ্যাপক। এই দু'জন এবং তাঁদের গবেষক দল পরমাণুকে আলাদা করে তার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যকে বেশ কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখার পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য কি সেটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। তবে বলব একটি কণা যতক্ষণ অন্য কোন কণার সংস্পর্ষে না আসবে তার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য বজায় থাকবে, এই ধরণের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘজীবী কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যতে কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটার গঠন করার জন্য লাগবে। কিন্তু এছাড়াও এই ধরণের কণা-পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া ও সেগুলোর কোয়ান্টাম দশা বজায় রাখার পদ্ধতি নতুন ধরণের পারমাণবিক ঘড়ি বানাতে সাহায্য করবে। সেই ঘড়ির accuracy বর্তমানে ব্যবহৃত পারমাণবিক ঘড়ি থেকেও অনেক বেশী হবে, তার যথার্থতা এক হাজার কোটি বছরে (১০ বিলিয়ন বছরে) কয়েক সেকেন্ড মাত্র ফাস্ট বা স্লো হবে মাত্র। (এই লেখায় যথার্থতা কথাটি accuracy অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।) কিন্তু পারমাণবিক ঘড়ি কেমন করে চলে এবং সময়কে এত সূক্ষ্ম ভাবে মাপার প্রয়োজনই বা কি?

এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। দেখা যাবে যে সময়কে সঠিক ভাবে নির্ধারণের জন্য মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছে, এখনও করছে, প্রশ্ন করেছে একটা সেকেন্ড কত বড় সময়? মানুষের হ্রদযন্ত্র যেমন দেহকে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে রক্ত সরাবরাহ করে যায় প্রতিটি ঘড়ির ভেতরে এমন একটা পদ্ধতি আছে যা কিনা সেই ঘড়ির সময় প্রবাহের গতিকে নির্দিষ্ট করে দেয়। সেই গতিটা আসে একটা কম্পাঙ্ক মাপার মেখানিজম থেকে। একটা ঘড়ির সঠিক সময় দেয়াটা একটা সঠিক কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল। সেই ঘড়ি সবচেয়ে ভাল চলবে যে ঘড়িতে সেই কম্পাঙ্কটা খুব স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। কথা হচ্ছে কম্পাঙ্কটা কে ঠিক করবে? অর্থাৎ একটা সেকেন্ড যে ঠিক কত বড় সময় সেটা কে ঠিক করে দেবে?

সৌর দিন ও জ্যোতির্বিদ্যার সেকেন্ডঃ
সেকেন্ডের আদি দৈর্ঘ্যের হিসাবটা আমাদের কাছে এসেছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি থেকে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সূর্য দেখে দিনের সময় ঠিক করেছে, রাতে চাঁদ ও তারাদের আপেক্ষিক অবস্থান দেখে রাতের গভীরতা মেপেছে। একটা সৌর দিন হচ্ছে স্থানীয় মধ্যরেখা বা মেরিডিয়ানে সূর্যের পর পর দুটি অতিক্রম বা ট্রানজিটের মধ্যবর্তী সময়টুকু। স্থানীয় উত্তর ও দক্ষিণ বিন্দুকে মাথার ঠিক ওপরে সুবিন্দু বা জেনিথ দিয়ে যোগ করলে যে অর্ধবৃত্ত পাওয়া যায় তাকেই মধ্যরেখা বলে। খ-গোলকের যেকোন বস্তু (সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র) যখন মধ্যরেখা অতিক্রম করে তখনই সে স্থানীয় ভাবে আকাশের সবচেয়ে উঁচু অবস্থানে থাকে।

মাথার ওপরে সূর্যের পর পর দুটি অবস্থানের মধ্যবর্তী সময়টাকে ২৪ ঘন্টা ধরা হয়। ২৪ ঘন্টা মানে ২৪ x ৬০ x ৬০ = ৮৬,৪০০ সেকেন্ড। কাজেই মধ্যবর্তী সময়টাকে আমরা যদি ৮৬,৪০০ দিয়ে ভাগ দিই তাহলে একটা সেকেন্ড পাওয়া যাবে। কিন্ত পৃথিবীর প্রতিটি ঘূর্ণীর মান ৮৬,৪০০ সেকেন্ড নয়, বছরের বিভিন্ন সময় একটা দিনের মান কিছুটা বাড়ে বা কিছুটা কমে। ডিসেম্বরের শেষে সূর্যের দুটি মধ্যরেখা অতিক্রমের অবস্থানের মধ্যে সময় ২৪ ঘন্টা থেকে প্রায় ৩০ সেকেন্ড বেশি, অর্থাৎ একটা দিন/রাত্রি হচ্ছে প্রায় ৮৬,৪৩০ সেকেন্ড আর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এই সময়টা প্রায় ২০ সেকেন্ড কম। দিনের দৈর্ঘ্যের এই কম-বেশী হবার একটা কারণ হচ্ছে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবীর গতিবেগ এক থাকে না। কেপলারের সূত্র অনুযায়ী সূর্যের কাছে এলে পৃথিবীর গতি বাড়ে, সূর্যের দূরে গেলে গতিবেগ কমে। সূর্যের কাছে গতিবেগ বেশী থাকার সময় সূর্যকে পরের দিন মধ্যরেখাকে অতিক্রম করাবার জন্য পৃথিবীকে একটু বেশী ঘুরতে হয়, সেই জন্য কয়েক সেকেন্ড বেশী সময় লাগে। এছাড়া পৃথিবীর বুকে সমুদ্রের জলের জোয়ার ভাটা, এমন কি বাতাসের প্রবাহও পৃথিবীর ঘূর্ণনের ওপর প্রভাব রাখে।

লাপ্লাস ও দশমিক সময়ঃ
কিন্তু দৈনন্দিন সৌর দিনের সামান্য পরিবর্তন ছাড়াও হাজার হাজার বছর ধরে মূলতঃ জোয়ার-ভাটার কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীরে ধীরে শ্লথ হচ্ছে, কিন্তু ঊণবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বলবিদ্যার বিজ্ঞানীরা মনে করেছেন নিজের অক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতিবেগ বদলায় নি। এমন কি ১৮২৫ সনে বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী পিয়ের সিমন লাপ্লাস বলেছিলেন গ্রীক জ্যোতির্বিদ হিপারকাসের সময় থেকে দিনের দৈর্ঘ্য এক দশমিক সেকেন্ডের এক শতাংশও বদলায় নি। দশমিক সেকেন্ডটা কি জিনিস? ফরাসী বিপ্লবের পরে, ১৭৯৩ সনে, ফরাসী কর্তৃপক্ষ দশমিক সময়ের প্রস্তাব করে।এই প্রস্তাব অনুযায়ী একটা দিনকে ১০ ঘন্টায় ভাগ করা হয়, প্রতিটি ঘন্টা ১০০ মিনিটে ও প্রতিটি মিনিট ১০০ সেকেন্ডে। সব মিলিয়ে সারা দিনে ১০০,০০০ বা এক লক্ষ দশমিক সেকেন্ড থাকবে। কাজেই এক দশমিক সেকেন্ড ০.৮৬৪ আমাদের সাধারণ সেকেন্ডের সমান হবে। ফরাসীরা এই ধরণের সময়ের ব্যবহার এক দু' বছরের বেশি ধরে রাখতে পারে নি, ইউরোপের বাকি দেশগুলো সময়ের এই দশমিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নি। লাপ্লাস নিজে অবশ্য বহুদিন তাঁর কাজে দশমিক সময় ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি দশমিক সময়ের ব্যবহার আমাদের জীবনকে সহজ করতে পারত। যেমন ধরুন আমি যদি বলি মিটিং ১৫০ মিনিট পরে শুরু হবে, তাহলে সাথে সাথে বোঝা যাবে দেড় ঘন্টা পরে মিটিংটা হবে (১০০ + ৫০ মিনিট)। আমাকে ভাবতে হবে না ১৫০ মিনিটে ক'টা ঘন্টা আছে, ইত্যাদি। এছাড়া সকাল ছ'টা না সন্ধ্যা ছ'টা সেই ঝামেলাটাও থাকত না।


চিত্র ১. একটি ফরাসী দশমিক ঘড়ি। তৈরির তারিখ জানা নেই। ১০ ঘন্টা দিয়ে এখনকার ২৪ ঘন্টার সমান। এর একটি ঘন্টা আমাদের ২.৪ ঘন্টা বা ২ ঘন্টা ২৪ মিনিটের সমান। সকাল ৬টা হবে এই ঘড়িতে ২.৫ ঘন্টা বা ২ ঘন্টা ৫০ মিনিট। আর সন্ধ্যা ৬টা হবে ৭.৫ ঘন্টা বা ৭ ঘন্টা ৫০ মিনিট।

যাই হোক লাপ্লাস ভেবেছিলেন হিপারকাসের সময় থেকে ২০০০ বছর পার হয়েছে, তাতে পৃথিবীর ঘূর্ণনের মান দিনে ০.০১ দশমিক সেকেন্ড বা ০.০০৮৬৪ সাধারণ সেকেন্ডের সমানও শ্লথ হয় নি। ০.০০৮৬৪ সেকেন্ড হচ্ছে ৮.৬ মিলিসেকেন্ড। তার হিসাব কি ঠিক ছিল? ভূবিজ্ঞানীরা পাথরের বুকে জোয়ার-ভাঁটার ছাপ থেকে আবিষ্কার করেছেন যে আজ থেকে ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি বছর আগে একটা দিন হত ২১ ঘণ্টায়। তার মানে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সেকেন্ডের মানটিও বাড়ছে। এখনকার হিসেবে প্রতি ১০০ বছরে দিন ১.৭ মিলিসেকেন্ড বা ০.০০১৭ সেকেন্ড বাড়ছে। এই মানটা আপাতঃদৃষ্টিতে খুব ছোট মনে হলেও জিপিএস দিয়ে যখন আমরা পৃথিবীর বুকে স্থানাংক বা উচ্চতা নির্ধারণ করি তখন এই ধরণের ছোট মান গণনায় আনতে হয়। ওপরের মানটাকে যদি আমরা ১.৭ মিলিসেকেন্ডের পরিবর্তে ২ মিলিসেকেন্ড ধরে নেই তাহলে ২০০০ বছরে পৃথিবী দিনে ২০ x ১০-৬ সেকেন্ড x ২০০০ = ৪০ x ১০-৩ বা ৪০ মিলিসেকেন্ড শ্লথ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে লাপ্লাসের ন্যূনতম হিসেব (৮.৬ মিলিসেকেন্ড) থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণন অন্ততঃ পাঁচ গুণ পরিমাণ শ্লথ হয়েছে।

এস্কেপমেন্টঃ
একশো বছর আগেও সঠিক সময়ের জন্য আমরা জ্যোতির্বিদদের ওপর নির্ভর করতাম। জ্যোতির্বিদরা রাত জেগে তারাদের আকাশের মধ্যরেখা অতিক্রমের সময়টা নির্ধারণ করতেন। তারপর সেই সময়টার ওপর ভিত্তি করে তখনকার দিনে যে সমস্ত ঘড়ি চালু ছিল সেগুলোকে ঠিক করা হত। কি ধরণের ঘড়ি চালু ছিল তখন? মূলতঃ মাধ্যাকর্ষণ-তাড়িত ওজনের ওঠা-নামার ওপর ভিত্তি করে বা স্প্রিং-এর স্তিতিশক্তির ওপর ভিত্তি করে এক ধরণের পদ্ধতি যাকে বলে এস্কেপমেন্ট তার ওপর ভিত্তি করে গড়া ঘড়ি। এই ধরণের ঘড়ি মানুষের এক অত্যাশ্চার্য সৃষ্টি, তবুও এই ধরণের ঘড়ি শেষ পর্যন্ত দিনে এক সেকেন্ডের বেশি যথার্থতা দেখাতে পারে না।


চিত্র ২. যান্ত্রিক ঘড়ির একটি এস্কেপমেন্ট পদ্ধতি। পেন্ডুলামের রৈখিক আন্দোলনকে এই পদ্ধতিতে একটা গিয়ারের চক্রাকার গতিতে পরিণত করা হয়। ছবিটি Wikipediaর Escapement প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। ঐ প্রবন্ধের এই ছবিটিতে কম্পিউটার মাউজ ক্লিক করলে এর এনিমেশনটা দেখা যাবে।

কোয়ার্তজ ঘড়িঃ
এর পর এল কোয়ার্তজ ঘড়ি। এটা ইলেকট্রনিক ঘড়ি। আধুনিক সস্তা যত হাতঘড়ি আছে তার মূলে রয়েছে একটি কম্পনশীল বৈদ্যুতিক সার্কিট। সেই সার্কিটটি একটি কম্পাঙ্কের তড়িৎ বিভবে কাঁপে। একটা কোয়ার্তজ স্ফটিককে কেটে তার দুই প্রান্তে এই তড়িৎ বিভবটি প্রয়োগ করলে সেই স্ফটিক তার অন্তর্নিহিত একটা কম্পাঙ্কে কাঁপবে। সেই স্ফটিককে এমন ভাবে কাটা সম্ভব যাতে সেই কম্পাঙ্কের পরিমাণ হয় ৩২,৭৬৮, অর্থাৎ সেকেন্ডে সে ৩২,৭৬৮ বার কাঁপবে এবং এই কম্পনশীল বিভবটি পুনরায় আমাদের পূর্বতন কম্পনশীল বৈদ্যুতিক সার্কিটে প্রবেশ করালে সেটি কোয়ার্তজের কম্পনে কাঁপবে এবং সেই অনুযায়ী তরঙ্গ পাঠাবে। আগেই বলেছি এই বৈদ্যুতিক কম্পনের মান ৩২,৭৬৮ যা কিনা ২ কে ১৫ বার নিজেকে দিয়ে গুণ করলে যা পাওয়া যায় তাই (২ x ২ x ২ x ২ x………..২ x ২) । একে আমরা ২১৫ হিসেবে লিখতে পারি। এর পরে একটি সাধারণ ডিজিটাল সার্কিটে ৩২,৭৬৮কে ক্রমাগত ২ দিয়ে ভাগ করতে করতে ১ পাওয়া যাবে, এই ১-ই হচ্ছে এক সেকেন্ড। এই সার্কিট থেকে যে ডিজিটাল সেকেন্ডের সংকেত বা তরঙ্গ পাওয়া যায় তাই দিয়ে একটা বৈদ্যুতিক রিলের মাধ্যমে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার গিয়ারের চক্রাকার ঘূর্ণন পাওয়া যায়। আর যদি পুরোপুরি ডিজিটাল ভাবে সময়কে প্রকাশ করতে হয় তবে একটা LED বা LCD ডিসপ্লে দিয়ে সংখ্যাগুলো দেখানো যেতে পারে। নীচের ওয়েবসাইটে কোয়ার্তজ ঘড়ির সার্কিটের একটা পদ্ধতির একটি চমৎকার এনিমেশন আছে। পাঠক যদি তার মাউজ দিয়ে কার্সারকে ছবিটার ওপর রাখেন তাহলে শুধু যে কোয়ার্তজ কেলাসের কম্পনই দেখবেন তাই নয়, সেকেন্ড, মিনিট ও ঘন্টার কাঁটা ঘোরাও দেখবেন। http://resonanceswavesandfields.blogspot.com/2011/03/understanding-quarz-analog-mechanical.html

কিন্তু তবুও একটা সমস্যা রয়ে গেল, সেকেন্ডের সময়টা কত হবে? আমরা যদি কোয়ার্তজ কেলাসকে সেকেন্ডে ৩২,৭৬৮ কাঁপাই কে আমাদের বলে দেবে সেই সেকেন্ডের পরিমাপটুকু কত হবে? অর্থাৎ সেকেন্ডের সময়টুকুর দৈর্ঘের ব্যাপারে আমাদের একমত হতে হবে। আগেই বলেছি এর জন্য আমাদের জ্যোতির্বিদদের শরণাপন্ন হতে হত, কারণ জ্যোতির্বিদরাই মধ্যরেখার ওপর সূর্যের বা অন্য খ-গোল বস্তুর দুটি অতিক্রমকে ব্যবহার করে সেকেন্ডের মান নির্ধারণ করেন। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে বছরের প্রতিটি দিনে সেকেন্ডের মান এক থাকে না এবং সময়ের সাথে সেকেন্ডের মানও বাড়ে।

বছরের ব্যাখ্যাঃ
১৯৫৬ সনে International Committee for Weights and Measures সেকেন্ডের এই ব্যাখ্যা দিল (আমি একটু সরলীকরণ করে বলছি) – ১৯০০ সালের ট্রপিকাল বছরের ১/৩১৫৫৬৯২৫.৯৭৪৭ ভগ্নাংশকে এক সেকেন্ড বলা হবে। আর ট্রপিকাল বছরটা কি? এটা হচ্ছে একটা বছরের পরিমাপ। জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের পরপর দুবার বসন্ত বিষুববিন্দুকে অতিক্রম করার মাঝখানের সময়টাকে এক বছর বলা হচ্ছে। আর বিষুববিন্দুটি কি? বিষুববিন্দু হচ্ছে আকাশে দুটি কাল্পনিক বৃত্তের ছেদবিন্দু। একটি বৃত্ত হচ্ছে সূর্য আকাশে যে ক্রান্তিবৃত্তে পথ পরিক্রমা করে ও আর একটি বৃত্ত হচ্ছে পৃথিবীর বিষুব রেখার সমান্তরাল আকাশে একটি মহাবৃত্ত যাকে খ-বিষুব বলা যেতে পারে। সূর্য সাধারণতঃ ২০ মার্চ নাগাদ এই বিন্দুটি অতিক্রম করে। ঐদিন সূর্য সরাসরি পূর্ব দিকে ওঠে ও পশ্চিমে অস্ত যায়।

উপরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী একটা বছর হচ্ছে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫.৯৭৪৭ সেকেন্ড। কিন্তু এই সেকেন্ডটা ধ্রুব সেকেন্ড হতে পারল না, কারণ আমরা আগেই বলেছি প্রতি বছর জ্যোতির্বিদ্যার সেকেন্ড শ্লথ হয়ে যায়। আমাদের এখনকার সেকেন্ড ১০০ বছর পূর্বের সেকেন্ড থেকে প্রায় ২০ মিলিসেকেন্ড (০.০২ সেকেন্ড) বড়। কাজেই জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাখ্যায় আমরা সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েই চলেছি। জিপিএস ব্যবহার করে পৃথিবীর বুকে আমাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে যে যথার্থতার প্রয়োজন জ্যোতির্বিদ্যার সেকেন্ড সেটা আমাদের দেয় না। এমন কি জ্যোতির্বিদরা যখন কোন অতি দ্রুত ঘূর্ণনশীল নিউট্রন নক্ষত্র পালসারের আবর্তনের পিরিয়ড জানতে চান তখনও জ্যোতির্বিদ্যার সেকেন্ড দিয়ে কাজ হয় না।

এখানে সময় মাপার যথার্থতা নিয়ে কয়েকটা সংখ্যা জানিয়ে রাখি। সবচেয়ে ভাল যান্ত্রিক ঘড়ি ৬ মাসে ১ সেকেন্ড ফাস্ট বা স্লো হতে পারে। এই ধরনের ঘড়ির দাম কোটি টাকা হতে পারে। কিন্তু ১৯৭০য়ের দশকে বাজারে যে কোয়ার্তজ ঘড়ি আসল সেই ঘড়ি দশ বছরে ১ সেকেন্ড এদিক ওদিক হতে পারে। আমি ৩০০ টাকা দিয়ে একটা কোয়ার্তজ ঘড়ি কিনতে পারি যার যথার্থতা সবচেয়ে দামি যান্ত্রিক ঘড়ির চাইতে ভাল। ব্যাটারি চালিত ঘড়ি সব ঘড়িই এখন কোয়ার্তজের। কারণ এই ঘড়িগুলো বানানো খুব সহজ। আর বর্তমানে সাধারণ পারমাণবিক ঘড়ির যথার্থতা এমনই যে দশ লক্ষ বছরে তারা ১ সেকেন্ড মাত্র এদিক-ওদিক হয়। তবে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে ইতিমধ্যে এমন ঘড়ি তৈরি করতে পেরেছেন যার যথার্থতা এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি বছরে এক সেকেন্ড ফাস্ট বা স্লো হবে।

পারমাণবিক সেকেন্ডঃ
সেই কবে – ১৮৭৯ সালে – লর্ড কেলভিন বলে গিয়েছিলেন বস্তু থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক দিয়ে দৈর্ঘ্য ও সময়ের একক নির্ধারণ করা সম্ভব। কেলভিন যখন এই কথা বলেছেন তখন পরমাণুর গঠন সম্পর্কে কারুর কোন ধারণাই ছিল না। আমি বলব এটা একটা অত্যাশ্চার্য দূরদৃষ্টি। পরমাণুর ইলেকট্রন যখন এক কক্ষপথ থেকে আর এক কক্ষপথে ঝাঁপ দেয় তখন একটি নির্দিষ্ট কম্পনের আলোক তরঙ্গের সৃষ্টি করে। কেলভিনের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ৮০ বছর পরে, ১৯৬০ সনে, General Conference on Weights and Measures সনে এক মিটারের ব্যাখ্যা দেওয়া হল শূন্যস্থানে ক্রিপটন-৮৬ পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট উচ্চ শক্তির অবস্থান থেকে নিম্নশক্তির অবস্থানে যাবার সময় যে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো বিকিরিত হয় তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ১,৬৫০,৭৬৩.৭৩ দিয়ে পূরণ করলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে তাই হচ্ছে এক মিটার। সাত বছর পরে ১৯৬৭ সনে General Conference on Weights and Measures ঘোষণা দিল সিজিয়াম পরমাণু থেকে নির্গত একটি নির্দিষ্ট আলোক তরঙ্গ ৯,১৯২,৬৩১,৭৭০ কাঁপতে যতক্ষণ সময় নেয় সেই সময়টুকু হবে এক সেকেন্ড। আমরা এত হাজার বছর ধরে পৃথিবীর ঘুর্ণনের ওপর ভিত্তি করে যে সময় মাপতাম পারমাণবিক সময় সেটা প্রায় নাকচ করে দিল। সময় প্রবাহের চরিত্র যদি পৃথিবীর বুকে না বদলায় তবে পারমাণবিক সেকেন্ড খুবই অপরবর্তনীয় একটা ধারনা। আমাদের ঘড়ি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবে রাখা পারমাণবিক ঘড়ির সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলে। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনও আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে ঘড়ি ঠিক করি পারমাণবিক সময় সৌরীয় সময় থেকে খুব দূরে যেতে পারল না।

লিপ সেকেন্ডঃ
পারমাণবিক সময়কে UTC (Coordinated Universal Time) বলা হয়। কয়েক বছর অন্তর অন্তরত UTCতে একটা লিপ সেকেন্ড যোগ করা হয়। এটা করা হয় যাতে UTCকে গড় সৌর সময়ের কাছাকাছি রাখা যায়। মনে আছে আমাদের সৌর দিনের কথা? তার ভিত্তিতে যে সময় তাকে UT1 বলা হয়। সময়ের কর্তৃপক্ষরা UTCকে UT1'এর কাছাকাছি রাখতে চান। ১৯৭২ সন থেকে প্রায় ২৪টি লিপ সেকেন্ড UTCতে যোগ করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে দিন এখন ১৯৭২ সন থেকে ২৪ সেকেন্ড বড়। শুধুমাত্র যে সব দিনে ঐ লিপ সেকেন্ডগুলো যুক্ত হয়েছে ঐ দিনগুলো এক সেকেন্ড বড়। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে প্রথম থেকেই পারমাণবিক সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের সৌরীয় সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য থেকে একটু কম ছিল, দ্বিতীয়তঃ দিনের দৈর্ঘ্য যেখানে অল্প করে বাড়ছে, প্রতিদিনের বাড়ার মান যদি ঘড়িতে যুক্ত করা হয় তাহলে খুব শীঘ্রই UT1 UTC থেকে বেশী হবে। যেমন ধরুন দিনের মান যদি এখন ১৯৫০ সনের তুলনায় ০.০০২ সেকেন্ড (২ মিলিসেকেন্ড) বেশী হয়, তাহলে দু'দিনে UTC ০.০০২ + ০.০০২ = ০.০০৪ সেকেন্ড, তিন দিনে ০.০০৬ সেকেন্ড, এবং দেড় বছরে প্রায় ১ সেকেন্ড ফাস্ট চলবে।

মাঝে মধ্যে একটা বাড়তি সেকেন্ড পেয়ে আমাদের হয়তো কোন লাভ নেই, কিন্তু এটা বিভিন্ন কম্পিউটার সিস্টেমে গন্ডগোল পাকিয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন কয়েক বছর অন্তর অন্তর এই লিপ সেকেন্ড যোগ করার কোন দরকার নেই, কারণ লিপ সেকেন্ড না যোগ করলে UTC সৌর সময় UT1 থেকে ১,০০০ বছরে মাত্র এক ঘন্টা ফাস্ট হবে। অর্থাৎ সূর্য যখন মধ্যরেখা অতিক্রম করবে আমাদের ঘড়ি ১২টা না দেখিয়ে দুপুর ১টা দেখাবে। তাতে কি, তারা বলেন, এখন বছরে অনেক দেশই বছরে দু'বার ঘড়ির সময় বদলায়, নিশ্চয়ই মানব সভ্যতা ১,০০০ বছরে একবার করে ঘড়ির কাঁটাতে একটা ঘন্টা যোগ করতে পারবে।


চিত্র ৩. শেষ লিপ সেকেন্ড যুক্ত হয়েছে ২০১২ সনের ৩০শে জুন

তাই বর্তমানে আমরা যে সময় ব্যবহার করছি সেই সময়ের স্ট্যান্ডার্ডে উপনীত হতে বিজ্ঞানীদের অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছে। এই প্রবন্ধে সেই প্রক্রিয়াটার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যার ফলে সময়কে মাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলককে অবহেলা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ঘড়ির কম্পাঙ্ককে স্থিতিশীল রাখতে পারমাণবিক ঘড়ি নির্মাণের ইতিহাসকে বর্ণনা করার আশা রাখি।

দীপেন ভট্টাচার্য : জ্যোতির্বিদ, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড, যুক্তরাষ্ট্র।