পরিবেশ ও ডায়াবেটিস

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Published : 14 Nov 2012, 03:47 PM
Updated : 14 Nov 2012, 03:47 PM

মানবদেহে ইনসুলিন নামক প্রয়োজনীয় হরমোনটির অপ্রতুল নিঃসরণের কারণে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। এ পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।

অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সনাতন সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০ এর উপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না, গাড়িতে চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, যারা নিয়মিতভাবে সুষম খাবার পরিমিত পরিমাণে খান না, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খেতে অভ্যস্ত- তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করলে, মানসিক চাপে, দুশ্চিন্তায়, আঘাতে, সংক্রামক রোগে, অস্ত্রোপচারে এবং গর্ভাবস্থায় এ রোগ বেড়ে যায় । এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে রোগটি প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায় বলে এখন গবেষণায় জানা গেছে।

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে এ রোগ হয়, এ ধারণাও ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম-এর ভাষায় তিনটি মূলমন্ত্রের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অর্থাৎ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ গ্রহণ। গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাবার নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকী বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জিয়নকাঠি।

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা অ-সংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০০৯ থেকে ২০১৩-তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উদযাপন করে। এবারের (২০১২) প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, 'সবার জন্য সঠিক পরিবেশ : ডায়াবেটিস থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করুন।' অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে।

এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রচার-প্রচারণায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের নেই কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন এবং ডায়াবেটিস চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী সবারই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তার থামানো, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সীমিতকরণ। এবারের প্রচার-প্রচারণা মূল তিনটি প্রতিপাদ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, অধিক সংখ্যক রোগী-সুস্থ ব্যক্তি-চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীকে রোগটির নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় সম্পৃক্ত করা এবং রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ক্ষমতায়িত করা।

ভবিষ্যত প্রজন্ম অর্থাৎ আজকের যারা শিশু ও তরুণ তারা যে পরিবেশে বড় হচ্ছে সে পরিবেশকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিশেষ দৃষ্টিসীমায় আনতে চাওয়া হয়েছে এ জন্য যে ওদের উপযুক্ত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ওদের ডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষার কর্মসূচি এখনই শুরু করতে হবে। সুষম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শিশু ও তরুণ সমাজকে ওয়াকিবহাল করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। আর সে শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওরা নিজেরা যাতে এ রোগ প্রতিরোধে সতর্কতা অবলম্বনে আগ্রহী হয়। একই সঙ্গে ওরা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে তাদের সহায়তা করতে পারে। ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য।

২০১২-র বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের মর্মবাণী (১) 'সবার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা', (২)'বর্তমান পরিবেশে জীবনযাপনে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিতকরণ', এবং (৩) 'ডায়াবেটিক রোগীদের সামাজিক ও পারিবারিকভাবে মানসিক চাপ ও বৈষম্যের শিকার সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা, গবেষণা, সংলাপ, প্রকাশনাসহ বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটা সচেতনার আবহ তৈরি করা এবং অবকাঠামো গড়ে তোলা।'

বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার সঙ্গে ডায়াবেটিসের বিস্তারের আন্তঃসম্পর্কটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাতাসে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটার প্রমাণ এখনই মিলছে। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫২ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়ে পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি গ্যাস নিঃসরণ করলেও, দরিদ্র দেশগুলো এর প্রতিক্রিয়া ভোগ করে বেশি। এ অবস্থার প্রতিকার না হলে প্রতি তিন বছরে জিডিপির ৫-২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবেলায়। এর ফলে পুষ্টিহীনতা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার, দারিদ্র ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।

অরিকল্পিত নগরায়নের ফলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখন শহরে বাস করে। এখানে আছে যন্ত্রচালিত পরিবহণ ব্যবস্থা, চলছে বস্তির বিস্তার, শরীরচর্চাবিহীন যাপিত জীবনে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধ জনসম্পদ, হচ্ছে বনজ প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়, প্রাণীজ ও সুষম খাবারের জায়গা দখল করছে কলকারখানায় প্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম অস্বাস্থ্যকর খাবার, পরিবর্তিত হচ্ছে আহার-প্রক্রিয়া, বাড়ছে কৃষির ব্যবসা ও বিপণনে প্রতিযোগিতা। ২০৩০ সালের মধ্যে ৮ বিলিয়ন বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ বিলিয়ন বাস করবে শহরে যাদের ২ বিলিয়নের ঠাঁই মিলবে বস্তিতে। ফলে জীবনযাত্রায় জটিলতা বাড়তেই থাকবে। পাশাপাশি, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নানা অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনার কাছে নতি শিকার করতে বাধ্য হবে।

২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৭ থেকে ৯ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে।। এশিয়া ও আফ্রিকাতেই ঘটবে এর বিস্তার। সার্বিকভাবে বিশ্ব-জনসংখ্যায় প্রবীণের প্রাধান্য বাড়লেও, উন্নয়নশীল দেশে নবীনের সংখ্যা হবে ভারি। জনমিতিতে এমন অসম পরিবর্তন-প্রবণতায় ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণের ফলে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার প্রভাবিত হচ্ছে।। এ পটভুমিতে বর্তমানে বিশ্বে ৩৬৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা অর্ধ-বিলিয়নে দাঁড়াবে।

এখন বছরে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মারা যায়। ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটি হয় তা হল মানুষ কর্মক্ষমতা হারায়। এ রোগের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জন ডায়াবেটিস রোগী বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এ রোগ পরিবারকে অসচ্ছল করে, শ্রমশক্তি বিনষ্ট করে, এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যুদস্ত করে দেয়।

ডায়াবেটিসের বিস্তারের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কারণ ডায়াবেটিসের বিস্তার ও প্রতিরোধে পরিবেশের রয়েছে বিশেষ প্রভাবক ভূমিকা। একুশ শতকে ঘাতক ব্যাধি ডায়াবেটিস ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মানবজাতির জন্য প্রধানতম ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে ঘটে খরা, সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়, অত্যধিক উত্তাপে ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। ওদিকে শরীরচর্চার সীমিত সুযোগ বা শারীরিক শ্রমে বাধাগ্রস্ততাও সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষুধা ও দারিদ্র বৃদ্ধি পায়।

এ অবস্থায় সবাইকে, এমনকি গর্ভবতী নারীদের এমন পুষ্টিহীনতায় পেয়ে বসে যে তাদের গর্ভের সন্তানেরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। যারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভোগেন তাদের ওষুধ, সুষম খাবার সংগ্রহে ও শরীরচর্চায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান লাভ বা খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ে। উন্নয়নের অভিঘাতে নগরজীবনে ব্যস্ততা বাড়ে, হাঁটাচলার পথ সংকুচিত হয়, বাসায় তৈরি সুষম খাবারের চেয়ে ফাস্ট ফুডসহ বাইরের খাবার গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। জীবনের সবকিছুতে একটা কৃত্রিমতা এসে ভর করে। এর ফলে শরীর মেদবহুল ও স্থুলকায় হয়ে যায়– যা ডায়াবেটিস হওয়ার যা একটি অন্যতম কারণ। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও এটি প্রধান সমস্যা।

রিও-২ খ্যাত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে স্বাস্থ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং স্বাস্থ্য-সুরক্ষার বিবেচনাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, স্বাস্থ্যই সুখ বা উন্নয়নের হাতিয়ার। সুতরাং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিধান এবং এর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো উন্নয়নই হবে টেকসই উন্নয়ন।

ডায়াবেটিস যেহেতু মহামারি আকার ধারণ করে জনশক্তির, বিশেষ করে গণউৎপাদিকা শক্তির অপচয় ঘটায় এবং একই সঙ্গে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যয় বাড়ে- সে জন্য এ রোগকে বিশ্ব অর্থনীতি এবং এর উন্নয়নের জন্য অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে।