পরিবর্তনের পথে বিএনপি

সাইমুম পারভেজ
Published : 12 Nov 2012, 02:09 PM
Updated : 12 Nov 2012, 02:09 PM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে চমকের বড়ই অভাব। রাজনীতিবিদরা গৎবাঁধা কথা বলেন, একে অন্যের উপর দোষ চাপান ও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যতটা সম্ভব চেষ্টা করেন, তা জনগণের জানা। দেশের বড় দুটি দলের মধ্যে একটি ভারত-ঘেঁষা ও আরেকটি ভারত-বিরোধী, এমনই ছিল নিয়ম। কিন্তু সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া তার ভারত সফরে ছকে-বাঁধা অনুমানের বাইরে নতুন চমক নিয়ে এসেছেন। ভারত-বিরোধিতার নীতিকে ভুল স্বীকার করে নিয়ে তা পারষ্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন। এ সফরে খালেদা ও তার সফরসঙ্গীদের দেওয়া বক্তব্য শুনলে মনে হয়, এ যেন বিএনপি নয় বরং আওয়ামী লীগেরই কথা। খুব সঙ্গতভাবেই আওয়ামী নেতা ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের মুখের কথা বিরোধীদের মুখে শুনতে খুবই বিস্বাদ লেগেছে, যার প্রতিফলন আমরা খালেদার সফরকালীন ও সফর-পরবর্তী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় দেখতে পাচ্ছি।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক-উন্নয়নের এ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বড় চমকের ইঙ্গিতও কিন্তু পাওয়া যায়। বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোটের মতো ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট নিয়ে যে নতুন করে চিন্তা করছেন তা-ও বোঝা যাচ্ছে। বিএনপির এক নেতা ২ নভেম্বর ২০১২, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় বলেছেন, এতদিন পর্যন্ত জামায়াত ও ঐক্যজোট খালেদাকে ভারত বিরোধী নীতি নিতে প্ররোচিত করেছে কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন তাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসেছেন। পরে সেই নেতা ৪ নভেম্বর একই পত্রিকায় একটি ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তাতে 'তারেক রহমান' সংক্রান্ত অংশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন তিনি। যদিও তাতে উল্লেখিত জামায়াত সম্পর্কে দেয়া বক্তব্য নিয়ে কোন প্রতিবাদ জানান নি তিনি। যাইহোক তার এ বক্তব্য অবশ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। আওয়ামী লীগের ভারতমুখি অবস্থানের বিরুদ্ধে বিএনপি শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল। কিন্তু এই বক্তব্যের মাধ্যমে একটি বিষয় এখন স্পষ্ট যে বিএনপি আর জামায়াতের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সাথে দেখছেনা। যদিও গত ১০ নভেম্বর কক্সবাজারে দেয়া বক্তব্যে খালেদা জানিয়েছেন জামায়াত তাদের সাথে রয়েছে, কিন্তু জোটের মধ্যে ফাটলটা এখন খালি চোখে দেখা যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে কোনও ধরনের সম্পর্ক না রাখে তবে কার লাভ বা কার ক্ষতি। নির্বাচনী ফলাফল ও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা যায় যে, নির্বাচন বা আন্দোলন কোনওটাতেই জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি কখনও লাভবান হতে পারেনি। বরং তা বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো ও জনভিত্তিকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। তাই বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা যদি জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে তা বিএনপিকে আরও শক্তিশালী ও সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য দলে পরিণত করবে। এ লেখার দ্বিতীয় অংশে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

১. খালেদার ভারত সফর
বিএনপির রাজনীতির শুরু থেকেই ভারত-বিরোধিতা একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই ভারত-বিরোধিতা যতটা না বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার জন্য তার চেয়ে বেশি দলকে সংগঠিত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বিএনপি। নির্বাচনে বেশি সমর্থন পেতে ও দলের আন্দোলন চাঙা রাখতে বিভিন্ন সময় ভারত-বিরোধিতা বিএনপির জন্য উল্লেখযোগ্য ফলও বয়ে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই সীমানা-সংক্রান্ত সমস্যা, ট্রানজিট, বিএসএফের অকারণে হত্যার প্রবণতা ( ট্রিগার হ্যাপি এটিচিউড), দু'দেশের বাণিজ্য-বৈষম্য ও ছিটমহল সমস্যা নিয়ে ভারতের অবহেলা ও বড় ভাইসুলভ আচরণ এমনিতেই বাংলাদেশের একটা বড় অংশকে নানা সময় ভারতের উপর বিরক্ত হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে। তাই গঠনের শুরুতেই বিএনপি ভারত-বিরোধিতাকে একটি অন্যতম বৈদেশিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে। দলের নীতির একটি অংশ হিসেবে এতদিন ধরে বিএনপি ভারত-বিরোধিতাকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখে এসেছে।

কিন্তু খালেদা জিয়া হঠাৎ করেই ভারত সফরে গিয়ে ভারত-বিরোধিতার নীতি থেকে সরে এসেছেন। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার উপলব্ধির কথা তিনি সবাইকে 'নতুন করে' জানিয়েছেন। সফরে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বিরোধী দলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। বাংলাদেশের ভূ-খন্ডকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ইসলামি জঙ্গিদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিযেদেন। এছাড়া সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে মেনন আগ্রহ দেখালে খালেদা ভারত, চীন ও অন্যান্য আগ্রহী দেশ মিলে কনসর্টিয়াম গঠনের বিষয়টি স্বাগত জানান।

ভারত সফরে খালেদার সফরসঙ্গী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খান সাংবাদিকদের জানান, তাদের অতীতের ভারত-বিষয়ক নীতি 'ভুল' ছিল এবং তারা এর পরিবর্তনের জন্যই এ সফরে এসেছেন। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এ প্রথম ভারত বিএনপিকে সফরের আমন্ত্রণ জানাল। পুরো সফরেই খালেদাকে বেশে সমাদরে গ্রহণ করে ভারত সরকার। ভারত যে খালেদার এ সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে নিযেছে তা-ও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু সরকারি দলের নেতা ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের কেউ-কেউ খালেদার এ সফরকে 'অগুরুত্বপূর্ণ', কেউ-বা 'দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র' ও 'রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি', কেউ-কেউ 'শিবসেনার সঙ্গে গোপন বৈঠক' বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের এই 'নার্ভাস', হতবিহ্বল ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে এ কথা সহজেই অনুমান করা যায় যে খালেদার এ সফর আওয়ামী লীগের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারত-সংক্রান্ত এ নীতি গ্রহণের আগে দলের ভেতরে ও দেশের বাইরে বিএনপি যে যথেষ্ট আলোচনা ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গেছে তা অনুমান করা যায়। ভারত সফরের আগেই খালেদা চীন সফরে যান এবং চীনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া স্ট্রাটেজিক অ্যানালাইসিস নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে খালেদা লিখেছেন-
'আমাদের দুই দেশেই কিছু শক্তি আছে যারা পারষ্পরিক সন্দেহ ও ভীতি তৈরি করে আমাদের দূরে রাখার চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। তাই আমাদের একসঙ্গে কাজ করে শক্তিশালী, বিস্তৃত, টেকসই ও সহযোগিতার ভিত্তিতে তৈরি বন্ধন গঠন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- যা আমাদের অতীত ভুলিয়ে দেবে এবং আমাদের জনগণের মধ্যে বৃহত্তর বিশ্বাসের জন্ম দেবে।‌' (Bangladesh- India Relations, Challenges and Prospects, Strategic Analysis, September- October 2012)

প্রবন্ধের শেষ অংশে 'ভারতের জনগণের প্রতি বার্তা' শিরোনামে তিনি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার কথা বলেন। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে শান্তি স্থাপন ও আলোচনার মাধ্যমে নিজ-নিজ স্বার্থরক্ষার উপর জোর দেন তিনি।

ভারত-বিরোধিতা থেকে সরে আসার এ নীতিকে বিএনপিরও অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিএনপি যেহেতু ভারতকে এতদিন ধরে তাদের শত্রুজ্ঞান করে নানা ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে এসেছে, তাই এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে দলের নেতা-কর্মীদের মানসিকতায়। এর প্রভাব আসন্ন নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে তাদের ধারণা। কিন্তু বিএনপির এ সিদ্ধান্তকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব, এতে বিএনপির কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ, আওয়ামী লীগ এমনিতেই ভারতের মিত্র হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগের সরে আসার কোনও উপায় ও যৌক্তিকতা নেই। তাই কেউ যদি শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কী-রকম হবে সে ভিত্তিতে ভোট দেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিই বেশি পছন্দনীয় হবে, কারণ এখনও আওয়ামী লীগই বেশি ভারত-ঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। তাই এ ইস্যুতে বিএনপি-সমর্থকরা খুব বেশি হলে কিছুটা ক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু সমর্থন পরিবর্তনের কোনও সুযোগ তাদের হাতে নেই। বিএনপির ভারত-নীতির পরিবর্তন তাই একটি 'উইন-উইন' সিচুয়েশন, এখানে বিএনপির হারানোর কিছুই নেই।

২. বিএনপি-জামায়াত জোট: কার লাভ কার ক্ষতি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতকে নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। প্রধান দুটি ভুল ধারণা হচ্ছে, জামায়াতের একটি শক্তিশালী ভোটব্যাংক রয়েছে যা বিএনপিকে নির্বাচনে আসন জিততে সাহায্য করে এবং জামায়াতের অর্থ ও সাংগাঠনিক সক্ষমতা রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করে। নির্বাচনের ফলাফল ও জামায়াতের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে এ দুটি ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়। এমনকী জামায়াতকে জোটে নিয়ে বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক সক্ষমতা, সাংগাঠনিক কাঠামো ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা যে দিন-দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে তা-ও স্পষ্ট হয়ে উঠে। জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের লালন ও জামায়াতকে সুসংগঠিত হয়ে উঠার দায়ভারও বিএনপির কাঁধে এসে পড়ে। তাই বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক বামপন্থী ও উদারতাবাদীদের দল হওয়া সত্ত্বেও কিছু কট্টর ইসলামপন্থী নেতার কারণে আওয়ামী লীগ বেশ সফলভাবে বিএনপির গায়ে দেশবিরোধী তকমা সেঁটে দিতে সক্ষম হয়। যদিও জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় করে তুলতে বিএনপির সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের দায়ভারও কম নয়।

কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ছাড়া জামায়াতের যে উল্লেখযোগ্য ভোটব্যাংক নেই তা নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে। ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জামায়াত ১৮টি আসন( মোট ভোটের ১২.১%), ৭ম নির্বাচনে (১৯৯৬) ৩টি আসন( ৮.৬২%), ৮ম নির্বাচনে (২০০১) ১৭টি আসন(৪.২৮%) ও সর্বশেষ ২০০৮ এর নির্বাচনে ২টি আসন ও ৪% এরও কম সমর্থন পায়। বিএনপির সঙ্গে জোটে না থাকলে জামায়াত কতটা অসহায় তা বোঝা যায় ১৯৯৬ সালে। অতি-আত্মবিশ্বাসী জামায়াত এ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের সবকটিতে প্রার্থী দেয় ও মাত্র ৩টি আসনে জিতে। বিএনপির সমর্থনপুষ্ট জামায়াত ২০০১ এ ১৭টি আসন নিয়ে শক্ত অবস্থানে ফিরে আসে এবং মন্ত্রীসভায়ও জায়গা করে নেয়।

বাংলাদেশে বেশ কিছু নির্বাচনী আসন রয়েছে যেখানে প্রধান দুই দলের মধ্যে দশ বা পনেরো হাজারের মতো অল্প ব্যবধানে জয়ী নির্ধারিত হয়। অনেকেই ধারণা করে থাকেন জামায়াতের সমর্থন এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, জামায়াতের উপর অতি-নির্ভরশীলতা বিএনপির নিজেদের রাজনৈতিক প্রচারণা ও সংগঠনকে ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্বল করে ফেলে। এছাড়া, সিদ্ধান্ত না নেয়া সুইং ভোটাররা অনেক সময়ই শুধু জামায়াতের সঙ্গে জোটে থাকার কারণেই বিএনপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়। জামায়াতের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক ও জামায়াতবিরোধী সুইং ভোটারদের সংখ্যার মধ্যে তুলনা করলে সুইং ভোটারদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হওয়ার কথা। জামায়াতের নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনশীল ভোটব্যাংক যদি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারকই হত তবে ২০০৮ এ বিএনপির ভরাডুবি ঠেকাতে তা কাজে লাগতে পারত। বাস্তবে তা হয়নি। কারণ দেশব্যপী সামগ্রিক বিচারে জামায়াতের সমর্থকদের সংখ্যা বড়ই নগণ্য। তাই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আখেরে বিএনপির কোনও লাভ হয়নি, বরং লাভ যদি কারও হয়ে থাকে তা জামায়াতেরই হয়েছে।

নির্বাচনী গুরুত্বের পাশাপাশি সাংগঠনিক শক্তি হিসেবেও জামায়াতকে বাস্তবের তুলনায় বাড়িয়ে দেখা হয়। এ কথা সত্য যে, জামায়াত একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ও ক্যাডারভিত্তিক দল। কিন্তু বিএনপির দাবি আদায়ের জন্য জামায়াত কি রাজপথে খুব উল্লেখযোগ্য কোনও অবদান রাখতে পেরেছে? বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতা ও জনমনে অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও বড় ধরনের আন্দোলনে কি তাদের দেখা গিয়েছে? ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের চেয়ে পুলিশের উপর জামায়াত-শিবির কর্মীদের অহেতুক আক্রমণাত্মক মনোভাব বরং সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জামায়াতের চেয়ে নানা ধারায় বিভক্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থী ছোট দলগুলোকেই বেশি সক্রিয় দেখা গিয়েছে। তাই জামায়াত সাংগঠনিকভাবে বিএনপির সরকার-বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছে- এমন দাবি বাস্তবসম্মত নয়।

বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রচারণার মূল চালিকাশক্তি ছাত্রদল। আশির দশকে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন ও নব্বইয়ে দল সংগঠিত করতে ছাত্রদল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ছাত্রলীগের মতোই ছাত্রদলের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও হত্যার নানা অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নামে ছাত্রদল হলেও এটি বয়স্ক ও অ-ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাড়ায়-মহল্লায় বিএনপিকে একটি শক্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাতে ছাত্রদল বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে।

কৌশলগত কারণে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ মেনে নিলেও ছাত্রদল কখনওই ছাত্রশিবিরকে মিত্র হিসেবে দেখেনি। অধ্যাপক ভুঁইয়া মনোয়ার কবিরের 'পলিটিক্স এন্ড ডেভলপমেন্ট অব দ্য জামায়াত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ' গ্রন্হে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু মার্চ ১৯৯১ থেকে মে ১৯৯৬ পর্যন্ত ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের মধ্যে ২০টি সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘটিত একটি বড় ধরনের রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর খোদ বিএনপি নেতারা ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্য সংসদে দাবি তুলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেও দু:খজনক হলেও সত্যি, নব্বইয়ের দশকে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির সংঘর্ষের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে ও শিবিরকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। যে কারণে পরবর্তীতে ১৯৯৬ এ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দেখা যায়। এভাবে প্রধান দুটি দলই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈধতা দেয়।

বিএনপি দাবি করে জামায়াতের সঙ্গে জোট আদর্শগত নয় বরং কৌশলগত। কিন্তু যদি নির্বাচন ও সরকার-বিরোধী আন্দোলনে জামায়াত উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকা না রাখতে পারে, তবে তা বিএনপির জন্য একটি বড় বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্য অভিযুক্ত। তাই বিএনপি তার গা থেকে 'যুদ্ধাপরাধী লালনের' গন্ধ ঝেড়ে ফেলতে পারলে আওয়ামী লীগের মতোই 'গ্রহণযোগ্যতা' পাবে। বাংলাদেশের ভোটারদের একটা বড় অংশ তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং প্রযুক্তি-বান্ধব। এ তরুণ ভোটাররা বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এদের বিরুদ্ধে যেমন 'দেশবিক্রি'র দোহাই দেওয়া সহজ নয়, তেমনই তাদের সামনে 'মুক্তিযুদ্ধ'কে দলীয় সম্পত্তি হিসেবে উপস্থাপন করাও কষ্টকর।

তাই বিএনপির দরকার একটি নতুন শুরুর– যেটি কেবল জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার মাধ্যমেই ওরা করতে পারে।

সাইমুম পারভেজ: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।