স্মরণের বালুকা বেলায় খুঁজে ফিরি যাকে

শারমিন আহমদ
Published : 2 Nov 2012, 03:42 PM
Updated : 2 Nov 2012, 03:42 PM

৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে যতবারই লিখতে বসেছি, ততবারই এই উপলব্ধি হয়েছে যে প্রিয়জনের বিচ্ছেদ বেদনা হাজারো নতুন সৃতির মাঝেও চির অম্লানই থাকে। বেদনা বিজড়িত ঐ স্মৃতিটিকে আমরা অশ্রু দিয়ে গড়া কোন স্মৃতির বাক্সে সংগোপন রেখে দেই। যেন অতলান্তিকের গভীরে লুকানো কোন মুক্তা এমনি ভাবে সেই প্রিয়জনের স্মৃতি স্থান পায় হৃদয়ে। শ্রান্তিহীন সময়ের কোন এক মুহূর্তকে বন্দী করে যখন খোলা হয় বাক্সটি এবং সৃতির কুয়াশা দূরীভূত হয়, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখি বেদনা কেমন সতেজ ; বিচ্ছেদের অশ্র আজো বহমান!

৩ নভেম্বর, ১৯৭৫, জাতি হারায় তার চার সুযোগ্য সন্তানকে। প্রথম বাংলাদেশ তথা মুজিব নগর সরকারের মূল নেতৃত্ব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবু হেনা কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীকে জেলখানার অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরা হয় পুরস্কৃত- বিচারের বাণী কেঁদে চলে নিভৃতে।

১৫ অগাস্ট, ১৯৭৫, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ড ও জেল হত্যাকান্ড কোন বিছিন্ন ঘটনা ছিলনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ও মুজিব নগর সরকারবিরোধী পরাজিত শক্তিরা প্রতিশোধ নেয় নানা প্রকার ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার মাধ্যমে। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল মুজিব-তাজউদ্দীন জুটির মধ্যে ভাঙ্গন ধরানো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রেরণা আর তাজউদ্দীন ছিলেন সেই স্বাধীনতা স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ক। শত বছরের সংগ্রামের এক স্বর্ণালি লগ্নে এই নবীন জুটির আবির্ভাব বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে। তারা পরিকল্পনা করতেন একত্রে, এবং বাস্তবায়ন করতেন কাধে কাঁধ মিলিয়ে । তারা ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট সুশাসন ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিবর্তিত করার জন্য বড় প্রয়োজন ছিল তাদের যৌথ নেতৃত্বর। মুজিব বাদে তাজউদ্দীনের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি তাজউদ্দীন বাদে মুজিবের। ৬ দফার অন্যতম রূপকার, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মূল সংগঠক-পরিচালক, ন্যায়নীতিতে অটল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তাজউদ্দীন যেন ছিলেন মুজিবের বর্ম স্বরূপ। প্রতিবিপ্লব ঘটানোর জন্য এবং দেশী-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে তাই তাজউদ্দীনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া ছিল অপরিহার্য। আশ্চর্য ব্যাপার হোল যে ইতিহাসের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি জাতীয় পরিসরে এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচিত হয়নি। আমাদের সুশীল সমাজের অধিকাংশই বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছেন। অথচ এই অধ্যায়টির উপর আলোকপাত হওয়া উচিৎ ছিল কোন বাক্তিবিশেষের ওপর কটাক্ষ করার জন্য নয় বরং ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহণ, ভবিষ্যতে সঠিক পথটি বেছে নেয়ার জন্য ; যে পথে চলবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম- তাদেরই জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ইতিহাস কারো গুণ গাঁথা গাইবার জন্য নয়। ইতিহাস সত্য প্রকাশের জন্য।

৭৪ সালের শুরু থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ ওনার স্ত্রীকে বলতেন " তুমি বিধবা হতে চলেছ। দেশটা যে ভাবে চলছে মুজিব ভাই বাঁচবেন না, আমরাও কেউ বাঁচবনা, দেশটা চলে যাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে"। ৭৪ এর ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন আহমদ, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মন্ত্রীসভা হতে পদত্যাগ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রখ্যাত চরমপত্রের রচয়িতা এবং পাঠক এম আর আক্তার মুকুল এ প্রসঙ্গে বলেন " মন্ত্রিসভা হতে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন, যেন বঙ্গবব্ধুর কোমর হতে শানিত তরবারি খসে গেল। "

৭৫ এর জুলাই মাসের কোন এক রাতে, তাজউদ্দীন আহমদ ঘরে লুঙ্গি গেন্জি পরা অবস্থায় সংগোপনে, তার ধানমন্ডির বাসা থেকে ৩২ নাম্বার রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। তখন রাত প্রায় ১১ টা বাজে। বঙ্গবন্ধু তখন শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ওনাকে সতর্ক করে বলেন যে "মুজিব ভাই, আপনি অবিলম্বে আর্মির ইন্টেলিজেন্সের গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, কোন একটা ভয়ানক প্ল্যান ম্যাচিউরড হতে যাচ্ছে, এই খবর আমি পেয়েছি। আপনি আমার এই কথাকে কোনভাবেই হালকাভাবে নেবেন না।" বঙ্গবন্ধু গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে তাজউদ্দীনকে আশ্বাস দিলেন দুশ্চিন্তা না করার জন্য।

১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর তাজউদ্দীন আহমদ আর্তনাদ করে বলেছিলেন "বঙ্গবন্ধু জেনে গেলেন না কে বন্ধু আর কে শত্রু"। বঙ্গবন্ধু এবং জেল হত্যাকান্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার খন্দকার মোশতাক তখন রাষ্ট্রপতির পদে এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আর্মির দলছুট অংশটিকে তিনি সম্ভাষণ করছেন "সূর্য সন্তান" বলে।

১৫ অগাস্ট সকাল সাড়ে নটার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারসহ গৃহবন্দী হন। তার আগে বেগম জোহরা তাজউদ্দীনসহ বহু শুভাকাংখী তাকে বাড়ি ত্যাগ করতে বলেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ফোন করে বাসা থেকে চলে যাবার অনুরোধ জানান। কিন্তু উনি কেমন নিজেকে নিয়তির হাতেই সমর্পণ করে দিলেন। ২২ অগাস্ট যখন ওনাকে বাড়ি থেকে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আম্মা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে কবে ছাড়বে মনে হয়। উনি চলে যেতে যেতেই হাত নেড়ে বলেছিলেন " টেইক ইট ফরেভার"।

আজ এই রচনাটি লিখতে লিখতে আমি আলোড়িত হৃদয়ে স্মরণ করছি বাবা তাজউদ্দীনের অমর সৃতিকে। যিনি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে বহু অগ্রসর এক নির্মলচিত্তের ভিন্ন মার্গের রাজনীতিবিদ- রাষ্ট্রনায়ক। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি জেলখানার নর্দমা ভরাট করে বুনেছেন অজস্র ফুলে ঘেরা বাগান-যেন ওর মাঝেই দিয়ে গেছেন এক বিপুল বারতা-" টু প্ল্যান্ট এ গার্ডেন ইজ টু বিলিভ ইন টুমরো"।

(২৯ অক্টোবর,২০১২। কোস্টারিকা।)

শারমিন আহমেদ
: বাংলাদেশের প্রখম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বড় কন্যা।