নোবেল পুরস্কার ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার

এ. এম. হারুন-অর- রশিদ
Published : 5 March 2015, 08:06 PM
Updated : 16 Oct 2012, 04:53 PM

পদার্থবিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন দুজন কোয়ান্টাম তত্ত্ববিজ্ঞানী। একজন ফরাসী, সার্জ হ্যারোশ। অন্যজন আমেরিকান, ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড। তারা এই পুরষ্কারটি ভাগ করে নিয়েছেন তাদের যে কাজের জন্যে তার মধ্যে রয়েছে আলোক-কণা বা ফোটন নিয়ে এক বিশেষ গবেষণা। অক্টোবরের ৯ তারিখে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল তাদের দেওয়াটাই যথার্থ হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ তাঁরা নতুন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র কণাদের আশ্চর্য-জগতে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা যাবে। তাছাড়া এর ফলে অতিদ্রুত কাজ করতে সক্ষম এমন কম্পিউটারের প্রজন্ম তৈরির কথাও এখন চিন্তা করা যাচ্ছে।

১৯৯০-র দশকে সার্জ হ্যারোশ নিজ দেশ ফ্রান্সে এবং ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নতুন একধরনের পরীক্ষণের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছেন দু'বিজ্ঞানী। প্রাতিশ্বিক পরমাণু বা ফোটন নামের আলোককণার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই কেমন করে প্রাতিস্বিকভাবে এদের দেখা যায় সেটাই তাঁরা দেখিয়েছিলেন।

কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান প্রায় এক শতকের পুরনো এক বিজ্ঞান। এ বিজ্ঞান প্রকৃতির অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু প্রাতিশ্বিক বিচ্ছিন্ন কণাগুলোর মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপারও রয়েছে। এই কণাগুলো আমাদের সাধারণ ধারণার বিরোধিতা করে। যেমন, 'এটা' অথবা 'ওটা।' দেখা যায়, এই কণাগুলোকে কখনও মনে হয় 'এখানে,' কখনও 'ওখানে' অবস্থান করছে। কখনও মনে হয় 'দু জগায়গাতেই' রয়েছে। কখনও মনে হয় কণাগুলো 'ঘড়ির কাঁটার দিকে,' কখনও যেন 'বিপরীত দিকে' ঘূর্ণমান। কখনও মনে হয় 'দু'দিকেই' ঘুরছে। যখন এই কণাগুলোকে মাপা যায় কেবল তখনই এগুলো বিশেষ 'স্থান' বা 'ঘূর্ণন' পায়।

মজার বিষয়, নোবেলজয়ী দু'বিজ্ঞানীই সমবয়সী। ৬৮ বছর বয়স দুজনের। হ্যারোশ প্যারিসের কলেজ ডি ফ্রান্স এবং ইকোল নরমাল সুপেরিয়ারের অধ্যাপক। আর ওয়াইনল্যান্ড হলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি এবং কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ। রয়েল সুইডিশ একাডেমি তাদের পুরষ্কার দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছে এভাবে- ''তাঁরা একটি চমৎকার উদ্ভাবনকুশলী পরীক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করেছেন যা দিয়ে ভঙ্গুর কোয়ান্টাম অবস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনা, পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।'' ওয়াইনল্যান্ড আয়ন বা বিদ্যুতায়িত অণুগুলোকে আবদ্ধ করে আলোককণা দিয়ে পরিমাপ করেছেন। অন্যদিকে হ্যারোশ ফোটনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাপ করেছেন।

তাই সুইডিশ একাডেমির মতে,''তাঁদের উদ্ভাবিত যুগান্তকারী পদ্ধতির সাহায্যে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সুপার-ফাস্ট কম্পিউটার তৈরির গবেষণা অতিদ্রুত এগিয়ে যাবে। এই গবেষণার সাহায্যে অত্যন্ত নিখুঁত ঘড়ি তৈরির সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে যে ঘড়ি ভবিষ্যতে সময়ের নতুন মানের ভিত্তি তৈরি করবে।''

দু'বিজ্ঞানী নিজেরাও নিজেদের উদ্ভাবনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। হ্যারোশ জানিয়েছেন, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জগতে তাঁর গবেষণা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির কম্পিউটার তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করবে। ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার নীতি মেনে যে সব কাজ করা যায় না এর সাহায্যে তা করা যাবে।'' তিনি আরও বললেন যে, কোয়ান্টাম গবেষণা জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেমকে আরও নিখুঁত করবে।

ওয়াইনল্যান্ড মনে করেন, আগামী দশক বা পরের আরও কিছু দশক নতুন প্রজন্মের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দশক হয়ে উঠবে। তখন এ কম্পিউটারের সাহায্যে এমন সব সমস্যার সমাধান করা যাবে যেগুলোর সমাধান আমাদের এখনকার কম্পিউটারের জন্য অসম্ভব। তবে মজা করে তিনি বলেছেন, ''তাই বলে আমি এখনই কাউকে কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানির স্টক কিনতে বলব না…. তবে আমরা আশাবাদী।''

নোবেল পুরস্কার কমিটির বিচারকরাও মনে করেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে যা গত শতাব্দীতে চিরায়ত কম্পিউটার করতে পেরেছিল। তবে পরিপূর্ণ কোয়ান্টাম কম্পিউটার পেতে আমাদের এখনও কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। পুরস্কার কমিটির সচিব লার্স বার্গস্ট্রম বলেছেন, ''এই কম্পিউটারের গণনা হবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির ও নিখুঁত; একে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন এমনকী পৃথিবীর জলবায়ু পরিমাপের কাজেও।"

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়েন্ট কোয়ান্টাম ইন্সটিটিউটে একই ধরনের গবেষণা করেছেন ক্রিষ্টোফার মনরো। তিনি বলেছেন যে, তিনি এবং ওয়াইনল্যান্ড ১৯৯০-র দশকে একটি পরমাণুকে একইসঙ্গে দুটি জায়গায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে ওই সময়ে এটা পরিস্কার হচ্ছিল না যে একক পরমাণুটিকে আবদ্ধ করা গেলে 'সুপার-ফাস্ট' কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা যাবে।

সাধারণ কম্পিউটারে তথ্যকে 'বিট'-এর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিটি বিট হয় 'শূণ্য', অথবা 'এক।' কোয়ান্টাম কম্পিউটারে যে কোনও একক কণা একই সময়ে 'শূণ্য' এবং 'এক' হতে পারে। বিজ্ঞানীরা যদি এ ধরনের কণাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করাতে পারেন তাহলে যে গাণিতিক পদ্ধতি তৈরি হবে তার গতি হবে অবিশ্বাস্য দ্রুত।

আগামী দিনগুলো হোক কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার এ সম্ভাবনা নিয়ে আমি নিজেও কিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার একটি বইতে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে গবেষণা করে দু'বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বলে আমার খুবই ভালো লাগছে। কোয়ান্টামের জগত আসলে যেমন জটিল, তেমন মজারও। অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞান-পাঠক যদি বিষয়গুলো জানতে চেষ্টা করেন, তবে বুঝতে পারবেন ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যাকে ছাপিয়ে আগামী দিনগুলো হয়ে উঠবে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার যুগ।

আরও দেখুন:
(১) তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতি ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার, এ. এস. হারুন অর রশীদ, বিজ্ঞান সমগ্র, অনুপম প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ।

এ.এম হারুন-অর-রশীদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানলেখক।