সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ত্বের সংকট এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা

বৃন্দলেখক
Published : 11 Oct 2012, 05:00 PM
Updated : 11 Oct 2012, 05:00 PM

দেশের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলো বিপদগ্রস্ত। এই বিপদ হলো আত্মপরিচয়ের বিপদ। এই সংকট সৃষ্টির পেছনে আছে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তর্গত শক্তিশালী মেকানিজম।
রামু, টেকনাফ, পটিয়া, উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দির, বিহার ও বসতিতে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর আগেও আরো অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে যেগুলো পত্রপত্রিকায় কম প্রচার পেয়েছে। কিছুদিন আগেই দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দুদের বসতি্‌ ও উপাসনালয়ের উপরে হামলা হয়েছে। এ-বছরের মার্চ মাসে সাতক্ষিরাতে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি, মন্দিরে আক্রমন করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা হয়েছে। রাঙ্গামাটি এবং কক্সবাজারেও সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে, প্রথম আলোর (২২/০৯/২০১২) খবর মারফত আমরা জানতে পেরেছি যে ২০০১-২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে ৯ লক্ষ (জনসংখ্যা ৯.২% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫%)

এই একই সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে 'আদিবাসী' বিষয়ে একটি বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আর ২০১২ সালে আদিবাসী দিবস পালনেই রাষ্ট্রযন্ত্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। মাঠে নেমেছে প্রতিক্রিয়াশীল-রক্ষণশীল বাঙ্গালি প্রতিনিধিত্বকারী, যারা বাঙ্গালি জাত্যাভিমানকে আধিপত্যবাদী মনোভাবের মাধ্যমে প্রয়োগ করছে। এই বলয়ের মূল ভাবনা হলো- এই রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে কোন 'আদিবাসী' নেই। পাহাড় আদিবাসীদের নয়, জুম আদিবাসীদের নয়। এসব জায়গায় বাঙ্গালিদের "সম-অধিকার" নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরণের মানসিকতা যারা পোষণ করছে তাদের কাছে '১৯৯৭ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি' একটি অন্যায় দলিল। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এই গোষ্ঠীর লোকজন যেসব তথ্য-উপাত্ত হাজির করছে সেগুলো ভ্রান্তিপূর্ণ। ঐতিহাসিক ও নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে না গিয়ে, সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ধার না ধেরে, এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীরা আক্রান্ত করছে আদিবাসী নাগরিকদের।

জাতিসংঘ, আইএলও কনভেশনশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র অনুযায়ী 'আদিবাসী'র যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে সেই অনুসারে কোনমতেই বাঙ্গালি জনগণ 'আদিবাসী' নয়। বাঙ্গালি হিসেবে আমরা কোনভাবেই 'আদিবাসী' পরিচয় ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারি না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে যদি তাদের জাতি সংস্কৃতিগত বৈশিষ্টকে, ভাষার চর্চাকে অটুট রাখা সম্ভবপর না হয়ে থাকে, তাহলে আমরাই এই পরিণতির জন্য দায়ী। কাপ্তাই প্রকল্প থেকে শুরু করে পাহাড়ে বাঙ্গালি বসতি গড়ে তুলে আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আঘাত করেছি। প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, বন কেড়ে, ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে যুগ যুগের ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছি। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে আধিপত্যবাদী বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর দুর্বৃত্ত চক্র নানা সময়ে আদিবাসীদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আজ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাদের 'আদিবাসী' পরিচয়টি।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন ২০১২ এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (২৩ এর 'ক' ধারা: "ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী") আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎকে হুমকীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বৈচিত্রের মধ্যে বসবাস আমাদের। অথচ আমাদের সংবিধান সবাইকে বাঙ্গালি বানাতে চায়! কি ভয়াবহ! বাঙ্গালি ভাষার স্বীকৃতি পায়নি বলে লড়াই করেছে। নিপীড়িত হয়েছে বলে স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আর এই জাতিই আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে অন্যান্য জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারেনি এই চল্লিশ বছরে!

আজ যখন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ১৫ বছর বিলম্বিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি, সংবিধানের মধ্যে জায়গা খুঁজছে, তখন সম-অধিকার আন্দোলনের নামে পার্বত্য অঞ্চলে চলছে স্বার্থান্বেষী মহলের কর্মকান্ড। যারা নিপীড়নবাদী মানসিকতা নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় সংকট তৈরি করছে, সংখ্যায় তারা কম কিন্তু প্রভাবশালী। এরা তারাই, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিয়েছে। এরা তারাই যারা, বাঙ্গালি সেটলারদের পাহাড়ে জোরপূর্বক আধিপত্য স্থাপন করেছেন গর্বিত বোধ করে। এরা তারাই যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে গত ১৫ বছর ধরেও বাস্তবায়িত করতে দেয় নাই। দেশে যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে, তখন আদিবাসী জনগণের প্রতি যে নির্মম অত্যাচার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়েছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে না কেন?

পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী আর বাঙ্গালি জনগণের ঐক্য-সংহতি স্থাপন করা অতি জরুরি। আত্মপরিচয় কেড়ে নিয়ে আমরা সেই ঐক্য-সংহতি ধবংস হতে দিতে পারি না। আমরা দাবি করি বৈচিত্র-বৈভবে সবাই একসাথে বাঁচি। সকলের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হোক। ১৫ বছরের পুরোনো পার্বত্য শান্তি চুক্তি (১৯৯৭) অবিলম্বে বাস্তবায়ন হোক। সকল জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হোক।

লেখকবৃন্দ
১. সারা হোসেন, আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট।
২. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি।
৩. আমেনা মহসীন, শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
৪. গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. নাঈম মোহায়মেন, সম্পাদক, 'চিটাগাং হিল ট্রাকস্ ইন দি ব্লাইন্ড স্পট অফ বাংলাদেশ ন্যাশনালিজম।
৬. মেসবাহ কামাল, মহাসচিব, আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন।
৭. মানস চৌধুরী, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
৮. মির্জা তাসলিমা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৯. সায়েমা খাতুন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১০. সাদাফ নুর-এ ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১১. সাঈদ ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১২. জোবাইদা নাসরীন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৩. মাহমুদুল সুমন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৪. স্বাধীন সেন, সহযোগী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৫. নাসরীন খন্দকার লাবনী, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৬. শিরিন লিরা, আইনজীবী।
১৭. জান্নাত-ই-ফেরদৌসী, সাধারন সম্পাদক, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ (আরডিসি)।
১৮. হানা শামস্ আহমেদ, লেখক।
১৯. সঞ্জীব রায়, গণমাধ্যমকর্মী।