কার ইন্ধনে হলমার্ক নতুন ছুতা বের করছে?

চিন্ময় মুৎসুদ্দী
Published : 9 Oct 2012, 01:45 PM
Updated : 9 Oct 2012, 01:45 PM

তানভীর মাহমুদ গ্রেফতার হওয়ার আগে চার শ কোটি টাকা নগদ জমা দেয়া ও এক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি (জমি) বন্ধক রাখার প্রস্তাব দেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী কেউ কেউ মামলা না করে আপোষের মাধ্যমে টাকা আদায় করার পক্ষপাতি ছিলেন। তাদের আরো পরামর্শ ছিল প্রয়োজনে সোনালী ব্যাংক ও সরকারের ছাড় দেয়া। হলমার্ক-এর জাল যে অনেকটা বিস্তৃত এধরনের পরামর্শ থেকেই তা স্পষ্ট হয়। যে জমি বন্ধক রাখার কথা বলা হয়েছে সেইসব জমি আসলে কার? কে তা যাচাই করবেন?৯ মে ২০১২ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন অভিযোগ করে সাভারের হেমায়েতপুরে জনতা হাউজিং আবাসিক এলাকায় হলমার্ক গ্র"প অবৈধভাবে পুকুর, লেক ও চলাচলের রাস্তা দখল-ভরাট করে শিল্প কারখানা স্থাপন করছে। জানা যায় সাভারে জনতা হাউজিং'র মালিক আবদুল কবিরের সঙ্গে যোগসাজসে প্লটগ্রহীতাদের কয়েকশ' বিঘা জমি জোর করে দখল করেছে হলমার্ক। প্লটগ্রহীতাদের জমি আব্দুল কবির নিজের বলে দেখিয়ে তা হলমার্ককে হস্তান্তর দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ হলমার্ক পদে পদে জালিয়াতি করেছে। এর বাইরে আরো জমি জবরদখল করেছে হলমার্ক। ঢাকার ছবি কার হাসি কে হাসে'র আদলে তাই প্রশ্ন ওঠে 'কার জমি কে বন্ধক দেয়?'

অনেকের মনে আছে মেয়াদ উত্তীর্ণ দুই হাজার টাকার বৈধ ঋনের জন্য কয়েকবছর আগে মুক্তিযোদ্ধা ৬০ বছরের কৃষককে কোমড়ে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যায় করিৎকর্মা পুলিশ। অথচ ঋনের নামে ২ হাজার ৬শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লোপাট করে দিয়েও তানভীর আহমদরা প্রায় কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে হম্বি তম্বি করেন। এই আমার দেশ। বহু বছর আগে ঢাকা বিশাববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী স্বৈরাচারি এরশাদের ছাত্র সমাজের সন্ত্রাসীদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর প্রশ্ন করেছিলেন কিসের বিচার চাইবো ? সেই সন্ত্রাসীদের রক্ষা করেছিল সরকার। বিচার দেরি হলে ফরিয়াদি বিচার পায় না। একই সাথে অপরাধীও পার পেয়ে যায়। দুদকের শম্বুক গতির জিজ্ঞাসাবাদ সময়ক্ষেপন বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। অর্থমন্ত্রীর অতিকথন অপরাধীদের উৎসাহ যুগিয়েছে। বিশেষ করে 'সোনালী ব্যাংক'র পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের অনুরোধ করে চিঠি লেখার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই', এবং 'চার হাজার কোটি টাকা কোনো বড় ব্যাপার নয়' মন্তব্য দুটি সব মহলে সমালোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫, ৪৬ ও ৪৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই ক্ষমতা তার আছে।

এরই মাঝে সংসদীয় উপ-কমিটির কাছে জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন তানভীর মাহমুদ। একই সঙ্গে সংসদীয় উপ-কমিটির তলব করা নথিপত্র ও তথ্যাবলী পেশ করার জন্য এক মাস সময় চেয়ে আবেদন করেছেন যা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। এটাও টালবাহানার নতুন ফন্দি। এই প্রেক্ষাপটে তানভীর মাহমুদ গ্রেফতার হয়েছেন দুদকের করা মামলায়। তাকে ও তার ভায়রা হলমার্ক'র মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদকে ২৯ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পুরো ব্যাপারটায় অতিরিক্ত সময়ক্ষেপন হয়েছে বলেই মনে হয়। বারবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে আত্মসাতের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরও পাঁচ মাস ধরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান হলমার্কের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। সোনালী ব্যাংকের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের কাউকে এ লেখা শেষ করা পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি।

সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আচরণও ঘোলাটে। একবার এমডি বললেন তারা মামলা করবেন। সাংবাদিকরা থানায় গিয়ে অপেক্ষা করলেন। বলা হল মামলা হবে পরদিন। পরদিন সাংবাদিকদের বলা হল মামলা সোনালী ব্যাংক করবে না, দুদক করবে। ক'দিন পর দুদক জানাল টাকা ফেরৎ পাওয়ার মামলা করতে হবে সোনালী ব্যাংককে। দুদক মামলা করবে দুর্নীতির প্রমান পেলে। ৪ অক্টোবর দুদক হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সোনালী ব্যাংক হলমার্ককে চিঠি দিল ১৫ দিনের মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা ফেরৎ দিতে হবে। হলমার্ক চিঠির কোনো পাত্তাই দিল না। হলমার্কের দপ্তর থেকে সোনালী ব্যাংকের শত শত নথী উদ্ধার করা হল। এ নিয়েও তখন কোনো মামলা হয় নি।

কয়েক সপ্তাহ আগেই জাতীয় সংসদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম অর্থ কেলেঙ্কারির এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবি করেন। এমনকি জড়িতদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত বলে তারা জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেন।

অভিযোগ থাকা সত্বেও সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংকেরর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানদের মেয়াদ দুই বছর বাড়াতে কসুর করেননি সরকার। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ সম্পর্কে জনমনের উদ্বেগ ও শংকা আমলে না নিয়ে সরকার স্বেচ্ছাচারী আচরণের বহি:প্রকাশ ঘটায়। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক কয়েকজন সদস্য পুরো দায় চাপিয়েছেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। একথা ঠিক দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হলমার্কের ঘটনাটি দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে। পরিচালনা পর্ষদের কাছে ব্যাংকের স্থিতি হিসাব নিশ্চয়ই উপস্থাপন করা হয়। না করা হলে পর্ষদ সদস্যরা তা চাইলেন না কেন? আর উপস্থাপন করা হলে স্থিতির অসঙ্গতি সদস্যরা ধরতে পারলেন না কেন? বুঝতে হবে সদস্যরা ব্যর্থ অথবা অযোগ্য অথবা যোগসাজসে ছিলেন। কোনো কোনো পরিষদ সদস্যের গত কয়েকবছরে সম্পদের ব্যাপক বৃদ্ধি নানাবিধ সন্দেহের উদ্রেক করে। সব ব্যাংকের প্রত্যেক শাখা দিনশেষে প্রতিদিনের হিসাব অনলাইনে আপলোড করে। বোতাম টিপেই এমডিসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষ তা দেখতে পারেন। একটি শাখা থেকে এভাবে টাকা সরিয়ে নেয়া হচ্ছে আর এমডি তা জানবেন না এটা হতে পারে না। পরিচালনা পর্ষদের কেউ তা বুঝতে পারবেন না এটাও বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তানভীর মাহমুদ নিজেই জানিয়েছেন পর্ষদ একটি ঋনের অনুমোদন করেছে।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ৫৯৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বন্ধই করে দেয়া হয়। ২০০২ সালে ওম প্রকাশ আগরওয়াল নামে এক ব্যবসায়ী পাঁচটি ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে নেয়ার কারণে পাঁচটি ব্যাংকের এমডিকে অপসারন করা হয়। আর এখন ২ হাজার ৬ শ কোটি টাকার জালিয়াতি হলেও সরকার তেমন গা করেননি। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে সরকারের উঁচু মহলের সঙ্গে যোগসাজসে তানভীর মাহমুদ এই জালিয়াতি করেছেন।

তানভির মাহমুদ "পাই পাই করে মৃত্যুর আগে সব টাকা শোধ করার" ঘোষণা দিয়েছেন। মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে মানুষের সমর্থন পাওয়ার এ এক অপকৌশল। এই নতুন নতুন ছুতা বের করে পার পাওয়ার চেষ্টা এই সব জালিয়াতদের জন্য নতুন কিছু নয়। এটা এক ধরনের মস্করা। তাদের এসব আবদারে গলে গেলে চলবে না।

মূল কাজ এখন দুটি, টাকা উদ্ধার ও অপরাধীদের শাস্তি দেয়া। হলমার্ক-এর এমডি তানভীর মাহমুদসহ টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট না দিলে ও সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং বর্তমান এমডি'র অপসারন না হলে টাকা উদ্ধার ও অপরাধীদের শাস্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকার দ্রুততার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন না করলে সরকারের উঁচু মহলের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগ সত্য বলেই ধরে নেবেন সকলে।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী: লেখক ও সাংবাদিক