রামুতে ধ্বংসযজ্ঞ: পুরোটাই পরিকল্পিত

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 4 Oct 2012, 12:03 PM
Updated : 4 Oct 2012, 12:03 PM

অতি-সম্প্রতি রামু-উখিয়া-টেকনাফ-পটিয়ায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপর যে নৃশংসতম ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা জানা নেই আমাদের। থাকার কথাও নয়। যে ভাষাতেই আমরা তা প্রকাশ করবো, তা-ই অপ্রতুল বলে প্রতিভাত হবে। কেননা এই ঘটনায় অত্যন্ত সুকৌশলে, যথাসম্ভব প্রাণহানি এড়িয়ে, মানব সভ্যতার এমন কিছু দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য দলিল ধ্বংস করা হয়েছে, যা সচরাচর কোনো মহাযুদ্ধেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। তবে উদ্দেশ্যমূলক অন্যায় যুদ্ধে এমনটি হয়ে থাকে, যার প্রমাণ আছে নিকট অতীতেই। যেমন, সাদ্দামের নিয়ন্ত্রণাধীন বাগদাদ পতনের পর মার্কিন বাহিনী পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওই এলাকার প্রাচীন সভ্যতার স্বাক্ষরবাহী সংখ্যাতীত প্রাচীন লিপি, গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি, শিল্পকর্ম ও স্মৃতিবস্তুসহ এই নগরীর প্রধান প্রধান যাদুঘর লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেছে। একটি মানবসমাজকে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা থেকে বিযুক্ত করে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার এই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ। কেননা গণহত্যা একটি জাতির জীবিত ব্যক্তিবর্গকে সরিয়ে দিলেও তার ধারাবাহিক ইতিহাসকে ছিন্ন বা বিলুপ্ত করতে পারে না। যেমন একাত্তুরে পাকহানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যত্রতত্র গণহত্যা চালালেও বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে বিলুপ্ত করতে পারেনি। তাই আজো আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে আছি।

আসলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধ-অধ্যুষিত অঞ্চলের এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল বলে মনে হয়। এই কয়দিনের তথ্যপ্রবাহ থেকে অন্তত এই সত্যটি বেরিয়ে এসেছে যে, ঘটনাটি শত ভাগ পূর্বপরিকল্পিত। আর এই পরিকল্পনার লক্ষ্য যেমন তাৎক্ষণিক, তেমনি সুদূরপ্রসারী। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন ও তার আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে প্রাণহানিসহ আরো ভয়ংকরতর ঘটনা এই এলাকাতেই সংঘটিত হতে পারে। তার ফলে শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এলাকা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলসহ গোটা বাংলাদেশ আরো সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।

এর ফলে বাংলাদেশের বর্তমান মানচিত্র পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।
সংঘটিত ঘটনার প্রকৃত উৎস কী? যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, তা কোনো দর্শক নিজের চোখে দেখেনি। দেখেছে ফেসবুকে ছবির আকারে। যেটি আছে সেটি কি ম্যানিপুলেটেড কোনো ভার্চুয়াল ছবি, নাকি আসল ছবি? এর কোনো সদুত্তর জানা নেই। কাজেই পুরো বিষয়টি ষড়যন্ত্রপ্রসূত একটি সাজানো নাটক হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু কেন এই ষড়যন্ত্র?
আমাদের জানামতে, হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের কোনো বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পবিত্র কোরাণ শরীফ অবমাননা করেছে, বা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে, এমন কোনো নজির নেই। আবার সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকার বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায় এমন কোনো ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েনি, যার ফলে এই ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। জানা গেছে, কথিত বৌদ্ধ যুবক নিজের ফেসবুকে প্রথমে নিজেই ছবিটি দেখে। এটি তার কাছে পাঠিয়েছে অন্য কেউ । অর্থাৎ সে নিজে এই ছবির স্রষ্টা নয়। তার অপরাধ হচ্ছে সে এটি অন্যদের কাছে পাঠিয়েছে। কেন পাঠিয়েছে, তার কোনো সদুত্তর নেই। অর্থাৎ ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে সে ব্যর্থ হয়েছে। আর এভাবেই সে হয়ে উঠেছে ঘটনার উত্তেজক 'উৎস'। যারা এই ঘটনার নেপথ্য পরিকল্পক, সংগঠক ও উপকারভোগী, তারা বৌদ্ধ তরুণ উত্তম কুমার বড়ুয়ার পরিচিত এবং তার ফেসবুকেরও সঙ্গী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যারা তার ফেসবুকে এই ছবিটি পাঠিয়েছে, তাদের লক্ষ্য হতে পারে এই এলাকার কোনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে দিয়ে পবিত্র কোরান অবমাননার ঘটনাটি ঘটানো। কোনো হিন্দু বা খৃষ্টান বা ইহুদী বা শিখ বা অগ্নিপূজক বা অন্য ধর্মাবলম্বীকে দিয়েও এই ঘটনা ঘটনো যেতো, কিন্তু তাতে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতো না।

তবে কি আক্রমণকারীদের মূল লক্ষ্য এই অঞ্চলের তাবৎ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে তাদের বসতবাটি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাত করে এই এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়া? আর সময় ও সুযোগ বুঝে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির দখল নেয়া? তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য হিসেবে এটি সম্ভব বলে মনে হয়। আর হামলাকারীরা মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি, সোনারূপা, দানবাক্স ইত্যাদি লুটে নিয়ে তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য কিয়দংশে পূরণও করেছে। মধ্যমেয়াদী লক্ষ্য হলো এদেরকে ভিটেচ্যুত ও গ্রামচ্যুত করে তার দখল নেয়া। আর দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য হতে পারে, এই অঞ্চলেই তাদের মনোমত একটি স্বর্গরাজ্য তৈরি করা। কারা এটি করবে? সহজ কথায়, যাদের দেশ নেই; কিংবা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহিত বাংলাদেশকে তাদের স্বদেশ মনে করে স্বস্তি পায় না, তারাই যৌথভাবে এই হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। এই এলাকায় একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র গঠনের গুজব দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। কাজেই এটাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যেভাবেই হোক, হামলাকারীরা তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য প্রায় শতভাগ পূরণ করেছে। উত্তম বড়ুয়া তার ফেসবুকে এই ছবি দেখা ও তা তার বন্ধুদের মধ্যে জানানোর কয়েক ঘন্টার মধ্যে রামুর বাইরে থেকে এসে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে যে ধ্বংসযজ্ঞ হামলাকারীরা চালিয়েছে, তাতে স্পষ্ট, এর আগে বেশ সময় নিয়ে তারা তাদের অ্যাকশন প্ল্যান ঠিক করেছিলো। লোক সমাগমের ব্যবস্থা আর গান পাউডারসহ অন্যান্য বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্র আগেই মজুদ ছিলো বলে অনুমিত হয়। তাই ঘটনাটি এতো দ্রুত ঘটানো সম্ভব হয়েছে। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এ-ক্ষেত্রে শতভাগ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এমনকি প্রথম রাতে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরের দিন উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়াতে তারা এই ধরনের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ সরকারের নিষ্ক্রিয় যোগসাজসের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছে। আবার সরকার পক্ষ বলেছে ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামাত-শিবিরের ইন্ধন আছে। কোনো কোনো মানবাধিকার নেতা বলেছেন, বিষয়টি সম্পর্কে গোয়েন্দাবাহিনী আগেই জানতো। ঘটনার আগে রামুতে সরকার ও বিরোধী দলীয় নেতাদের উপস্থিতি, সমাবেশ ও বক্তৃতা থেকেও মনে হয়, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অন্তত পূর্বমুহূর্তে অবহিত ছিলেন। তাহলে কেন ঠেকানো গেল না এই ধ্বংসযজ্ঞ? এর উত্তরও খুব স্পষ্ট নয়।

মনে রাখা প্রয়োজন, হাজার বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিরাপদ অবস্থান ও আশ্রয়-স্থল বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তের এই পাহাড়-সমুদ্র-সমতলঘেরা অঞ্চল। যুগ যুগ ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমানদের সঙ্গে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে। ইতিহাস বলে, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে মুসলমান আর বুদ্ধদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান; একমাত্র ব্যতিক্রম মায়ানমারের রোহিঙ্গা অঞ্চল। এই রোহিঙ্গারা এই অঞ্চলে স্বীকৃত শরণার্থী ও অস্বীকৃত নাগরিক হিসেবে বসবাস করে চলেছে। তাদেরকে বেশ কিছু জঙ্গী ইসলামী গোষ্ঠি সহায়তা করছে বলে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রতিবেদন আসছে। তারাই কি নিজেদের উদ্যোগে বা কোনো প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে? না, অসম্ভব নয় কোন কিছুই। এ ঘটনায় যে রোহিঙ্গারা ব্যবহৃত হয়েছে এমন তথ্য এসেছে পত্রপত্রিকায়ও। তবে সত্য প্রকাশিত হবে কেবল নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ তদন্তও এক বিরল ঘটনা।

তাহলে কী ঘটবে শেষমেশ? সুপ্রাচীন কিংয়াঙের অদৃষ্টবাদী ও নির্বাণপ্রত্যাশী বুদ্ধপুরোহিতের মতো আমরাও কি বলবো, এক বড়ধরনের পাপের ফলাফল এই ধ্বংসযজ্ঞ? কথায় বলে, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। যদি তাই সত্য হয়, তাহলে সে পাপমোচনের দায়িত্বও মূলত আমাদের সকলের। এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকাই সর্বাগ্রে। সামষ্টিক স্বার্থে আইন তার নিজ পথে এগিয়ে যাক, এটি আমাদের কাম্য। তা না হলে অচিরেই গণহত্যার চেয়ে ভয়ঙ্করতর পরিণাম নিয়ে আসবে এই ধ্বংসযজ্ঞ। তাতে বিপন্ন হবে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায়ের মিলিত নিবাস আমাদের এই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।
০৩.১০.২০১২

মুহম্মদ নূরুল হুদা : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।