জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 23 August 2012, 12:28 PM
Updated : 23 August 2012, 12:28 PM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংকট মুহুর্তে সিন্ডিকেটের জরুরি সভার সিদ্ধান্তক্রমে ঈদের ছুটি ৯ আগস্ট থেকে ২ আগস্ট এগিয়ে আনা হয়। ছাত্রদের হল ২ আগস্ট সন্ধা ৬.০০ টা এবং ছাত্রীদের হল পরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে খালি করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কোন প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্তটি নিতে হলো সে সম্পর্কে তোমাদের জানাই।

১লা আগস্ট রাত ১০.০০ টার পর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমাকে জানান যে অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এবং বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র তাহমিদুল ইসলাম লিখন ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে খেলার মাঠে পড়ে ছিল। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়ে এনাম মেডিকেল সেন্টারে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন কারণ তার অবস্থা শঙ্কাজনক। আমি নিজেও এনাম মেডিকেলে যাই এবং লিখনের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা নিশ্চিত করি।

জুবায়ের হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ কয়েক মাসের অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষা কার্যক্রম পূর্ণদ্যমে শুরু হয়েছে; ইতোমধ্যেই সেশন জ্যামের কবলে পতিত বিভাগগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিভাবে একাডেমিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন তার কার্যক্রম শুরু করেছেন; হলগুলোতে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরে আসছে; দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসের অপসংস্কৃতির বিষচক্রকে অগ্রাহ্য করে সাধারণ ছাত্র- ছাত্রীরা বেরিয়ে আসছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দীর্ঘদিন অবস্থানকারী বৈধ ছাত্ররা হলে ফিরে এসে স্বাভাবিক শিক্ষা জীবন শুরু করেছে; হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলো শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতি অনুসরণ করে ক্যাম্পাসে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনছে; বিভিন্ন তদন্ত কমিটি তদন্ত কাজ শেষ করেছেন এবং তদনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে; বিদ্যুৎ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে; রফিক-জব্বার হলের ছাত্রদের দীর্ঘদিনের আকুতি – গ্যাস সংযোগ দিয়ে ডাইনিং চালু করা – তা নিরসন হয়েছে; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্রের ক্ষতি নিরাময়ের পদক্ষেপসমূহ গৃহীত হচ্ছে – পরিযায়ী পাখি ফিরিয়ে আনবার সচেতন চেষ্টা শুরু হয়েছে; হলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে উপাচার্য সহ শীর্ষ প্রশাসনের মতবিনিময় সভায় হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যাসমূহ চিন্হিত করে তা নিরসনের আশু ও দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান খোঁজা হচ্ছে; যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের রক্ষাকবজ ১৯৭৩-এর আইন অনুসরণ করে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয়েছে; মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলর সেই প্যানেল থেকে একজনকে নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন; উপাচার্য নিয়োগের এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সংবাদমাধ্যমে এবং জনমনে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে এবং অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণের তাগিদ এসেছে – সেই সময়ে আবার একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

লিখনের কথা আরো জানাই। যেদিন রাতে তাকে ছুরিকাঘাতে আহত করা হয়, সেদিন দুপুরে নৃবিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্রী বিভাগীয় চেয়ারপার্সনের মাধ্যমে এক অভিযোগপত্রে লিখনের বিরুদ্ধে তাকে মোবাইল ফোনে ক্রমাগত উত্তক্ত করা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানায়। প্রক্টর এ বিষয়ে লিখন ও সেই ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযোগ বিষয়ে বিস্তারিত অবগত হন। সেই রাতেই ঘটে সন্ত্রাসী ঘটনা। উপাচার্য হিসাবে আমি প্রক্টর টিমকে প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন করার নির্দেশ দেই। তার ভিত্তিতে জানা যায় লিখন আঘাতকারী হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে একজন ছাত্রের নাম এবং অপর একজন সম্পর্কে অনুমান করে অভিযোগ করেছে। এ বিষয়ে পুলিশ তার জবানী নিয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়। আমি পুলিশকে এই সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে যুক্তদের সনাক্ত করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অনুরোধ করি।
এনাম মেডিকেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে আসার পর রাত ১১.০০টার পর প্রক্টর আমাকে জানান যে মীর মশাররফ হোসেন হলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছে এবং পুলিশের গুলিবর্ষণে পাঁচ জন ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছে। এ সংবাদ আমাকে বিস্মিত করে, কারণ হলে প্রবেশ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, বিশেষ করে হল প্রাধ্যক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, প্রাধ্যক্ষ এবং আবাসিক শিক্ষক এবং প্রয়োজনে প্রক্টর টিমের উপস্থিতিতেই শুধুমাত্র পুলিশ হলে প্রবেশ করতে পারে। আমার জানা মতে এর কোনটিই করা হয়নি। পুলিশের গুলিতে ছাত্র আহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে প্রথমে এম্বুল্যান্স পাঠাবার চেষ্টা করি। রোজার এই সময়ে ড্রাইভারকে পাওয়া যাচ্ছিলনা বলে আমি নিজেই আমার গাড়ি এবং প্রক্টর টিমের মাইক্রোবাসটি নিয়ে দ্রুত মীর মশাররফ হোসেন হলে আসি। আমি সেখানে রড, লাঠি হাতে অত্যন্ত উত্তেজিত ছাত্রদের দেখতে পাই। তারা বিনা অনুমতিতে হলে পুলিশের প্রবেশ এবং গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করি এবং আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে যাই। হলের করিডোরে আমি তিনজন আহত ছাত্রকে পাই। আমি নিজেই একজনে উঠিয়ে নেই এবং প্রক্টর টিমের সদস্য ও ছাত্রদের সহায়তায় আহতদের মাইক্রোবাসে উঠিয়ে এনাম মেডিকেলের দিকে যাত্রা করি। ইতিমধ্যে হলের কিছু ছাত্র ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছে। তারা আহতদের নিয়ে মাইক্রোবাসটিকে যেতে দিলেও আমার গাড়ির গতিরোধ করে। আমি গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত ছাত্রদের শান্ত করবার চেষ্টা করি এবং আহতরা যে রাবার বুলেটে আহত হয়েছে এবং আঘাত গুরুতর নয় তা জানাই। পুলিশ যে আমার অনুমতি না নিয়ে হলে প্রবেশ করেছে এবং তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেই। কিন্তু কোনো অবস্থাতে তারা মহাসড়ক ছেড়ে আসতে রাজি হয়নি। আমি গাড়িতে উঠে বসবার পর রড, হকিস্টিক এবং লাঠি নিয়ে বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন গাড়ি ভাংচুর শুরু করে। আমার মাথা ও শরীরে কাঁচের ভাঙ্গা টুকরো আঘাত করছিল। আমি তখন ভাবছিলাম, যেখানে আমি জীবনের কথা না ভেবে বিপন্ন ছাত্রদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছি, সেখানে আমার উপর এই আক্রমণ কেন? এটা কি আমার প্রাপ্য? মনে পড়লো, ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুননাহার হলের বিপন্ন ছাত্রীদের পাশে দাড়ানোর কারনে পুলিশের লাঠির আঘাতে আমার হাঁটু ভেঙ্গে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনা সদস্য এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষকালে আবারও বিপন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাড়ানোর কারনে আমাকে ১২ দিনের রিমান্ড ও পাঁচ মাসের কারাবাস করতে হয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা কখনও আঘাততো দূরের কথা, জীবন দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছে অনেকবার। ঢাকা-আরিচার মহাসড়কে গভীর রাতে আধো-অন্ধকারে আক্রমণকারীরা ছাত্র হতে পারে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। মনে পড়ছিল মুক্তিযুদ্ধে নৌকা করে নদী পার হওয়ার সময় আমাদের মাথার উপর দিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলি উড়ে যাচ্ছিল, অথচ তার মধ্যেই আমি নৌকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই আমার মাথা ও শরীরে পড়া গাড়ির ভাঙা কাঁচ আমাকে বিচলিত করতে পারেনি। গাড়ির ড্রাইভার শেষ পর্যন্ত আক্রমনকারীদের জটলা অতিক্রম করতে সক্ষম হন এবং আল-বিরুনি হলের প্রাধ্যক্ষ যিনি আমার সাথে ছিলেন, তাঁকে নিয়ে এনাম মেডিকেল কলেজে পৌঁছাই। রাবার বুলেটে আহতদের দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা নেয়া হয়। যা ধারণা করা গিয়েছিল, আঘাত গুরুতর ছিল না। ড্রেসিং এবং ব্যান্ডেজ দিয়ে তাদের কেবিনে আনা হয় এবং পরদিনই তারা হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারে।

অবরোধকারীরা দীর্ঘ ১৬ ঘন্টা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এতে প্রসব বেদনায় কাতর এক হতভাগা মাতা, অসহায় পরিবার, জরুরি কাজে যাচ্ছেন এমন হাজার হাজার মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট, শঙ্কা এবং অসহায় অবস্থায় পতিত হন। এনাম মেডিকেল থেকে অবরোধের কারণে সে রাতে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারছিলামনা। বাকি রাত সেখানে আহতদের পাশে থাকি এবং হলের প্রভোস্ট ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বলি। ফলে সে রাতে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাড়া অন্য কোন হলের ছাত্ররা অবরোধে অংশ নেয়নি। তবে পরদিন বেলা বাড়ার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ অবরোধে অংশ নেয়। আমি ঢাকার গাবতলি-বেড়িবাধ-আশুলিয়া হয়ে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হই। আমরা উপাচার্যের বাসভবনে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় মিলিত হই। কারণ ইতিমধ্যে বর্তমান প্রশাসনিক ভবন, নতুন প্রশাসনিক ভবন, মূল ফটক, টি.এস.সি. এবং অন্যান্য স্থাপনায় বীভৎস আক্রমন চালানো হয়েছে এবং ব্যাপক ভাংচুর, কম্পিউটার ভেঙ্গে ফেলা সহ সম্পদের বহু ক্ষতি ঘটে গেছে। প্রো-উপাচার্য ও ট্রেজারারের নেতৃত্বে উপস্থিত সিন্ডিকেটের সদস্যগণ মহা সড়কে অবরোধকারীদের সাথে দেখা করে তাদের সকল ন্যায্য দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা অবরোধ উঠিয়ে নিতে রাজি হয়নি। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমি ক্যাম্পাস থেকে সকল পুলিশ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেই এবং পুলিশ সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে চলে যায়। কিন্তু তাতে কোনো ফলোদয় হয়নি। অবরোধকারীদের একটি অংশ পেছন থেকে পুলিশ সদস্যদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের আহত করে। তারা প্রক্টরের বাসভবন আক্রমন করে। সেখানে এবং প্রাক্তন উপাচার্যের বাসভবনে প্রহরী হিসাবে কর্মরত পুলিশগণ তাদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। এ অবস্থায় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় সর্বসম্মত ভাবে বন্ধকে এগিয়ে এনে হল খালি করার সিন্ধান্তটি নিতে হয়, যে সম্পর্কে শুরুতে বলেছি।

আমি জানি খুবই স্বল্প নোটিসে হল ছেড়ে দূর-দূরান্তে যেতে তোমাদের খুবই কষ্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেও গন্তব্যে পৌঁছাতে তোমাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে পারিনি। তারপরও যে শৃঙ্খলা ও ধৈর্যের সাথে তোমরা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছ, তারজন্য আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। ২ আগস্ট রাতে আমার সহকর্মীদের নিয়ে আমি প্রতিটি ছাত্রী হলে ছাত্রীদের সাথে দেখা করেছি। কোনো কোনো হলে সবিস্তারে তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছি এবং করণীয় সম্পর্কে তাদের অভিমত জানতে চেয়েছি।

৩ আগস্ট সকালে চ্যানেল আই এবং ওই রাত ১২ টায় বাংলাভিশনে ঘটনার উপর আমার বক্তব্য সরাসরি প্রচারিত হয়। এখন আমি একটি ফোন কলের কথা তোমাদের জানাবো যা ওই সময়ের সংকটে আমাকে নতুন প্রেরণা দিয়েছে। ৩ আগস্ট সন্ধায় আমি জাতীয় অধ্যাপক স্বনামধন্য শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এম আর খান-এঁর ফোনটি পাই। তিনি বললেন, সকালে তিনি চ্যানেল আইতে আমার বক্তব্য শুনে খুবই অনুপ্রাণিত ও আশাবাদী হয়েছেন। বললেন, "একটি আগ্নেয়গিরির উপর আপনি বসে আছেন। আপনার উপর যে আচরণ করা হয়েছে তাতে অন্য যে কেউ পদত্যাগ করে চলে যেতেন। কিন্তু আপনি এখনো যে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ভরসা করছেন, মানুষের সহজাত শুভবোধের উপর আস্থা রাখছেন অত্যন্ত ধীর চিত্তে, তাতে আমি অভিভূত হয়েছি"। আরো বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে আসা নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের নানা বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এবং হলে শিক্ষা জীবন শেষে তারা যেন এক পরিবর্তিত, পরিশীলিত, প্রজ্ঞাবান মানুষে পরিনতি হতে পারে যাতে দেশবাসী পরিষ্কার বুঝতে পারে, ওই একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যার ধৈর্য আছে, যে যুক্তির কথা বলে যা শুনে মানুষ খুশি হয়, যার মধ্যে মানবতাবোধ আছে, অন্যের দুঃখে নিজে কষ্ট পায়, যে সুন্দর করে কথা বলে, কটুবাক্য উচ্চারণ করে না, যে সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা করে যারা তাদের কষ্টের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পড়াচ্ছে, যার পোশাক পরিপাটি, যাকে দেখে সমীহ জাগে মনে এবং সর্বোপরি যে বিদ্বান এবং যাদের উপর ভিত্তি করে ঐ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে যা ২০২১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিনত করবে একটি আধুনিক, সম্মৃদ্ধ, মানবিক এবং সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। আমার চোখে পানি এসে গেল। বললাম, "স্যার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে আমরা সেই র্কাযক্রম গ্রহণ করব"। কোনো একটি বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রথম বক্তব্যটি দেয়ার জন্য আপনাকে আমরা আমন্ত্রণ করব। তিনি বললেন, "সেই আমন্ত্রনের অপেক্ষায় আমি থাকব"।

এই বন্ধে দর্শন বিভাগের প্রভাষক সাহিদ সুমনের সাথে সাক্ষাত হলো। তার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য নির্বাচন কমিটির সভায় 'স্পিনোজার উত্তম জীবনের ধারণা' এমন নামের তার গবেষণা পত্র নিয়ে কথা হলো। প্রসঙ্গক্রমে জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের ফোনকল বিষয়ে বললাম। আমরা যখন সংকটে পড়ি তখন সরণাপন্ন হই দর্শনের। তাকে বললাম, তোমাদের দর্শন বিভাগ থেকেই প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ সভার আয়োজন করব। প্রথম বক্তব্যটি দেবেন জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান।

১৬ ঘন্টা ধরে দেশের অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা, উপাচার্যের গাড়ি ভেঙ্গে ফেলা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন বিষয়ে এবারে কিছু বলব। সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত মাতৃভূমি বাংলাদেশের সমান বয়সী দেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তোমাদের অতি প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীরা এমন আত্মধ্বংসী অপ-তত্পরতায় লিপ্ত হবে এটা ভাবতেও আমার কষ্ট হয়। পুলিশ সাদা পোশাকে এসে হল কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে হলে প্রবেশ করে সন্ত্রাসী ঘটনার কথিত অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে এসে মহাভুল করেছে। উত্তেজিত ছাত্ররা তাদের হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, তাদের উপর চড়াও হয়ে তাদের আহত করেছে এবং পরে পুলিশের গাড়িও ভাংচুর করেছে। পুলিশের বক্তব্য হলো, আত্মরক্ষার্থে তারা রাবার বুলেট ছুড়েছে। ২ আগস্ট সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় প্রো-উপাচার্যের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ২১ কর্ম দিবসের মধ্যে ঘটনার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ ধ্বংস সহ মহাসড়ক অবরোধ – এসবে মদদদাতাদের সনাক্ত করা এবং তার ভিত্তিতে করণীয় বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করতে তদন্ত কমিটিকে বলা হয়েছে।

তোমরা জান যে সত্য উদঘাটনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লিখনের উপর সন্ত্রাসী হামলা, ১৬ ঘন্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বাইরের সম্পদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির সাথে যুক্তদের সনাক্ত করে আইনের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে ব্যবস্থা নেবে। কেন পুলিশ সদস্যগণ সাদা পোশাকে বিনা অনুমতিতে হলে প্রবেশ করলো, সে বিষয়ে তারা অনুসন্ধান করবে। আমাদের তদন্ত কমিটিও এ বিষয়ে আসল সত্য জানতে তত্পর হবে। সংবাদ সম্মেলনে আমি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বানও জানিয়েছি। আশা করি ঐ সময় ঘটে যাওয়া নৈরাজ্যকর ঘটনায় কার কতটুকু দায়-দায়িত্ব, কোন অন্ধকারের শক্তি এর পেছনে ছিল তা জানা যাবে। এই দুঃখজনক ঘটনায় আবেগতাড়িত হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের সাধারণ ছাত্র যারা যুক্ত হয়েছিল, তারা যেন কোন নিগ্রহের শিকার না হয় সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তত্পর থাকবে। তবে এ ঘটনার মদদদাতাদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আশা এবং দৃষ্টান্তমূলকভাবে যথাযত শাস্তি প্রদান করা প্রয়োজন হবে। আমি জানি সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা এসব দুস্কৃতিকারীদের হাত থেকে তাদের শিক্ষা জীবন এবং প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার এবং তাকে নির্বিঘ্ন রাখার সকল প্রয়াসকে বিপুলভাবে সমর্থন করবে। পুলিশ আর কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বা হলে প্রবেশ করতে পারবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সীমানা প্রাচীর নেই, যদিও ডেইরি ফার্ম, বিপিএটিসি, বিএলআরআই, রেডিও কলোনি সহ আশপাশের সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীর আছে। তোমরা জেনে খুশি হবে যে সামনের শীতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর তৈরির কাজ আমরা শুরু করতে পারব। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে সঙ্গবদ্ধ দুস্কৃতিকারীদের অপ-তৎপরতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা সুরক্ষিত থাকবে।

আগামী ২৫শে আগস্ট বিকেল ৪.০০টায় হলসমূহ খুলে দেয়া হবে। আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শুধুমাত্র প্রবেশপত্রধারী বৈধ ছাত্র-ছাত্রীরা থাকবে, তা নিশ্চিত করতে আমরা কিছু সাময়িক ব্যবস্থা নিয়েছি। সকাল ৮.০০ টা থেকে রাত ১১.০০ টা পর্যন্ত হল গেইট খোলা রাখবার কথা বলা হয়েছে। আবাসিক শিক্ষকগণ পালা করে হল গেইটে থাকবেন। বাইরের খাবারের দোকানগুলোকে সেই অনুযায়ী খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। হলে সকল বৈধ ছাত্র-ছাত্রীদের থাকা নিশ্চিত করবার পরপরই রাত ১১.০০ টার বিধিনিষেধ শিথিল করে আমরা তা রাত ১২.০০ টায় নিয়ে যেতে পারব। আশা করি ছাত্র-ছাত্রীরা তা সাদরে গ্রহণ করবে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের। আমরা তাকে শান্তির দ্বীপে রূপান্তর করব আমাদের শক্তি দিয়েই। কারো প্ররোচনায় বা উস্কানীতে শিক্ষা-কার্যক্রম কোনভাবে বিঘ্নিত হবে না। শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ক্যাম্পাসে পুলিশ আসতে পারবে। স্বাধীন দেশে ছাত্র-পুলিশ-জনতা কারো প্রতিপক্ষ হবে না। পরস্পরের বন্ধু হবে – স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা, কিন্তু তার থেকে কত যোজন দূরেই না আমরা আছি। এই দূরত্ব কমাতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে। "আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী" – রবীন্দ্রনাথের এই অমর বাণী স্মরণ করে বলবো জাহাঙ্গীরনগর পরিবার আঁধার পেরিয়ে উদ্ভাষিত আলোয় প্রবেশ করবে।

তোমাদের জন্য ভালবাসা ও শুভেচ্ছা।

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন : উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।