জাকাত ও ফিতরা দারিদ্র দূরীকরণে ব্যবহার হোক

বেবী মওদুদ
Published : 12 June 2014, 02:31 PM
Updated : 18 August 2012, 03:46 PM

পত্রিকায় খবর হয়ে এসেছে- 'তিন নারী জাকাতের শাড়ি নিতে এসে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন।' বড় মর্মান্তিক খবর। তারা যে দরিদ্র এবং মধ্য বয়সী ছবি দেখে বোঝা যায়। হয়তো বা অসহায় ছিলেন। সারা বছর একজন মানুষ যেমন প্রতিদিন দুই বেলা খেয়ে বেঁচে থাকেন, তেমনি পরনের কাপড় হিসেবে শাড়ি, ব্লাউজ-পেটিকোট লাগে তিন-চার সেট। ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহ করে থাকে যারা তাদের এটা লাগে। অবশ্যই লাগে। কীভাবে পাবে বা কোথায় পাবে এ দুশ্চিন্তা তাদের থাকে। লক্ষ্য থাকে ঈদ উপলক্ষে যাকাতের কাপড় সংগ্রহে। পদপিষ্ট হয়ে মৃত চার নারী হলেন- ১। জরিনা বেগম, ২। সাদিয়া আখতার ময়না, ৩। সাহারা খাতুন এবং ৪। হেলেনা আখতার। অসহায়ত্বের কারণে এই শাড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। এই মৃত্যু মেনে নেয়া বড় বেদনাদায়ক। তাদের সংসারে ঈদের আনন্দ বলে আর কিছু থাকলো না। ঈদে নতুন শাড়ি পরার স্বপ্ন নিয়েই তারা বিদায় নিলেন।

প্রতিবছরই আমরা এমন মৃত্যুর সংবাদ পাঠ করি। যাকাতের শাড়ি বা লুঙ্গি বিতরণকালে এভাবে অনেক মৃত্যুর খবর আমরা পাই। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার পথে লঞ্চডুবিতে বা বাস দুর্ঘটনার খবরও বড় বড় করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এমন অকালমৃত্যু কখনো কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা মনে করি, এই মৃত্যু বন্ধ করতে হলে মৃত্যুফাঁদ কেন তৈরি হচ্ছে সেটা দেখতে হবে এবং কঠোর আইন তৈরি করতে হবে। যাকাত ও ফেতরা দেবার কথা তো ধর্মেই উল্লেখ করা আছে। সেটা হিসাব করে ব্যবসায়ী, ধনী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা এসব প্রদান করে থাকেন। কিন্তু সবই হচ্ছে বিচ্ছিন্ন বা ছিটেফোটাভাবে। কোথাও কোনো সমন্বয় নেই। নিজেকে দানশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেউ কেউ ঢাকঢোল পিটিয়ে যাকাত দান করে থাকেন। আর এই অভাবের দেশে হত দরিদ্র ও নিম্নবিত্তরা গিয়ে ভিড় জমান। ফলে উপস্থিত মানুষের সংখ্যার চাইতে অনেক কম সামগ্রী থাকায় একটা হৈ চৈ হয়ে যায়। ফলে ভিড়ের চাপ ও বিশৃঙ্খলার কারণে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কারণ ঘটে যায়। যারা দান খয়রাত করে থাকেন, তাদের কাছে এমন মৃত্যু নিয়ে মাথাব্যথা আছে কি? হলে নিশ্চয়ই তারা একটি মৃত্যুও ঘটতে দিতেন না। মাথাব্যথা হয় না বলেই প্রতিবছর তারা এসব ছিটেফোটা দান খয়রাত করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন। আমি মনে করি, এমন মৃত্যুর জন্য এরাই অপরাধী- এদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। ধর্মে তো বলা আছে, এমনভাবে এক হাতে দান করবে যেন তোমার আরেক হাত জানতে না পারে। এছাড়া দান করার সময় প্রথমে আত্মীয়স্বজন, তারপর পাড়া প্রতিবেশী এবং সবশেষে অন্যদের কথা ভাবতে হবে। আমরা এর কোনোটিই গ্রহণ করি না। প্রকাশ্যে লক্ষ জনতার সামনে নিজেকে দানবীর হিসেবে পরিচিত করতে প্রতিযোগিতায় নামি। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে এই ধরনের দানবীর হওয়ার মধ্যে কী মাহাত্ম থাকতে পারে আমি বুঝি না। তারা যদি সত্যি গরীবের বন্ধু হতে চান, সমাজের সেবা করতে চান, দেশ ও জাতির উন্নয়নে বিশেষভাবে অবদান রাখতে চান- তাদের প্রতি আমার একটি আবেদন আছে। এভাবে ছিটেফোঁটা দান খয়রাত করে আপনি কোনোভাবেই দানশীল হতে পারবেন না। তারচেয়ে আপনার এলাকার দরিদ্র এবং ভূমিহীন ও অসহায় মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলুন। তাদের ঘর দিন, কাজ দিন, শিক্ষা দিন- এভাবে যদি আপনার এলাকা থেকে দারিদ্র্য নিরক্ষরতা, কূপমণ্ডুকতা, অভাব-অনটন দূর করতে পারেন তাহলে তো আপনি শুধু দানবীর কেন আমার মনে হয় মহামনব হিসেবে পূজনীয় হবেন। আপনার এলাকার স্বচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে এ প্রচেষ্টা নিয়ে সবার জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারেন। যাকাত বা ফিতরার টাকা এভাবে ছিটেফোঁটা দান না করে প্রতিবছর একজন বা কয়েকজন দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগ নেয়াটা আরো বেশি কৃতিত্বের কাজ। ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেই আপনি আলোকিত হয়ে থাকবেন।

সরকারের কাছে আমরা দাবি করতে পারি, জাতীয়ভাবে যাকাত ফান্ডকে কার্যকর করা হোক। শুধুমাত্র আমলাদের ফাইলবন্দি না রেখে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। সেইসঙ্গে এই ফান্ডে যাকাত ও ফেতরার টাকা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদানের জন্য জনগণকে বাধ্য করতে হবে। এই অর্থ দ্বারা দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘর কাজের ব্যবস্থা করে দিলে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের একটা প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে এভাবে দারিদ্র্য দূর করার কথা শোনা যায়। তারা পারলে আমরা পারব না কেন? এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে অতীতে এতিমদের ফান্ডের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। যাকাত ফান্ডের টাকাও কি হবে? হ্যাঁ, সে সম্ভাবনাও থাকতে পারে, আবার নাও পারে। তবে যারা এই লুটপাট করবে তাদের অপরাধের শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর করা যায়, সেরকম আইন প্রণয়ন করতে হবে। গরীবের টাকা যারা খায়, তারা তো শোষক, গরীবের শত্রু। তাদের ধ্বংস করা কোনো পাপ বলে অন্তত আমি মনে করি না।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে কার্যকর করা হলে দেশ থেকে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, ভিক্ষাবৃত্তি এবং নির্যাতন অবশ্যই দূর করা যাবে। এভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে দানবীর হবার জন্য যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে যাকাত দিয়ে থাকেন তাদের উৎপাতও বন্ধ হবে। মানুষের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার কোনো ধর্মে স্বীকৃত নয়।

১৭/৮/২০০১২
ঢাকা

বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।