গ্রামীণ ব্যাংক: প্রাসংগিক বিতর্কসমূহ

এম এম আকাশ
Published : 23 April 2014, 04:28 PM
Updated : 8 August 2012, 10:54 AM

গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে সরকার সম্প্রতি কতগুলো নির্দেশনা জারি করেছে। চেয়ারম্যান কর্তৃক এমডি নিয়োগের পদ্ধতি বদলানো সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর মাধ্যমে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান আরও বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃক মনোনীত। সুতরাং এমডি নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে সরকারের হাতে চলে যাচ্ছে। এটি আগে সম্ভব ছিল না। নিয়মটি পরিবর্তনের ফলে এখন এটি সম্ভব হয়েছে। আগের নিয়মে বলা ছিল, বোর্ড অব ডিরেক্টরের ভোটাভুটির মাধ্যমে মেজরিটি যাকে চাইবে, তাকে এমডি করা হবে। নিয়মটি পরিবর্তন কতটা কাংখিত এবং প্রতিষ্ঠানটির জন্য তা কতটুকু সহায়ক হবে এটি এক বড় প্রশ্ন এখন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করতে পারি।

এসব ঘটনার পেছনে একটি পটভূমি রয়েছে। এটি জানা থাকলে এ পর্যালোচনা করাটা সহজ হবে। তা হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাবস্থাপক ছিলেন ড. মুহম্মদ ইউনূস। আইন অনুযায়ী ষাট বছরের অধিক বয়সী কেউ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের বয়স ৬০-এর ওপর চলে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়। কাজ শেষ করার জন্য তিনি কিছু বাড়তি সময় দায়িত্বে থাকতে চান। সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ উল্লেখ করে তাকে বাড়তি সময় দিতে চায় না। এর বিরুদ্ধে তিনি কোর্টে মামলা করেন এবং হেরে যান। সে সময়ও এক ধরনের পর্যালোচনা হয়েছিল। অনেকে আমার অবস্থানও জানতে চেয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম, আইন অনুযায়ী এটা হয়েছে।

সুতরাং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কোনো যুক্তি ড. ইউনূসের নেই। এ ক্ষেত্রে তার অন্যতম দুর্বলতা হলো, যতদিন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি ছিলেন ততদিন কোন সেকেন্ড ম্যান তৈরি করেন নি। এটা তারই দুর্বলতা, এর কারণে আইন স্থগিত রাখা যৌক্তিক হবে না। বট বৃক্ষের ছায়ায় আরেকটি বট বৃক্ষকে বিকশিত হওয়ার যদি সুযোগ করে দিতেন তিনি, তাহলে আজকে সানন্দে দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে পারতেন। আরও একটি কথা তখন বাজারে চালু ছিল যে, আপস প্রস্তাব হিসেবে তাকে চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। ড. ইউনূস নাকি বলেছিলেন, আর কিছুদিন এমডি থাকি তারপর হবো। এ ক্ষেত্রে তার যুক্তি ছিল, এ সময়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি তৈরি করতে পারবেন। প্রশ্ন হলো, এত দিনেও দ্বিতীয় ব্যক্তি তিনি তৈরি করতে পারেননি কেন? তাঁর বোঝা উচিত ছিল, তিনি অন্যদের মতো নন। ড. ইউনূস কি এটা ভেবেছিলেন, রাষ্ট্রীয় আইনের উর্ধ্বে থাকবেন তিনি? সুতরাং এসব বিতর্কে তিনি যুক্তিবাদী মানুষের সমর্থন পাননি।
কিন্তু এখনকার প্রশ্নটি ভিন্ন। বিষয়টি হচ্ছে সরকার আইন পরিবর্তন করে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে যাচ্ছে যাতে ড. ইউনূস কিছুতেই এমডি হতে না পারেন। কোন ব্যাংকই বোধ হয় এ নিয়মে চলে না। সরকার যে চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দিচ্ছে এমডি নিয়োগের, তাকেই মনোনীত করে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি চায় কেবল তখনই ড. ইউনূস এমডি হতে পারবেন। এখন তিনি এমডি নন। হয়তো তার এমডি হওয়ার সম্ভাবনাও আর নেই। কিন্তু তার পছন্দমতো লোক তো এমডি হতে পারেন। সেই পছন্দ মতো লোক হয়তো এখন এমডি আছেন। তাকে হয়তো সরকার সরাতে চাইচ্ছে। আইন পরিবর্তনের ফলে ড. ইউনূসের ওপর অভিঘাতটা প্রত্যক্ষভাবে হবে না। তিনি হয়তো ভাবতে পারেন, তার পছন্দের লোককে এমডি থেকে সরিয়ে দিলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনায় ত্রুটি দেখা দেবে; প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে প্রভৃতি।

গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক কারা? এর মালিক হচ্ছে শেয়ার হোল্ডাররা। শেয়ার হোল্ডার কারা? এক সময় গ্রামীন ব্যাংকের একটি বড় অংশের শেয়ারের মালিক ছিল সরকার। সম্ভবত সেটি ছিল ২৫ বা ৩০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সরকার আর নতুন বিনিয়োগ করেনি, অপরদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের পুঁজি বেড়েছে। এতে স্বাভাবতই টোটাল ভেল্যু অব অ্যাসেটে সরকারের আনুপাতিক শেয়ারের হারটা কমে গেছে। কমতে কমতে এখন তা ৩-৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছিও চলে আসতে পারে। এতে এমডি নির্বাচনে সরকারের ভোটের সংখ্যাও কমে গেছে। অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নিয়োগ সরকারের হাতে রয়ে গেছে। অধ্যাদেশ সংশোধনের পর এখন চেয়ারম্যানই বোর্ডের সাথে আলোচনা করে এমডি নিয়োগ করবেন, বোর্ড নয়– এটা পরিষ্কার। কিন্তু সরকার যদি গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বাড়াতে চায় তাহলে সরকারের উচিত গ্রামীণ ব্যাংকে বিনিয়োগ করা। এর মাধ্যমে সরকারের কর্তৃত্ব ও ভয়েস প্রতিষ্ঠা করা। মালিকানা নেই, অথচ একটি অর্ডিন্যান্স পরিবর্তন করে এমন কিছু করতে গেলে প্রশ্ন উঠবেই সরকারের সদ্দিচ্ছা নিয়ে। এটি একটি বিশেষ লোককে লক্ষ করে করা হচ্ছে বলে জনগণের মনে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। কিন্তু আইন তো কখনো কোন বিশেষ লোককে লক্ষ করে করা উচিত নয়।

ন্যায় বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অবশ্যই সঠিক হয়নি। কারণ ন্যায়বিচার হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকরাই প্রতিষ্ঠানটির ভালো-মন্দ সবচেয়ে ভালো বোঝে এবং তারাই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। মালিকরা কীভাবে একটি শেয়ার হোল্ডিং কোম্পানি চালাবে, তার কতগুলো আইন আছে। সে আইন অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রায় ৩০ লাখ নারী তাদের প্রতিনিধিকে বোর্ড অব ডিরেক্টরসের মেম্বার করে পাঠিয়েছে। এখনো তাই আছে। সম্ভবত বোর্ডের মেম্বারদের একটি বড় অংশ তারা নির্বাচন করেন। বোর্ড সদস্যদের একটা অংশ সরকারের মনোনীত আর চেয়ারম্যানও তাই। এই বোর্ড অব ডিরেক্টরসই হলো গ্রামীণ ব্যাংকের সব ম্যানেজারিয়াল বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী।

সরকার এ ক্ষেত্রে বলতে পারে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সংসদে পাস করা একটি অর্ডিন্যান্স দিয়ে। সংসদের ক্ষমতা আছে পুরনো অর্ডিন্যান্স বদলানোর। সরকার অবৈধ কোন কাজ করছে তা আমরা বলতে পারব না। তাও এখানে একটু অবৈধতা আছে। কেননা, সংসদ ওই অর্ডিন্যান্স বদলায় নি। এটি মন্ত্রী সভার সিদ্ধান্ত। সরকার পুরোপুরি আইন মানতে চাইলে সংসদে গিয়ে অর্ডিন্যান্সটি বদলাতে হতো। এ ধরনের কিছু প্রসিডিওরাল বোকামিও করছে সরকার। যে কারনে ড. ইউনূস দ্বিতীয়বার আদালতে গিয়ে চ্যালেঞ্জও করতে পারেন। অবশ্য তিনি এটা হয়তো আর করবেন না। কারণ, তার প্রথমবারের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কিন্তু প্রথমবার কেস যতটা দুর্বল ছিল, এবারেরটি ততটা দুর্বল নয়।
আরো দুটো সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদরা এটির কথা সব সময় বলছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক যারা– গরীব নারী– তারা ব্যালেন্স শিট বোঝেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের আয়, ব্যয়, অর্থপ্রবাহ– সবটা যে সামগ্রিকভাবে ম্যাক্রো লেভেলের অপারেশনাল ত্রুটি-বিচ্যুতি পরীক্ষা করে সেটাকে ঠিকঠাক করা, অ্যাকাউন্টেবল রাখা, জবাবদিহির ব্যবস্থা করা– এগুলোর জন্য যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দরকার এটা তাদের নেই। তাদের সে জ্ঞান থাকা অসম্ভব, তাও আমি বলছি না। কোন মেধাবী গরীব নারী সেটি শিখেও থাকতে পারেন। তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, ব্যবসা পরিচালনার জটিল জ্ঞান তাদের নেই। কিন্তু বোর্ডের বিরাট দায়িত্ব। গ্রাহক সংখ্যা, মূলধন ও অপারেশনের বিচারে গ্রামীণ ব্যাংক অনেক বড় একটি ব্যাংক। সুতরাং এটি পরিচালনা করা ছোট কোন বিষয় নয়।

আরেকটি কাজ গ্রামীণ ব্যাংক করেছে সেটি হলো, প্রতিষ্ঠানটির নামে বাইরে থেকে যে অর্থ এসেছে তা দিয়ে তারা গ্রামীণ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। গ্রামীণ ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে অনেক গ্রামীণ নাম বহনকারী যেটাকে ড. ইউনূস বলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ, তা তৈরি করেছেন। ড. ইউনূসের যুক্তি এ সামাজিক এন্টারপ্রাইজগুলো মুনাফা করবে। এমনকি বিদেশীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা দইয়ের কারখানাও তিনি তৈরি করেছেন এবং সেটি মুনাফাও করছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্দেশ্য ছিল মুনাফা নয়, দারিদ্র্য দূরীকরণ। মালিকরা এই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছেন। মালিকরা কি তাহলে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, আমরাও মুনাফার উদ্দেশ্যে একটা কিছু করবো। ড. ইউনূস তখন তাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দিতেন আমরা মুনাফা করছি ক্রস সাবসিডাইজেশনের জন্য। সেটার অর্থ কী? গ্রামীণ ব্যাংকের মালিদের সন্তানরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায়, অসুস্থতায় তাদের চিকিৎসা করতে হয়, প্রভৃতি সামাজিক কাজ করতে হয়–এসব কার্যক্রমের ফান্ড গ্রামীণ ব্যাংক থেকে দেয়া হবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের নামে আহরিত অর্থ বা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ধার দেয়া অর্থ দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো করা হলো, সেগুলো থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে এসব সামাজিক কাজ করা হবে। সুতরাং এ কাজে গ্রামীণ ব্যাংক তথা বোর্ড সদস্যদের আপত্তি নেই। এতে বোর্ড মেম্বারদের জন্য বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেলো। আগে তাদের দেখতে হতো, গ্রামীণ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা, এখন তাদের দেখতে হবে গ্রামীণ ব্যাংকের টাকা নিয়ে বা গ্রামীণ গুডউইল ব্যবহার করে অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের কার্যক্রমও। অবশ্য ড. ইউনূস কখনোই স্বীকার করেননি এটা গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানার প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেছেন সেগুলো একেকটি স্বাধীন কোম্পানি। কোম্পানি বাই গ্যারান্টি। এর অর্থ হলো, ওই পুঁজির গ্যারান্টার হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক, কিন্তু ওরা ইন্ডিপেনডেন্ট অথরিটি। তাহলে প্রশ্ন আসে, গ্রামীণ টেলিকমও কি একটি স্বাধীন কোম্পানি? সেই কোম্পানিটি তো অনেক মুনাফা করছে। ওই মুনাফা পাবে কে? গ্রামীণ দই, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ বাইটেক, গ্রামীণ এনার্জি, গ্রামীণ টেক্সটাইল– এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দুটো প্রশ্ন সামনে চলে আসে। মুনাফা কারা পাবে এবং লোকসানের দায় কে বহন করবে?

ড. ইউনূস এখন এ প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন, আমি জানি না। ড. এ কে মনোওয়ার উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম বিশ্লেষণের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সে সময়ে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার তারা গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আরও কয়েকজন ছিলেন। সেখানে এই প্রশ্ন তুলেছিলাম আমি। প্রশ্নটি প্রথম ওঠে রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার পরিচালিত এক গবেষণায়। তিনি বিভিন্ন ধরনের মালিকানা মডেল নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। প্রাইভেট ক্যাপিটালিজমের প্রেরনা হলো মুনাফা, এবং এর ফলাফল হলো সম্পদের ঘনীভবন ও কেন্দ্রিভবন, তীব্র শোষন ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। পক্ষান্তরে, পাবলিক এন্টারপ্রাইজের মালিক রাষ্ট্র এবং সেটার মুনাফা সরকারের, সরকার সেটা গরীব লোকদের মাঝে ভাগাভাগি করবে অথবা সামাজিক খাত তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ– এসব কাজে খরচ করবে। কিন্তু যদি সেখানে আমলাতন্ত্র থাকে, তাহলে সেটা তো লাভজনক নাও হতে পারে। তাছাড়া, দুর্নীতি থাকলেও এধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হবে না। যদি ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা না থাকে বা রাষ্ট্রের যদি সুশাসন ঘাটতি থাকে, তাহলেও পাবলিক এন্টারপ্রাইজ অকার্যকর হয়ে পড়বে। আর বৈষম্যের নিরিখে এখন একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানাও কাংখিত নয়। তাহলে আমরা কী করবো? এটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিটজ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন আমি তাকে এই প্রশ্নটিই করেছিলাম। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ উভয়ই যদি ব্যার্থ হয়, তাহলে আমরা কী ধরনের মালিকানা পদ্ধতি গ্রহন করবো? এর জবাবে তিনি বললেন, তখন ফাংশনালি বিষয়টিকে দেখতে হবে। যেসব কাজে প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ আপেক্ষিকভাবে দক্ষ সেসব কাজ তাকে দিতে হবে। যেসব কাজে পাবলিক এন্টারপ্রাইজ দক্ষ সেটা তাদেরকে দিতে হবে। অনেকটা দেন জিয়াও পিং-এর তত্ত্বের মতো। বিড়াল সাদা না কালো সেটা আমরা দেখবো না। আমরা দেখবো বিড়াল ইঁদুর মারতে পারে কি না। যে বিড়ালটা ইঁদুর মারতে পারবে সে কালো বা সাদা হোক তাকে ব্যবহার করতে হবে। এটাকে আমরা বলি "নন ইডিওলজিক্যাল প্রাগমাটিক ইকোনমিক পলিসি"। গোঁড়া সমাজতন্ত্রীরা কিছুটা নন প্রাগমাটিক। তারা যে কোনো মূল্যে পাবলিক সেক্টর রক্ষা করতে চান। ক্যাপিটালিস্টরাও নন প্রাগমাটিক। তারাও যে কোন মূল্যে প্রাইভেট সেক্টর রক্ষা করতে চান। অর্থনীতির নতুন স্কুল অব থট হলো, প্রাগমাটিক। তারা বলছে, আমরা উত্তরনকালে বহুগাঠনিক মিশ্র অর্থনীতির ধারা অনুসরন করবো। মিশ্র অর্থনীতির মধ্যে কতটুকু পাবলিক বা কতটুকু প্রাইভেট হবে, কোন জায়গায় ভর্তুকি দেয়া হবে আবার কোথায় দেয়া হবে না, কোন জায়গায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে আবার কোথায় করা হবে না– এগুলো ভাবাদর্শের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। এগুলো পূর্ব নির্ধারিত কোনো ধ্রুব সিদ্ধান্তও নয়। এগুলো মূর্ত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে। কোথাও পাবলিক সেক্টর বেশি হবে আবার কোথাও প্রাইভেট খাতের প্রাধান্য বেশি হবে। চীনে যেমন পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা বেশি।

তারপরও চীনের অর্থনীতি কিন্তু অদক্ষ নয়। আবার আমাদের দেশে প্রাইভেট সেক্টরর প্রাধান্য অনেক বেশি, কিন্তু সেখানে লুটপাট চলছে। সুতরাং পাবলিক হলেই খারাপ বা প্রাইভেট হলেই যে ভালো হবে এমন সিদ্ধান্ত আমরা দিতে পারছি না। সে সময়ে স্টিগলিটজের উত্তরটা তাই আমাদের পছন্দ হয়েছিল।

রেহমান সোবহানের গবেষনা প্রকল্পটি ছিল সাউথ এশিয়ায় দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি বিষয়ক। সে প্রকল্পে আমার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশে যে বিভিন্ন ধরনের মালিকানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা। এর মধ্যে একটি ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী মালিকানা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠান। এটি হলো তৃণমূলের গ্রাহকদের মালিকানাধীন নিজস্ব ব্যাংক। এ ধরনের ব্যাংকের অস্তিত্ব তখন পৃথিবীতে ছিল না, এখনও নেই। তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে "কোম্পানি বাই গ্যারান্টিধর্মী" প্রতিষ্ঠানগুলোও পর্যালোচনার সুযোগ হয়েছিল। তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজগুলো দেখাশোনা করতেন ড. খালেদ শামস। তার সঙ্গেও আলোচনা করেছিলাম। তার একটা গবেষণাপত্র রয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। ফলে এ বিষয়ে আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। বর্তমানে এসব প্রশ্ন যখন নতুন করে উঠলো তখন মনোয়ার উদ্দিন স্যার আমাকে ডাকলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বলতে পারি, এইখানে ড. ইউনূসের একটা অস্পষ্টতা ছিল। ওগুলোর মালিকানা সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি এবং এগুলোর মুনাফা ব্যবহারের বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডের সদস্যদের সরাসরি কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। তবে, ড. ইউনূসের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অপ্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। কারণ তিনি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বলতে পারতেন যেহেতু আমি এখানে আছি সেহেতু ওদের স্বার্থটাও আমিই দেখবো। কিন্তু এতে যে অসুবিধা হয় সেটি হলো, এটি পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এখন ড. ইউনূস যদি সৎ থাকেন তো ভালো। আর তার মধ্যে যদি কোনো ধরনের অসততা সৃষ্টি হয় তাহলে এর পরিনতি ভালো হবে না। উদ্দেশ্য যেখানে সামাজিক কল্যাণ, সেখানে ব্যক্তির চরিত্রের ওপর নির্ভর করে এ ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতে পারে না। ইদানিং, মুনাফা বা ব্যক্তিগত মালিকানা ইউনূস সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন না বলেই সর্বত্র বলেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, প্রচলিত পুঁজিবাদও ব্যর্থ হয়েছে, তাঁর সোশাল এন্টারপ্রাইজ মডেলই সফল হবে।

কিন্তু, এ মডেলের দুর্বলতা হচ্ছে এর পুরোটাই ব্যক্তি পুঁজিপতির ওপর নির্ভরশীল। যেমন তার সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের যে কথা তিনি তার বইয়ে লিখেছেন তাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে দুটো দিক রয়েছে। একটা হলো স্বার্থপরতা বা লোভের দিক। আরেকটা হলো স্বার্থহীনতা বা সামাজিক স্বীকৃতির দিক। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার দিক। তিনি বলেন, ক্যাপিটালিস্টদের কাছে যদি দ্বিতীয় দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে তাদের ট্যাক্স দেয়ার দরকার নেই, রাষ্ট্রেরও দরকার নেই। তারা নিজেরাই তাদের শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করবে। তত্ত্বগতভাবে ড. ইউনূসের এই বক্তব্য যদি সত্য হয়, বাস্তবে সেটা কিন্তু অন্য অনেক মালিকের ক্ষেত্রে সত্য হচ্ছে না। যেমন, পোষাক শিল্পের মালিকদের ক্ষেত্রে সরকার তো আইন করে দিয়েছিল মুনাফার শতকরা ৫ ভাগ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলে দেয়ার জন্য। এটা দিলেও বছরে ৩৫০ কোটি টাকা দেয়ার কথা, তা কিন্তু তারা করছেন না। বরং তারা করছেন উল্টো। বিল গেটস বা এমন আর কয়েকজনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে আমরা পার পাবো না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে তার সুসভ্য ১ শতাংশ পুঁজিপতি গোষ্ঠী তার অতি মুনাফার তাড়নায় সৃষ্টি করেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট। সুতরাং, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। লোভের ব্যাপারটা আছেই। সুতরাং ড. ইউনূসের পরামর্শ মতো রাষ্ট্রকে যদি আমরা উঠিয়ে দেই আর ক্যাপিটালিস্টরা যদি ভালো না হয়, তাহলে তো তাদের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সে কারণে এই মডেলটার সমালোচনা তখনই করেছিলাম। বলেছিলাম, মালিকানার ইস্যুটা সংজ্ঞায়িত করতে হবে সর্বাগ্রে। কাংখিত মালিকানার প্রকৃতি এমন হতে পারে যেটা কেন্দ্রিভূতও হবে না , আমলাতান্ত্রিকও হবে না । অর্থাৎ এটা ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার পরিবর্তে কোন না কোন যৌথ বা সমবায়ী মালিকানার রূপ ধারন করতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিষ্ঠানের কর্মিরাই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার মালিক হতে পারে। শেয়ার যাতে অল্পকিছু লোকের হাতে কেন্দ্রিভূত হতে না পারে সে জন্যে যথায়থ আইনগত সীমাবন্ধন আরোপিত হতে পারে। আমাদের সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানার কথা বলা আছে। ১. রাষ্ট্রীয় মালিকানা ২. সমবায় মালিকানা ৩. আইন দ্বারা সীমাবদ্ধতাসহ ব্যক্তি মালিকানা। অর্থাৎ ব্যক্তি মালিকানাকে আমাদের সংবিধান কখনোই চরম স্বাধীনতা দেয়নি। আমাদের সংবিধান প্রথম থেকেই ব্যক্তি মালিকানাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু সেটি আমাদের এখানে কার্যকর হয়নি। রাষ্ট্রীয় মালিকানা ব্যর্থ হয়েছে তার অন্যতম কারণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বা শাসন পদ্ধতিকে আমরা কখনো বিকেন্দ্রীভূত করিনি। উদাহরণ স্বরূপ পাট কিনতে গেলে সেই ফাইল সেক্রেটারিয়েটে পাঠাতে হয়। আমলাতন্ত্র পেরিয়ে সে ফাইল আসতে আসতে পাটের মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এভাবে তো আর পাট কারখানা চলবে না। চীন এটা বুঝতে পেরেছিল।

তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে বিকেন্দ্রীভূত করে দিয়েছে। এখন তাদের যে সেক্টরটা ডাইনামিক, যেটি সারা বিশ্বের বাজার দখল করে আছে সেটা হচ্ছে চীনের মিউনিসিপ্যাল এন্ড টাউনশীপ ইন্ডাস্ট্রি। এর মাধ্যমেই দ্রুততম গতিতে শ্রমঘন পন্থায় গ্রাম গ্রামান্তরে চীনের শিল্পায়ন হয়েছে। তার মানে, স্থানীয় সরকারই জমির মালিক এবং সেটি তারাই বন্টন করে দেয়। সুতরাং নানা ধরনের ছোটখাটো শ্রমঘন শিল্পের মধ্যে তাদেরও একটা নির্ধারক শেয়ার থাকে। এ শেয়ারের কারণে একটা সামাজিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা পাহাড়াদার হিসেবে থাকে। আবার তারা যেহেতু নির্বাচিত, শুধু সরকারি আমলা নয় এবং তারা যেহেতু শেয়ার হোল্ডার; সুতরাং ব্যাক্তিগত প্রনোদনার সমস্যাও কম সেখানে। কারণ প্রতিষ্ঠান লাভজনক হলেই তাদের ব্যক্তিগত তহবিলে এবং মিউনিসিপ্যালিটির যৌথ তহবিলে অর্থ আসবে। শ্রমিকরাও যেহেতু সেখানে শেয়ার হোল্ডার সেহেতু বেতন নেয়ার পরও প্রতিষ্ঠান মুনাফা করলে তারাও এর একটি অংশ পায়। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকরাও খুশি থাকেন কারণ তারাও প্রতিষ্ঠানের মুনাফার অংশ পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে মুনাফাটা তাদের শেয়ার পুঁজির বর্ধিত মূল্য হিসেবে জমা হচ্ছে। তবে তাদের পুরো খুশির কারণ নেই, কেননা ওই টাকাটা ক্যাপিটালাইজড হচ্ছে, তাদের মধ্যে নিয়মানুয়ী ডিভিডেন্ট হিসেবে বন্টিত হচ্ছে না।

এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা সমস্যার সমাধানের জন্যে নানা ধরনের যৌথ মালিকানা মডেল তৈরি করা সম্ভব। এই বিকেন্দ্রীভূত যৌথ মালিকানার ব্যবস্থাকে নানা ধরনের ছোট-বড় এন্টারপ্রাইজের জন্য প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্নভাবে কাস্টমাইজ করা যায়। এই ব্যবস্থায় একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের নমনীয়তা বজায় থাকে, অন্যদিকে কর্মীদলের প্রণোদনাও রক্ষিত হয়। যেহেতু পৃথিবীতে কেন্দ্রীভূত সমাজতন্ত্রের একটা সংকট হয়েছিল এবং তারপর এর সংস্কার শুরু হয়, সেই সংস্কারের দিকটায় লক্ষ্য রেখে আমরা এই ধরনের মালিকানা মডেল নিয়ে গবেষণা করছি। গ্রামীণ ব্যাংক তাই আমাদের অন্যতম গবেষনার লক্ষবস্তু ছিলো। সেই হিসেবে আমি ড. ইউনূসের ইনোভেশন ও তার নোবেল প্রাপ্তিকে ছোটো করে দেখি না। কেউ কেউ হয়তো বলেন যে, তাঁর মডেলে তো অর্থনীতির কোনো ব্যাপার নাই, তিনি শুধু একটি প্রাতিষ্ঠনিক মডেল তৈরি করেছেন। তবে তার মডেলের সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হলো, এটা তার ব্যক্তিগত মালিকানায় নয়, এটি হলো যারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে উপকৃত হচ্ছেন তাদেরই। গ্রাহকরাই গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীদের নিয়োগ দিচ্ছেন। সেই গ্রাহকরাই এমডি হিসেবে ড. ইউনূসকে নিয়োগ দেবে নাকি অন্য কাউকে দেবেন সেটা তাদের বিবেচনা। সব সময় তো ড. ইউনূসের বুদ্ধি ও শারীরিক ক্ষমতা এক রকম থাকবেও না। বৃদ্ধ ইউনূসকে দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক চালাতে গেলে এক সময় গ্রাহকদেরই অসুবিধা হবে। তখন তাকে অপসারণ করে নতুন নেতৃত্বের হাতে গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই গতিশীল হতে হবে। ডঃ ইউনূস অপারগ হলে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা তাকে বাদ দেবে, এটাই নিয়ম। সরকারি নিয়ম অনুযায়ীও ডঃ ইউনূসের এমডি হওয়ার বয়স শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ডঃ ইউনূসের অভিমান করার বা মর্মাহত হওয়ার কোন যুক্তি নেই।

তবে সরকার আলোচনা করে এটার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারত, সেটা তারা করেনি। এটার অবশ্য একটি কারণ আছে। তা হলো, ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, তিনি ভুল করেছিলেন। কিন্তু ভুল করলে তো মাশুল দিতে হয়। কী ভুলটা তিনি করেছিলেন? ইয়াজউদ্দিন সাহেবকে তিনি একশ নাম্বার দিয়েছেন। একবার তিনি বলেছিলেন যে, হাসিনা-খালেদা উভয়ই পালাক্রমে কিছুদিন রাজত্ব করুক। এগুলোকে আমি অবিবেচনা-প্রসূত প্রস্তাবই বলব। সেগুলো বাস্তবসম্মত ছিল না এবং সঠিকও নয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, তিনি রাজনীতি বোঝেন না। সরলভাবে এক ধরনের স্বতঃস্ফুর্ত প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি যা করলেন অথবা সঙ্গীরা/সমর্থকরা তাঁকে দিয়ে যা করালো তা খুবই হাস্যকর। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী তিনি একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করবেন এবং সেই দল তিনি তৈরি করবেন এসএমএস পাঠিয়ে! তিনি ভাবলেন গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে তার সমর্থক। এটি ভাবা তার কোনমতেই ঠিক হয়নি। কারণ প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা রাজনৈতিক মতাদর্শ রয়েছে। হয়তো ওখানেও শতকরা ৪০ ভাগ বিএনপি, ৪০ ভাগ আওয়ামী লীগ এবং বাকি ২০ ভাগ বাম ও অন্যান্য– এরকম হবে। এ কারণেই তার রাজনৈতিক প্রোজেক্টটা ব্যর্থ হলো। এর মাধ্যমে তিনি তার অন্তত একটা প্রতিপক্ষ হিসেবে শেখ হাসিনাকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানালেন এবং তার চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। সম্ভাবতঃ সে কারণে এখনও তিনি তাদের কোপানল থেকে বার হতে পারেন নি। আমার ধারনা এরই ধারাবাহিকতায় এসব ঘটনা ঘটেছে। এসবের সমাধান কী? প্রধান ও প্রথম সমাধান হলো, গ্রামীণ ব্যাংককে সকল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনগত ও নৈতিক লঙ্ঘন থেকে মুক্ত রাখা। কারণ, সত্যিই এটি একটি অনন্য প্রাতিষ্ঠানিক মডেল। এর একটি কার্যকারিতাও প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য ড. ইউনূসকেও আইন মানতে হবে, সরকারকেও গ্রামীণ ব্যাংকের আইন মানতে হবে। ওটাকে ম্যানিপুলেট করে ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত করার চেষ্টা করলে সুফল আসবে না। ড. ইউনূসকেও মানতে হবে আইন অনুযায়ীই গ্রামীণ ব্যাংক চলবে। যদি কোনো কারণে সরকার এর মালিকানা বদলে সরকারীকরণ করতে চায় তখন তিনি শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেন। আমার ধারনা তখন তিনি আইনেরও সমর্থন পাবেন।

এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।