নারীর নীরব মৃত্যু: সভ্যতা আর বিবেক যখন নর্দমায়

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 3 August 2012, 12:57 PM
Updated : 3 August 2012, 12:57 PM

খবরটি ছিল শহরের যাত্রাবাড়ি এলাকায় একটি ডাষ্টবিন থেকে ৪ নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধার । হ্যাঁ, নবজাতকরা ছিল মানব নবজাতক। সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তার ধারনা মতে আশেপাশের কোন ক্লিনিকে গর্ভপাত ঘটিয়ে মৃতদেহগুলো ডাষ্টবিনে ফেলে রাখা হয়েছে ।

গর্ভপাত কতটা নৈতিক আর অনৈতিক আমি সেই বিচারে যাচ্ছি না। গর্ভপাতের পক্ষে আর বিপক্ষে পৃথিবী দ্বিধা বিভক্ত সেই ম্যালথাসের আমল থেকেই । আমার প্রশ্ন হলো, ডাষ্টবিনে কী পরে ছিল—- মানব শিশু নাকি মানব বিবেক? সভ্যতা আর স্বাধীনতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে—আস্তাকুঁড়ে?

বেসরকারী হিসেব মতে আমাদের এই অতি প্রিয় ঢাকা শহরে প্রায় ৫০০ নার্সিং হোমে/ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে অন্ততঃ ৩০০ গর্ভপাত হয় । এর মধ্যে কতটি গর্ভপাত আইন মেনে বৈধ উপায়ে সঠিক পন্থায় করা হয় তা স্পষ্টতঃই অজানা; বোধকরি এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছেও নেই । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিভিন্ন গবেষনায় পাওয়া তথ্য মতে বাংলদেশে যত মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার ১৫% মৃত্যুর জন্য দায়ী অনিরাপদ গর্ভপাত এবং তদসংক্রান্ত জটিলতা । বেসরকারী হিসাব মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২১,০০০ মা সন্তান জন্মদান সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যায়, সুতরাং ১৫% অর্থাৎ ৩১৫০ জন মা মারা যাচ্ছে বছরে শুধুমাত্র অনিরাপদ গর্ভপাতের কারনে—-এটা কি চলমান সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় মৃত্যুবরণকারী যে কোন সংখ্যার চেয়ে কম ভীতিপ্রদ ? দেশে চলমান অপঘাতে মৃত্যুর মিছিলে এ এক নীরব সংযোজন । এ তো গেল মায়ের মৃত্যু— পূর্বাপর শিশুর মৃত্যুর হিসাব তো নর্দমা আর আস্তাকুঁড়ে সকলের অলক্ষ্যে মিলয়ে যায় ।

বাংলাদেশে গর্ভপাত কি আইনসিদ্ধ ? কিছু বিশেষ অবস্থায় বাংলাদেশে গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে । বাংলাদেশে প্রচলিত গর্ভপাত আইনটি মূলতঃ পেনাল কোড অব ইন্ডিয়া ১৮৬০ এর উপর ভিত্তি করে প্রনীত এবং এর ধারা ৩১২-৩১৬ কিছু বিশেষ অবস্থায় এবং পরিপ্রেক্ষিতে গর্ভপাতকে বৈধ করে । স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী নরপশুদের গনধর্ষনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ আইনটি গ্রহন করে । এখানে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে যা খেয়াল করার বিষয় তা হলো শুধুমাত্র মায়ের মৃত্যু ঝুঁকির মত পরিস্থিতি তৈরি হলেই গর্ভ ধারনের ৮ সপ্তাহের মধ্যে মিনিস্ট্রুয়াল রেগুলেশন করা যাবে । এক্ষেত্রে অন্ততঃ দুই জন রেজিস্টার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডাক্তার বা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত প্যারামেডিক ব্যতিরেকে এটি সম্পন্ন করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ । বাংলাদেশে গর্ভপাতকে কখনোই পরিবার পরিকল্পনার উপায় হিসেবে দেখা হয়নি এবং কোন নারীকে তার অমতে গর্ভপাতে বাধ্য করা হলে দোষী ব্যক্তির ১০ বছরের জেল দেয়ার বিধান রয়েছে।

গর্ভপাত নিয়ে আমার এই অবতারনা কম বেশী সকলের জানা আছে ; তবে কেন এই নীরবতা । তবে কি প্রচলিত অভ্যাসে মানবতা শংকাহীন ? তবে কি নর্দমায় মানব অবয়বে দৃশ্যমান ঐ নিথর দেহগুলোও মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না ? ভেজালের ভিড়ে আমাদের মানবিক অনুভূতিগলোতেও কি তাহলে পচন ধরেছে ? প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে তবে কে কী করলেন ? রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্ংস্থা কি আদৌ বিষয়টা আমলে নিয়েছেন ?

এই বিশেষ ঘটনাটি যদি পর্যালোচনা করি, এর সাথে কয়টি পক্ষ সরাসরি জড়িত ? যে নারী গর্ভপাত করিয়েছে এবং তার পরিবার (যদি পরিবার থেকে থাকে), যারা বা যে স্থানে গর্ভপাতের ঘটনাটি ঘটেছে এবং গর্ভপাতের প্রক্রিয়াটি কতটা স্বাস্থ্য সম্মত ছিল ? এরপর আসে আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং অপরাপর বিষয় সমূহ । যিনি বা যার গর্ভপাতটি করতে হয়েছে, তিনি কি এটা স্ব-ইচ্ছায় করেছেন ? কেন তিনি গর্ভপাত করালেন ? গর্ভপাত করানো ছাড়া অন্য কোন উপায়ে কি তিনি অনাকাঙ্খিত গর্ভধারনটি রোধ করতে পারতেন না ? তার গর্ভপাতটি কি স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে হয়েছে ? এতে ঐ নারীর কি কোন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রযেছে ? গর্ভপাতটি কি প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে ? গর্ভপাত অথবা প্রসব সম্পন্ন হওয়ার পরে নবজাতকের মৃতদেহটি কেন নর্দমায় ফেলে দেয়া হলো ? এতে সংশ্লিষ্ট ঐ নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ? যে ক্লিনিক বা প্রতিষ্ঠান গর্ভপাতটি করিয়েছে, তাদের কি আইনগত আনুমোদন আছে ? গর্ভপাত করানোর আগে তারা কি চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় ? গর্ভপাত করানোর জন্য তি তারা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ করে ? গর্ভপাত করানো সংক্রান্ত কোন জবাবদিহিতার পর্যায় কি তাদের সম্মুখীন হতে হয় ? তারা প্রতিটি গর্ভপাত থেকে কী পরিমান মুনাফা লাভ করে ? এমনি অপরাপর অনেক অনেক প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়।

আমাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও আচার আমাদেরকে এসব বিষয়ে নীরব থাকতে উৎসাহিত করে । কিন্তু এই নীরবতা তো এখন জগদ্দল পাথরের মতই চেপে বসেছে। এখন আবার আমাদের ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক আগ্রহ-অনাগ্রহ-শিষ্টাচার, দাতা সংস্থাদের উৎসাহ-অগ্রাধিকার ইত্যাদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে আমাদের জনসংখ্যা সমস্যা এবং এর জন্য প্রনীত সকল আইন-কানুন-নীতির সাথে । তা না হলে বাংলাদেশের মত একটি দেশ যেখানে জনসংখ্যা প্রথম এবং প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়ার কথা, সেখানে জনসংখ্যা নিয়ে সরকারী কাজকর্ম এত স্তিমিত কেন ? দাতা সংস্থারা জনসংখ্যা খাতে টাকা ঢালতে নিরুৎসাহী কেন ? কোন সামাজিক রাজনৈতিক বিতর্কে জনসংখ্যা নিয়ে টু শব্দটি নেই কেন ? আনমেট নিড (যারা জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ব্যবহার করতে চায় কিন্তু তা সরবরাহের অভাবে সংগ্রহ করতে পারে না) প্রতি বছর বাড়ছে কেন ? আমরা যদি প্রত্যেক শিশুর হাতে বই দিতে পারি, সকলকে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশনের আওতায় আনতে পারি, তবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা খরচ করে জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী কিনে আনতে পারবো না কেন ? এজন্য কেন আমরা প্রতি বছর বিদেশী ঋনের টাকার উপর নির্ভর করবো ?

আমরা গরীব, আমাদের নারীরা আরও গরীব…গরীবতর । এদেশে মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে কম…মানুষ মরে বেশুমার…ট্রাকের নীচে, বাসের নীচে, লঞ্চ ডুবে, পাহাড় ধসে, মিছিলে মিটিং এ, পুলিশের অত্যাচারে, নীরবে গোপনে গুম হয়ে, সীমান্তে পাশের দেশের বড় ভাইদের গুলিতে….আর নারীর জীবনের মূল্য তো প্রশ্নাতীত ভাবে নগন্য…। তাইতো এ দেশের নারীদের অনাগত সন্তানদের যার যখন খুশী গলা টিপে হত্যা করে নর্দমায় ফেলে দেয়ার অধিকার আছে । এদেশের নারীরা গরীব, তাদের শিক্ষা নেই, অর্থ নেই, তারা মানবাধিকারের জটিল তত্ত্ব বুঝে না, তাই তাদের জরায়ু ক্ষত বিক্ষত করার অধিকার পেয়ে যায় সবাই, কারন এজন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, ভীত হতে হয় না । গরীব আসহায় অবুঝ এই নারীর আবেগ অনুভূতি ভালবাসা সব অন্যের কাছে, কখনও স্বামী, কখনও পিতা, কখনও সমাজ, কখনও রাষ্ট্র কখনও বা আন্তর্জাতিক আগ্রহ আর স্বার্থের কাছে বরগা দেয়া–যে যখন খুশি দুমড়ে মুচড়ে নর্দমায় নিয়ে ফেলে।

আমি সন্তান জন্ম দিব কি দিব না……জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহন করবো কি করবো না…..এটা আমার অধিকার …এটা আমার জরায়ুর অধিকার…এটা মানবাধিকার । রাষ্ট্র আমার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহনের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ এবং আমাকে নিয়ে আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমার জরায়ুকে নিয়ে যারা মুনাফা করছে তাদেরকে আইনগতভাবে প্রতিহত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ । যদি আমরা নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবী করি, তবে নারীকে নিয়ে নীরব মৃত্যুর এই কারবারের পিছনের নীরবতা ভেঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে…জোড়ালো আওয়াজ। রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের সজাগ হতে বাধ্য করুন । নয়তো সভ্যতা আর বিবেককে একদিন খুঁজতে হবে নর্দমায় ।

মাসুমা বিল্লাহ: গবেষক, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত।