হুমায়ূন আহমেদ: মধ্যবিত্ত বাঙালির আনন্দ-বেদনার অপরূপ রূপকার

লুৎফর রহমান রিটন
Published : 14 Feb 2011, 07:00 AM
Updated : 20 July 2012, 10:58 AM

তখন বাংলাদেশে কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিলো না। টিভি বলতে বাঙালির ছিল সবেধন নীলমনি বিটিভি। এবং বিটিভির শাদাকালো আমলে বাঙালির একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলো। সেই হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব সুখি ছিলো। বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার অপরূপ রূপকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসব হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আনন্দময় হতো না, পরিপূর্ণতা পেতো না। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসবে পোলাও-কোর্মা, ফিন্নি-শেমাই এবং নতুন জামা-কাপড়ের সঙ্গে হুমায়ূনের ঈদের নাটকও ছিলো একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

ঈদের সারা দিনের নানান সামাজিক-পারিবারিক আমন্ত্রন-নিমন্ত্রন, সৌজন্য-সাক্ষাৎ, ভোজের আয়োজন এবং অতিথি আপ্যায়নের বিচিত্র ঝক্কি-ঝামেলার পর সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে আয়েস করে বসে বাঙালি অপেক্ষা করতো হুমায়ূনের নাটকের। সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে যেতো। একজন হুমায়ূন আহমেদের একটি টিভি নাটক দেখার জন্যে বাঙালির সম্মিলিত অপেক্ষার সেই চিত্রটি ছিলো অকল্পনীয়।

না, শুধু রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিলো না এটা। পুরো বাংলাদেশেরই ছিলো একই অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটকটি ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম প্রধান বিনোদন মাধ্যম। ফাঁকা রাস্তা। হুমায়ূনের নাটক চলছে বিটিভিতে। বিভিন্ন বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত আনন্দময় হাস্যধ্বনি শোনা যেতো। মাঝে মাঝেই অট্টহাসির উল্লাসধ্বনিও জানান দিতো যে হুমায়ূন আহমেদ নামক একজন জাদুকরলেখক-নাট্যকারের ঈদের নাটকটি বাঙালি উপভোগ করছে। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটেছে বছরের পর বছর।

ঈদের বিশেষ নাটক ছাড়াও হুমায়ূনের কোনো সাপ্তাহিক কিংবা ধারাবাহিক নাটক প্রচারের রাতেও একই পরিস্থিতি। রাস্তা ফাঁকা। বাড়ির অধিকাংশ সদস্যই টিভি সেটের সামনে। শুধু হাসির নাটক নয়, হুমায়ূনের দুঃখের বা কষ্টের নাটকও বাঙালি মধ্যবিত্তের চিত্তকে হরণ করতো অনায়াস দক্ষতায়। বিটিভিতে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' তো ইতিহাস সৃষ্টিকারী। এই নাটকের ছোট্ট মেয়েটি—টুনি, ক্যান্সারে যার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু দর্শক সেটা মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রিয় মেয়েটিকে মেরে না ফেলতে দর্শকরা কতো ভাবেই না অনুরোধ জানালো নাট্যকার হুমায়ূনকে! কিন্তু হুমায়ূন জেদী। তিনি টুনিকে মেরেই ফেললেন। ফলে, তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও মিছিল হলো। ব্যানারে লেখা—টুনির কেনো মৃত্যু হলো/হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই।

বিটিভিতে হুমায়ূনের আরেকটি ধারাবাহিক নাটক 'কোথাও কেউ নেই' প্রচারের সময়েও ঘটেছে একই কাণ্ড। এই নাটকে 'বাকের ভাই' নামের চরিত্রটির ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতেও মিছিল হলো। পত্রিকায় সে খবর ছাপাও হলো। জেদী হুমায়ূন বাকের ভাইকেও বাঁচালেন না। নাটকের প্রয়োজনে বাকেরকে মরতেই হবে। হুমায়ূন তাকে মারলেনই। দর্শকদের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে নাটক বা গল্পের দাবিকেই মিটিয়েছেন নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশে টিভি নাটকের ইতিহাসে এইরকম ঘটনা আর কোনো লেখক-নাট্যকারের ক্ষেত্রে ঘটেনি।

এরপর বাংলাদেশে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এসেছে। হুমায়ূন আহমেদকে বিভিন্ন চ্যানেল পাকড়াও করেছে। নাটক চাই। তিনিও লিখেছেন।

হুমায়ূনের নাটক ছাড়া তো ঈদের আনন্দ পূর্ণ হবার নয়!

বাঙালির ঈদ বিনোদনের আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। আর ঈদ সংখ্যারও প্রধান আকর্ষণ সেই একই ব্যাক্তি, হুমায়ূন আহমেদ। কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস থাকা মানেই সেটি বিপুল পরিমানে বিক্রি হবার ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিন্ত গ্যারান্টিসিল। সুতরাং হুমায়ূনের একটি উপন্যাসের জন্যে পত্রিকার মালিক-সম্পাদকের ছুটোছুটির অন্ত ছিলো না।

হুমায়ূনের উপন্যাস ছাড়া তো ঈদ সংখ্যাও পরিপূর্ণ নয়!

বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলা হুমায়ূন আহমদকে ছাড়া কি কল্পনা করা যায়? একজন হুমায়ূন আহমেদকে সামনা সামনি এক ঝলক দেখতে, তাঁর লেখা একটি বই কিনতে এবং বইতে তাঁর একটি অটোগ্রাফ পেতে বাঙালি ভিড় করেছে বইমেলায়। সেই ভিড় সামাল দিতে কর্তৃপক্ষকে পুলিশি সহায়তা নিতে হয়েছে প্রতিবছর। একবার তো এক মহাপরিচালক হুমায়ূন আহমেদকে নিষেধই করেছিলেন যেনো তিনি বইমেলায় না আসেন! কী হাস্যকর!!

একুশের বইমেলায় বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট বইয়ের স্টলের সামনে আমরা দেখেছি সহস্র পাঠকের জমাট অপেক্ষা। উদ্দেশ্য—হুমায়ূনের সাম্প্রতিক বইটি সংগ্রহ করা! বাংলাদেশে আর কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি।হুমায়ূনের বই ছাড়া তো একুশের বইমেলাও পরিপূর্ণ নয়!

তাঁর মতো আর কে পেরেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অনুভূতিগুলোতে এতটা মমতার সঙ্গে আলো ফেলতে? তার চে বেশি কে চিনেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরদিনের টানাপড়েনগুলো? বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনা আর হাসি-কান্নার সঙ্গে একজন হুমায়ূন আহমেদ জড়িয়ে আছেন চারটি দশক ধরে একই ধারাবাহিকতায়!

হুমায়ূনহীন ঈদের টিভি, হুমায়ূনহীন ঈদ সংখ্যা আর হুমায়ূনহীন একুশের বইমেলাকে বাঙালি কী ভাবে উদযাপন করবে!
আজ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানাচ্ছি বাঙালির প্রিয় কথক হুমায়ূন আহমেদকে।

অটোয়া, কানাডা; ২০ জুলাই, ২০১২