জরিপ বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের যুবসমাজ বেশি রক্ষণশীল

রেইনার এবার্ট
Published : 8 July 2012, 03:35 PM
Updated : 8 July 2012, 03:35 PM

আমার বেশিরভাগ বাংলাদেশি বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন তাদের স্বদেশিদের বিয়ে-পূর্ব যৌন-সংসর্গে জড়িত হওয়ার ব্যাপারটি জোরালোভাবে অস্বীকার করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমার অনেক অবিবাহিত বন্ধু আমাকে জানিয়েছে যে. তারা যৌন-সংসর্গে সক্রিয়। এটা আমার ধারণা যে, বাংলাদেশি স্কুলগুলোতে অংশত সমন্বিত যৌনশিক্ষার অভাবে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবিবাহিত মেয়ে তাদের কিশোরী-জীবনেই গর্ভবতী হয়। কয়েক মাস আগেও এ রকম পরিস্থিতিতে যদি কোনো নারী বন্ধু আমার কাছে জানতে চাইত তার গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা কার সঙ্গে তারা শেয়ার করবে, আমি তাকে তার বয়সী মানুষের সঙ্গেই প্রথম কথা বলার জন্য পরামর্শ দিতাম।

সপ্তাহ খানেক আগে, সম্ভবত বাংলাদেশে এই প্রথম নৈতিক বিশ্বাসের ওপর একটি জরিপে অংশ নেওয়ার জন্য আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। পনেরশর বেশি পাঠক আমার এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মোট ৩৭টি নৈতিক ও সামাজিক সুনীতি প্রশ্নে তাদের মতামত জানিয়ে এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।

জন্মনিয়ন্ত্রণ, ভালোবেসে বিয়ে এবং প্রাণি-মাংস ভক্ষণের প্রশ্নে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি ইতিবাচক উত্তরের মধ্য দিয়ে তারা ভার্চুয়ালি প্রণিধানযোগ্য কোনো ইস্যু হিসেবে এগুলো নাকচ করে দেন। উত্তরদাতারা বিস্তৃত অর্থে পারিবারিক বিয়ে (শতকরা ৭৫ ভাগ) ও বিয়ে-বিচ্ছেদকেও (শতকরা ৭১ ভাগ) ব্যাপকার্থে স্বীকৃতি দেন।

বাল্যবিয়ে, সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদান, নিজ রক্তসম্পর্কের সঙ্গে যৌন-সংসর্গ (Incest) এবং পরিবেশ দূষণ– এগুলোর কোনোটাই শতকরা পাঁচ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। গড়ে প্রতি দশ জনের মাত্র একজন উত্তরদাতা পরকীয়া, পারিবারিক শিশু শ্রমিক, আত্মহত্যা অথবা স্কুলে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র-নিপীড়ন সমর্থন করেন।

তবে ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে বাড়িতে কাজ করে এমন হাজার হাজার শিশু-শ্রমিক রয়েছে; যেখানে কিনা বারো বছরের নিচে বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন শিশুদের ব্যাপারেও গৃহকর্তা বা কর্ত্রীদের বিবেকের তাড়নাটা খুব সহজেই অতিক্রম করেন তারা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ঘুষ এবং পরিবেশ দূষণ-সংক্রান্ত নৈতিক লজ্জাবোধও তাদের নাড়া দেয় না।

বাংলাদেশে আইন করে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রায় ত্রিশ বছরেরও উপর হতে চলল। এই জরিপে সবচেয়ে কম উত্তরদাতা এর পক্ষে রায় দিয়েছে। ৯৭ ভাগ বলেছেন, যৌতুক অনৈতিক। যৌতুকের বিরুদ্ধে জরিপে এই রায় বাংলাদশ সরকার ও এ দেশের এনজিওগুলোর যৌতুক-বিরোধী প্রচারণার একটি স্বতঃস্ফূর্ত সফলতা।

তবে এই প্রশংসনীয় সফলতা শেষ অর্থে যেমন চূড়ান্ত কোনো ফল বয়ে আনেনি, তেমনি যৌতুক-সংক্রান্ত সহিংসতা এখনও চলমান। অ্যামনেস্টি ইন্টারনেশনালের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এখনও যৌতুক-সংক্রান্ত সহিংসতার হাজার হাজার অভিযোগ পুলিশের কাছে জমা পড়ে এবং মেয়েপক্ষের পরিবার যৌতুকের দাবি মিটাতে ব্যর্থ হলে এখনও অসংখ্য নারী যৌতুকের বলি হিসেবে মৃত্যুবরণ করে।

প্রাণি-কল্যাণ অধিকারের বিষয়ে নৈতিক গুরুত্বটি সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে প্রমাণিত হয়ে আসছে। প্রাণিজাত পশমের পোষাক যে সর্বজনীনভাবে অনৈতিক, এই জরিপে গড়ে দশ জনের মধ্যে চার জনই এর সঙ্গে একমত নন। তবে ৩৫ থেকে ৪৫ ভাগ অংশগ্রহণকারীর কাছে প্রাণির ওপর কসমেটিক পরীক্ষার বিষয়টি গ্রহযোগ্য নয়। প্রাণিঅধিকার-সংক্রান্ত ইস্যুটিতে লিঙ্গভেদে সুক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়। একদিকে এই জরিপে যেখানে নারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মনে করেন প্রাণির ওপর মেডিকাল পরীক্ষাটি নৈতিক (৪৭%), সেখানে ৬৮% পুরুষের মত হচ্ছে, গবেষণাগারে প্রাণির ওপর নির্মম যন্ত্রণার মূল্যে হলেও মানবজাতির লাভের দিকটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। প্রাণিজাত লোমশ পোষাক পরিধানের বিরুদ্ধে নারীদের মতামত বেশ ক্ষীণ (নারী: ২৫%; পুরুষ: ৪২%)।

অন্যদিকে জরিপে আরও দেখা যাচ্ছে, পর্ণোগ্রাফির পক্ষে (নারী: ১২%; পুরুষ: ২৭%), পারিবারিক বিয়ের পক্ষে (নারী: ৬৭%; পুরুষ: ৭৭%) এবং পরকীয়া সম্পর্কের পক্ষে (নারী: ৪%; পুরুষ: ১১%)। একদিকে যেমন বেশিরভাগ নারী ও পুরুষের মতে বাবা-মা কর্তৃক সন্তানকে শাস্তি প্রদান সমর্থনযোগ্য– অন্যদিকে তারা স্কুলে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের শাস্তি প্রদানের বিরোধী। এই জরিপে পঁচিশ জনের মধ্যে মাত্র একজন নারীর মতে, স্কুলে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের শাস্তি প্রদান গ্রহণযোগ্য। পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে এই সমর্থনের হার তিনগুণ বেশি।

এদিকে পুরুষদের চেয়ে নারীদের কাছে দেহ উন্মোচনকারী পোষাক পরিধান তুলনামূলকভাবে বেশি সমর্থিত, যদিও এই সমর্থনের পার্থক্যটা খুব বেশি নয় (নারী: ৩০%; পুরুষ: ২৮%)।

ধর্মান্তর, মৃত্যুদণ্ড, বিয়ে-পূর্ব নারী-পুরুষের মেলামেশা এবং বিয়ে-পূর্ব যৌন-সংসর্গের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উত্তরদাতার মতামত এগুলোর বিপক্ষে। শতকরা ছাপান্ন ভাগ মনে করেন যে, শুধুমাত্র বিয়ের পরই যৌন-সংসর্গে যাওয়া উচিৎ। শতকরা ছত্রিশ ভাগের কাছে অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন-সংসর্গ গ্রহণীয়।

আশ্চর্যজনকভাবে, এই জরিপে বয়সভিত্তিক মতপার্থক্যগুলো প্রণিধানযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, কমবয়সীদের মধ্যে যৌনাচার ও নেশা করার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গী বেশি উদার। অথচ দৃশ্যটা বিপরীত! সম্ভবত তাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে নিজেদের ওপর যুবসম্প্রদায় ওই সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দিতে বাধ্য হয়। জরিপে অংশ নেওয়া পঁচিশ বা তাদের নিচের বয়সীরা নৈতিক বিশ্বাসের নিরিখে গর্ভপাতের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে।

অন্যদিকে, জরিপে ৩৭%– যাদের বয়স ৩৬ বা তার বেশি– তারা মনে করেন যে গর্ভপাত নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য। এই তরুণদের বয়স ২৫ বা তার নিচে।

জরিপে দুই দল মুসলমানের মধ্যে বিস্তৃত ধর্মীয় পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষত একদিকে যারা সামাজিকভাবে রক্ষণশীল এবং অন্যদিকে যারা উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর আর সাধারণত ধর্ম সম্পর্কে কম সংবেদনশীল। অন্যদিকে, জরিপে অংশ নেওয়া বিশাল সংখ্যক যারা কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়– তারা বিয়ে-পূর্ব যৌন-সংসর্গ, বিয়ে-বহির্ভুত গর্ভধারণ, স্বল্পবাস বা নগ্নতা এবং সমকামিতা সমর্থন করে। গড়ে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জনেরও কম মুসলমান এগুলো নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এর মাঝামাঝি অবস্থানে আছে।

এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, তামাক গ্রহণে মুসলমানরা তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মাত্র শতকরা বিশ ভাগ অ্যালকোহল গ্রহণে সমর্থন জানায় (হিন্দু: ৪৬%; অধার্মিক: ৭২%) এবং শতকরা ২৯ ভাগ ধুমপানের পক্ষে (হিন্দু: ৩২%; অধার্মিক: ৪৬%)।

হিন্দু (৪/১৫%) এবং অধার্মিক ব্যক্তির (৩/১২%) চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান (১২%) স্কুলে দৈহিক শাস্তি সমর্থন করে। হিন্দুরা স্বধর্ম ত্যাগে মুসলমানদের চেয়ে কম সহনশীল। এই জরিপে দেখা গেছে যে, শতকরা চল্লিশ ভাগ হিন্দু এবং পঁয়তাল্লিশ ভাগ মুসলমান বিশ্বাস করে যে, একজন ব্যক্তির পক্ষে তার নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করা নৈতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য (অধার্মিক ব্যক্তি: ৯৩%)।

যারা বাংলাদেশে বসবাস করে তাদের চেয়ে অভিবাসীরা যৌনতা এবং রোমান্স, তার সঙ্গে অ্যলকোহল ও তামাক ব্যবহারের ব্যাপারে অনেক বেশি পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, নিজ দেশের বাইরে বসবাসরত গড়ে দশ জন বাংলাদেশির সাত জনই ডেটিং করা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করে– দেশে বসবাসরত ৫০%এর তুলনায়। ৩৮% অভিবাসী, দেশে বসবাসরত ২৭%এর তুলনায় অ্যালকোহলের অনুমোদন দেয়। এদের মাত্র ২% বাল্যবিয়ে এবং ৪% শিশুশ্রম সমর্থন দিলেও অভিবাসীরা শিশু-অধিকার সম্পর্কে তাদের দেশীয়দের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।

জুয়ার ব্যাপারে আমেরিকান এবং বাংলাদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য অনেক বেশি। The 2011 Gallup poll on American values and beliefsএ দেখা গেছে যে, ৬৪% আমেরিকান জুয়া নৈতিকভাবে সমর্থন করে। সেই তুলনায় ১২% বাংলাদেশির মধ্যে (এই জরিপে) জুয়ার ব্যাপারে সাময়িক দুর্বলতাও নেই।

এই দুই জাতির মধ্যে সমকামিতা এবং বিয়ে-পূর্ব যৌন-সংসর্গ নিয়েও পুরোপুরি বিপরীত মনোভাব রয়েছে। যেখানে বেশিরভাগ আমেরিকানই সমকামিতা এবং অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন-সংসর্গকে (৫৪/৫৯%) সমর্থন দেয়, সেখানে এই জরিপে দেখা গেছে অত্যন্ত অল্প সংখ্যক বাংলাদেশি একে সমর্থন দেয় (২৫/৩৬%)।

জরিপে আমেরিকানদের চেয়ে বাংলাদেশিদের ছাঁচে ঢালা হতে বেশি দেখা গেছে। দুই দেশের অংশগ্রহণকারীদেরই ৬০%এর কিছু কম অর্থাৎ আমেরিকান এবং বাংলাদেশিরা এই ব্যাপারে একমত যে, রাষ্ট্র কিছু বিশেষ অপরাধের জন্য মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে।

২০১২ সালের ১২ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অনলাইন জরিপে দেখা যায় যে, ইন্টারনেট বাংলাদেশি জনসংখ্যার মাত্র ৫ ভাগের হাতের নাগালে রয়েছে। সব সময় নারীদের কম তুলে ধরা হয়েছে, উচ্চশিক্ষিতদের বেশি তুলে ধরা হয়েছে এবং কোনো সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হয়নি। ফলে এটা গড় বাংলাদেশি নাগরিকের প্রতিনিধিত্ত্ব করেনি।

আপনি যদি একজন বাংলাদেশি গবেষক হন এবং যদি মনে করেন আপনার প্রতিষ্ঠান এই জরিপ সফল করতে ও বাংলাদেশি নৈতিকতার ওপর গভীর অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করতে আগ্রহী, তাহলে সাড়া দিন। আমরা খুশি হব।

জরিপে অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা রইল।

[ভাষান্তর: সেলিম তাহের]