ওবামার জন্যে সুসংবাদ

Published : 3 July 2012, 03:39 PM
Updated : 3 July 2012, 03:39 PM

প্রেসিডেন্ট ওবামার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসম্পন্ন স্বাস্থ্য-বীমা সংক্রান্ত আইন দেশের সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছে। ২০১০ সালে আইন হিসেবে চালু হওয়া স্বাস্থ্য-বীমা খাতে ওবামা প্রশাসনের এই সংস্কারের অন্যতম দিক হল দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জন্য স্বাস্থ্য-পরিচর্যার সুবিধা নিশ্চিত করা। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বারাক ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দেশের স্বাস্থ্য-পরিচর্যার ক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন। আশা করা হচ্ছিল যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে ধরনের সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা আছে, যুক্তরাষ্ট্রেও তিনি তাই চালু করবেন। পৃথিবীর শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক দেশ যার ১৬ শতাংশের বেশি অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষ এ রকম স্বাস্থ্য-সুবিধা লাভ করেন না।

প্রেসিডেন্ট ওবামা সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা চালু করতে চাইলেও, দেশের স্বাস্থ্য-বীমা কোম্পানি, চিকিৎসকদের একাংশ এবং রিপাবলিকান পার্টি তার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়। মন্দের ভালো হিসেবে অনেক আপোষ-সমঝোতার মাধ্যমে ২০০৯ সালে কংগ্রেস পাশ করে 'এফর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট।' এর আওতায় সবার জন্য স্বাস্থ্য-বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়, অন্যথায় জরিমানার বিধান রাখা হয়। এতে কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য-বীমার আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হয়। কোনও ব্যক্তির বীমা কেনার সামর্থ্য না থাকলে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য-বীমা প্রদানেরও যে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে এ সব ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা হয়। এই আইনের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল যে, কোনও স্বাস্থ্য-বীমা কোম্পানি অতীতের অসুস্থতার জন্যে কোনও ব্যক্তিকে বীমা প্রদানে অস্বীকার করতে পারবে না বা বীমা থাকা অবস্থায় অসুস্থতার জন্য তার প্রিমিয়াম বাড়াতে পারবে না, তার বীমা বাতিল করতে পারবে না।

আইনটি পাশ হওয়ার আগে থেকেই রিপাবলিকান পার্টি এর বিরোধিতা করছিল। ২০১০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তারা বিষয়টিকে প্রধান ইস্যুতে পরিণত করে এবং কংগ্রেসের নির্বাচনে সাফল্য লাভ করতে সম্ভব হয়। বলা দরকার যে, ওবামার এই স্বাস্থ্য-বীমা সংস্কার কেবল রিপাবলিকান দলেরই বিরোধিতার মুখোমুখি হয় তা নয়, প্রেসিডেন্টের নিজের দলের রক্ষণশীলরাও এর বিরোধিতা করে। অন্যদিকে ওবামার সমর্থক উদারপন্থীরা এই সীমিত সংস্কারের সমালোচনা করে এই বলে যে, তা সকলের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না, বরং বীমা কোম্পানি ও ওষুধ কোম্পানির ঘরে লাভ তুলে দেবে।

এই পটভূমিকায় দেশের ২৬টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত রিপাবলিকান প্রশাসন এবং একটি ব্যবসায়ী সংগঠন দেশের সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয় এই বলে যে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও কিছু কিনতে নাগরিকদের বাধ্য করতে পারে না। ফলে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য-বীমার যে বিধান রাখা হচ্ছে তা অসাংবিধানিক। মনে রাখা দরকার যে, স্বাস্থ্য-বীমার অন্যান্য বিধান বাস্তবায়নের জন্য দরকার এই বাধ্যতামূলক বীমার বিধান রাখা। সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে মামলা রুজু হওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণে অনুমান করার চেষ্টা করা হয় আদালত একে অসাংবিধানিক বলবে কিনা। প্রধান বিচারপতিসহ নয়জন বিচারকের মধ্যে চার জন উদারপন্থী বলে পরিচিত। বাকি ৪জন রক্ষণশীল। একজন বিচারক বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তার ভোট দেন। তাই তাকে নিয়েই জল্পনা-কল্পনা হয়েছে বেশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস, যিনি রক্ষণশীলদের অন্যতম, তিনি উদারপন্থীদের সঙ্গে একমত হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করেছেন।

আদালতের এই রায় কেবল এই কারণেই ঐতিহাসিক নয় যে, গত একশ বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্য পরিচর্যা খাত সংস্কারের ব্যর্থ চেষ্টার পর আদালত সংস্কারকে সমর্থন করল– এই কারণেও যে নির্বাচনী বছরে এই রায় প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। রিপাবলিকান প্রার্থী মিট র‌্যামনি এই রায়ের পর আবারও বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি এই আইন বাতিল করবেন। আদালতের রায় যদি এই আইনের বিপক্ষে যেত তবে প্রেসিডেন্ট ওবামার পুনঃনির্বাচনের পথে তা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত। কেননা রিপাবলিকানরা এটা জোরেসোরেই বলছেন যে, স্বাস্থ্য-বীমা সংস্কার কাজ করতে গিয়ে ওবামা সময় ও অর্থ দুই-ই নষ্ট করেছেন। রিপাবলিকানরা এই কথা এখনও বলবেন কিন্তু তা দিয়ে ভোটারদের মন জয় করতে পারবেন না।

ওবামার স্বাস্থ্য-বীমা সংস্কার মোটেই সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান নয়। এ দেশের যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখনও স্বাস্থ্য-পরিচর্যার বাইরে আছেন তাদের স্বাস্থ্য-সেবা তাতে নিশ্চিত হবে না। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি থেকে তাদের অনেকটাই ভালো অবস্থায় নেবে। তাই এই ব্যবস্থা সর্বোৎকৃষ্ট না হলেও উৎকৃষ্ট তো বটেই। যুক্তরাষ্ট্রে সোশ্যাল সিকিউরিটি আইন করে ১৯৩৫ সালে বয়স্কদের ভাতা দেওয়ার যে পদ্ধতি চালু হয় তা এ দেশে ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। তার তিরিশ বছর পর চালু হয় মেডিকেয়ার ব্যবস্থা যা ৬৫ বছরের বেশি বয়সী এবং প্রতিবন্ধী কম বয়সীদের জন্য চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী এই দুই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পর মার্কিন রাষ্ট্র এ ধরনের আর কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। গত কয়েক দশকে সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, রাষ্ট্রকে সংকুচিত করে বেসরকারিকরণের যে ধারা চলে আসছেÑ প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্য-বীমা সংস্কার তার ব্যতিক্রম। ফলে আগের দুটো কল্যাণমুখী পদক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন যেমন এ দেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন, স্বাস্থ্য-বীমা সংস্কারের পূর্ণ বাস্তবায়নের পর বারাক ওবামার অবস্থানও হবে সে রকম।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের অর্থ এই নয় যে, এই আইন বাস্তবায়নে আর কোনও বাধা থাকবে না। বরং রিপাবলিকানরা আরও জোরেসোরেই চেষ্টা চালাবেন। নভেম্বরের নির্বাচনে ওবামা পুনঃনির্বাচিত না হলে এই আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায় না। তবে ওবামার পক্ষে এখন নির্বাচনের প্রচারণার সময় বলা সম্ভব হবে যে, এই আইনটি রক্ষা করা, তার সুবিধা বাস্তবায়নের জন্যই তার পুনঃনির্বাচন দরকার, প্রয়োজন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যেই স্বাস্থ্য-বীমা সুবিধাবঞ্চিতদের সংখ্যা বেশি। স্বাস্থ্য-বীমা নেই এমন লোকদের প্রায় ৩১ শতাংশ হচ্ছেন হিস্পানিক, ২১ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ এবং ১৮ শতাংশ এশীয় বংশোদ্ভূত। ফলে এই বীমা-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা ও একে শক্তিশালী করা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য বেশি দরকার। আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারলে ডেমোক্রেট এবং ওবামার জন্য সমর্থন জোগার করা সহজ হবে।

২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর ওবামার সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছিল ২০১০ সালে যখন কংগ্রেস এই আইন পাশ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে তা বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেটেছে পরের দিনগুলো। এখন সে ভয় কাটলেও এই নিয়ে বিতর্ক শেষ হবে না। বরং নভেম্বরের নির্বাচনে এটা একটা বড় ইস্যু হিসেবেই থাকবে। তারপরও বলা যায়, আদালতের রায় বারাক ওবামার জন্য ইদানিংকালের সবচেয়ে বড় সুসংবাদ।


আলী রীয়াজ
: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট আইনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক।