মন্ত্রী-সচিব, কোচিং ও ছাত্রছাত্রীদের নসিব

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 25 June 2012, 03:15 PM
Updated : 25 June 2012, 03:15 PM

সম্প্রতি শিক্ষার নামে বেপরোয়া বিদ্যা-ব্যবসা বন্ধ করার জন্যে মহামান্য আদালত রায় দিয়েছেন। আর সেই রায়ের আলোকে সারা দেশে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অসাধু কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করার জন্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জারি করেছে "কোচিং নীতিমালা ২০১২" । এর আগে গত ১৪ জুন শিক্ষক, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সভা করে নীতিমালা চূড়ান্ত করেন। তার মাত্র ৬ দিনের মাথায় ২০ জুন এই নীতিমালা জারি হয়েছে। এমন দ্রুততার সাথে ঘটনা আগে তেমন ঘটেনি। আমরা এজন্যে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাই।

তবে নীতিমালাটি জারি হওয়ার পরপরই মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দ। অভিভাবকরা প্রায় সকলেই এতে যারপরনাই খুশি, কিন্তু বিদ্যাব্যবসায়ী প্রায় সকল শিক্ষক এতে অখুশি বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না, বিন্তু তারাও মনে মনে অখুশি। ব্যতিক্রম যারা আছেন তাদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কেউ কেউ আদর্শবাদী শিক্ষক, আর অন্যরা ক্যাডেট কলেজ বা অনুরূপ কঠোর রুটিন-বন্দী শিক্ষাক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

সে যা-ই হোক, ব্যবসায়ী শিক্ষকরা বলছেন তারা এখনো নীতিমালা হাতে পাননি। তাই নীতিমালা পাওয়ার পর তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন, তার আগে নয়। অর্থাৎ তারা এখনো এই ব্যবসা বন্ধ করতে চান না। নীতিমালাটি পাওয়া না পাওয়ার উপর এটি বাস্তবায়ন করা নির্ভর করে কিনা, এ নিয়ে নানা আইনি তর্ক থাকতে পারে। এমনকি অসাধু বিদ্যাব্যবসায়ীরা এই নীতিমালা কার্যকর না করার জন্যে আইনের আশ্রয় নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা অতীতে শিক্ষাসহ প্রায় সকল অঙ্গনে সরকারি আদেশ, পরিপত্র ইত্যাদি আইনি প্যাঁচে দীর্ঘদিন অকার্যকর রাখার ভুরি ভুরি নজির আছে। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত মন্তব্যটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, "নীতিমালাটি জারির দিন থেকেই কার্যকর হয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটা পাঠানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।" সচিব মহোদয়ের এই উক্তি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। নীতিগত সিদ্ধান্ত ও আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়নের মধ্যে বিস্তর ফারাক– এটিই আমরা জেনে এসেছি এতোকাল। কিন্তু সচিব মহোদয় এই গড্ডল রীতির বাইরে এসে যে যুক্তি দিয়েছেন, তা যতোটা বিধিসম্মত, তার চেয়েও অনেক বেশি সুবিবেচনাজাত। নীতিমালাটি প্রণয়ন, জারি ও বাস্তবায়নের এই তড়িৎ-গতি থেকে মনে হয়, এ-নিয়ে পুরো মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ সদিচ্ছাপ্রবণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো সরকারের একটি বিশাল প্রশাসনিক ইউনিট সকল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে ন্যূনতম সময়ের মধ্যেই এটি জারি করেছে। সচিব মহোদয়ের যৌক্তিক উক্তি সত্বেও এখন এটা দেখবার বিষয়, কতো দ্রুত এটি শহরে-বন্দরে গ্রামে-গঞ্জে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ব্যবসা বন্ধ করা যায়, তাহলে সকলেরই মঙ্গল। কিন্তু আমরা কিছুটা সংশয়বাদীদের দলে। কেননা এ ধরনের নীতিমালা বাস্তবায়নে অতীতে এই মন্ত্রণালয়ও তেমন পারদর্শিতার প্রমাণ রাখতে পারেনি। জনপ্রিয় এক দৈনিকের ২৪ জুন তারিখের প্রথম পৃষ্ঠার একটি বড় খবর, "শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাগুজে নির্দেশ কেউ মানছে না, উদ্যোগও নেই"। রাজধানীর অভিজাত বিদ্যালয়গুলো ইতিপূর্বে ভর্তি বাবদ যে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করেছিলো, গত পাঁচ মাসেও তা কোন বিদ্যালয় ফেরত দেয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এইসব বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে থাকার কারণে তারা সরকারি সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখাবার সাহস পাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই সব বিদ্যালয়ে পরিচালনা পরিষদে গতানুগতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও রয়েছেন। তাহলে কেন এমন হচ্ছে? অভিভাবকরা বলছেন, কেবল প্রশংসা কুড়ানোর জন্যে এই সিদ্ধান্ত। আমাদের মতে, যেহেতু সিদ্ধান্তটি প্রতিটি বিদ্যালয়ে পৌঁছেছে, সেহেতু এটি অবিলম্বে কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। যারা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে হাটে মাঠে গতানুগতিক মন্ত্রী-সচিবদের অধিকাংশ বাগাড়ম্বরের মতো এটিও একটি কথার কথা হয়ে থাকবে।

শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষাসচিবের আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। তাঁদের কিছু কিছু সামষ্টিক অর্জনও সর্বস্তরে স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব নূরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি একজন আদর্শ শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমান শিক্ষাসচিব বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সম্মানিত কবি। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, প্রকাশ ও বিতরণেও তাদের কৃতিত্ব অপরিসীম। তাদের যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটুক, এটিই আমাদের কাম্য।

তবে সর্ষের ভিতর ভূত নেই, এমন দাবি এখনো করা যাবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তদন্তর্গত মহাদপ্তর, পরিদপ্তর, উপদপ্তর বা শাখা-দপ্তরে প্রতিনিয়ত যে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য ইত্যাদি চলে, তা-তো ভুক্তভোগীদের কারো অজানা নয়। এসব বাণিজ্য নিয়ে পৃথক পৃথক সিন্ডিকেটের কথা বহুশ্রুত, যার মধ্যে নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যায়ের অনেকেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযুক্তি আছে বলে গুজব শোনা যায়। আমরা গুজবে কান না দিলেও ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে আসল সত্য জানেন। তবে প্রায় ভুক্তভোগী এটিকেই মান্য-রীতি বলে গ্রহণ করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিরাপদ থাকতে চান। আমাদের আদর্শবাদী ও সুনীতিবান মন্ত্রী-সচিবগণ কি এই অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করবেন এবং বিনা ওজরে তা বাস্তবায়নের আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন? যদি পারেন, তাহলে জাতি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।

ফিরে আসা যাক কোচিং নীতিমালায়। সচিবের ব্যাখ্যা সত্বেও কোচিং নীতিমালাটি কার্যকর করার পদক্ষেপ এখনো গৃহীত হয়নি। আমরা মনে করি, এটি বাস্তবায়নের জন্যে একটি বিশেষ সময়সীমা বেধে দেয়া জরুরী। সেটি অনধিক চার সপ্তাহ হতে পারে।

আর এই নীতিমালা বাস্তবায়নে অভিভাবকদেরও ভূমিকা অপরিসীম। প্রথম কথা হচ্ছে, এই নীতিমালা প্রকাশের পর আর কোনো অভিভাবক যেন তার কোনো ছেলে মেয়েকে কোনো ব্যবসায়িক কোচিং সেন্টারে না পাঠান। এই নীতিমালায় কোচিংকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করা হয়নি, বরং ক্লাশরুমনির্ভর পাঠদান ও তদতিরিক্ত সময়ে স্কুলকেন্দ্রিক কোচিংকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি পরিমিতির মধ্যে আনা হয়েছে। একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পড়ালেখার কাজটি স্কুলের চৌহদ্দিতেই শেষ করবেন, এটিই প্রত্যাশিত। স্কুল থেকে বেরিয়ে তাদের দুজনের আরো কিছু কাজ আছে, যা তারা করবেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রকৃতি, পৃথিবী, সমাজ ইত্যাকার যে সব বিষয় অমুদ্রিত বই আকারে বিরাজমান, সেগুলোর আনন্দপাঠেরও সুযোগ দিতে হবে তাদের। দিনরাতের জেগে-থাকা অংশের প্রায় পুরোটা ছাত্রছাত্রীকে কোচিং-সর্বস্ব মুখস্থবিদ্যার দ্বারস্থ রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

আমরা যদি আমাদের উত্তরপ্রজন্মকে বিদ্যায়তনিক ও সিলেবাস-নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি তাদেরকে গ্রহণ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতায় সৃষ্টিশীল করতে চাই, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই নীতিমালার আনুপূর্বিক বাস্তবায়ন জরুরী। অসাধু বিদ্যাব্যবসায়ীদের ঠেকাতে না পারলে বরাবরের মতো কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নসিবও কেবল মন্ত্রী-সচিবের বাক্যবাণ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। মন্ত্রণালয় কোচিং বন্ধের আদেশ দিয়েছে, নীতিমালা জারি করেছে; এখন তা বাস্তবায়নের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে ছেলেমেয়েদের কোচিং সেন্টারে না পাঠানোর দায়িত্ব অবশ্যই সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের।

আসুন, আমরা অন্যকে দোষারোপ করার অপসংস্কৃতি ত্যাগ করে আপন আপন দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করার সুসংস্কৃতির চর্চা করি। আসুন, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষা ও স্বশিক্ষার পাঠ দেই।