মিয়ানমারের গণতন্ত্র : ফুল, ভ্রমর ও রোহিঙ্গা

Published : 23 June 2012, 03:08 PM
Updated : 23 June 2012, 03:08 PM

তিন মাস আগেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অং সান সুচির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা নিয়ে তোলপাড় করে ফেলেছে বিশ্বব্রম্মান্ড। সবার চোখ তখন মিয়ানমারের গণতন্ত্র কায়েম হওয়ার দিকে। সেই সময় গণতন্ত্রচর্চার চাইতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে উদার অর্থনৈতিক নীতির ফল লাভের দিকেই বেশি নজর ছিল দূর-দুরান্ত থেকে আসা ভ্রমরদের। যেন একটা নতুন ফুল ফুটেছে মিয়ানমারে। দেশ-বিদেশ থেকে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও সাংবাদিকদের সমাগমে মুখর হয়ে উঠেছিল মিয়ানমার। রেঙ্গুন শহরে হোটেলে তখন জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না।

অং সান সু চির নির্বাচনে জেতার দুই মাস পর এবং সু চির নোবেল প্রাইজ গ্রহণের ঠিক আগে দিয়ে বাজতে লাগল ঘন্টা– গণতন্ত্রের ঘন্টা। ১০ জুন থেকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে শুরু হল রোহিঙ্গাদের উপর সহিংস আক্রমণ। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, শিশুদের হত্যা করে, মেয়েদের ধর্ষণ করে শুরু হল হত্যাযজ্ঞ।

এই তো প্রথম নয়, ১৯৪৮ সাল থেকে এই জনগোষ্ঠী নিপীড়িত, নির্যাতিত, ও অবহেলিত হয়ে আসছে।মিয়ানমারের সংবিধান নানান কৌশলে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এমনকি গণতান্ত্রিক সরকার আসার পরও কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা তো যাচ্ছেই না, বরং

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এই হতভাগা জনগোষ্ঠীকে দেশছাড়া করার জন্য চলছে নানা প্রচারণা। মিয়ানমারের গণমাধ্যমগুলো গত ১২ দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে 'সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা' হিসেবে হাজির করে বার বার রোহিঙ্গাদের দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করছে। আর রাষ্ট্র দাঙ্গা দমনের নাম করে নাসাকা বাহিনীকে ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করতে। অনেকে এই দাঙ্গাকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বলছেন যদিও, আমি বলব এটি রাষ্ট্রীয় সহায়তায় গণহত্যা।

আমরা যে যা-ই বলি না কেন, মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট চাপ যে দেওয়া হচ্ছে না এটি এখন সকলের কাছেই পরিষ্কার। তা না হলে অং সান সু চি শুধু আইন সংশোধনের দিকনির্দেশনা দিয়ে কী করে নীরব থাকলেন পুরো বিষয়টি নিয়ে? কী করে মিয়ানমারের গণমাধ্যম অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে? এটা কি প্রমাণ করছে না যে, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জাতিসংঘ ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে?

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সীমান্তে বর্ডার গার্ড রোহিঙ্গাদের নৌকা ফিরিয়ে দিলে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বেশ কিছু রোহিঙ্গা টেকনাফের গ্রামে আশ্রয় নেন। তাদের ভাষ্যমতে, মিয়ানমারের মিলিটারি হেলিকপ্টার থেকে কিছু নৌকার উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। তাতে তাদের সামনে তিনটি নৌকায় আগুন ধরে যায়। এই তথ্য স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানেন, কিন্তু যথার্থ প্রমাণের অভাবে এই বক্তব্য কোনো মিডিয়া প্রকাশ করেনি।

ঘটনা প্রকাশ না পেলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে মিয়ানমার মামুলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসাবে চালিয়ে দিচ্ছে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি কি জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন মনে করছে না? প্রশ্ন করা যেতে পারে, এই মুহূর্তে এই রাষ্ট্রীয় গণহত্যা মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যতটুকু আলোড়ন তুলতে পারত ততটুকু কেন তুলল না? কারণ কি বাংলাদেশকে যত চাপের মুখে রাখা যায় ততটুকু রাখা যায় না মিয়ানমারকে? কেন?

ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে মিয়ানমারের ভৌগলিক অবস্থান, অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, দীর্ঘ সামরিক শাসনের মাঝে নিষ্পেষণের সংস্কৃতি, অভ্যন্তরীন সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েন, বেকারত্ব এবং বিশ্বায়নের দ্বারে গুটি গুটি পায়ে হাটার প্রস্তুতি– এই সব কিছু আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কুটনৈতিক সম্পর্কে অর্থবহন করে। শ্রম সস্তা হওয়ার কারণে পুঁজির প্রবাহ ও বিকাশের দিক থেকে বিনিয়োগের একটি যুতসই গন্তব্য এখন মিয়ানমার।

১৮৮৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনামলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচাইতে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল বার্মা। যদিও ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মিজ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যায় এবং শিল্প জাতীয়করণ করে। ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসকেরা উদার অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। বেসরকারি উদ্যোগও উৎসাহিত করা হয়। সামরিক শাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে মিয়ানমারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে বিধি-নিষেধ ছিল। তার মানে আবার এই নয় যে, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্বালানির দিকে নজর ছিল না বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর। তাদের লুটপাট অব্যাহত ছিল বিধি-নিষেধ সত্বেও।

ওই সময়, অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল প্রধানত চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে। ২০১২ সালে অং সান সু চির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ক্যানাডা মিয়ানমারের উপর দেওয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিধি-নিষেধ উঠিয়ে নেয়।

গত মে মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মিয়ানমারে আসেন এবং মোট ১২টি বাণিজ্যিক, পরিবহন ও বিনিয়োগ চুক্তি করেন। মিয়ানমারের রফতানির একটি বড় অংশ ভারতে যায়। থাইল্যান্ড ও চীনের পর তৃতীয় বৃহত্তম রফতানির বাজার ভারত। ভারতের আগ্রহ মিয়ানমারের জ্বালানি, রেইল, সড়ক পরিবহন ও অবকাঠামো নির্মাণ ব্যবসার দিকে। ২০১০ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যের সিতয়েতে ভারতীয় অর্থায়নে একটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই সমুদ্রবন্দর চালু হলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি বাণিজ্যিক সুফলতা লাভ করবে।

এদিকে দীর্ঘ সময় চীনের সঙ্গে বিনিয়োগ সম্পর্কের কারণে দুদেশের মধ্যে একটি বোঝাপড়া ইতোমধ্যে হয়ে আছে। মিয়ানমারকে চীনের প্রয়োজন বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে ও মিয়ানমারের মধ্যে দিয়ে ভারত মহাসাগরে যাওয়ার প্রবেশপথ ব্যবহার করতে। আর মিয়ানমারের চীনকে প্রয়োজন চীনের পুঁজি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য।

এবার একটু পশ্চিমে গেলে দেখা যাবে, হিলারি ক্লিনটন ২০১১ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারে ঘুরে গেছেন। তিনি মিয়ানমারের গণতন্ত্র কায়েমের চেষ্টায় সাধুবাদ জানিয়ে উদার অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণের আহবান করে দৃঢ় বন্ধুত্ব সম্পর্কের শর্তগুলি বিশ্বের কাছে জানান দিয়ে যান। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিশ্চিত হওয়া জরুরি ছিল উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার যেন মিজাইল না কেনে।

উল্লেখ্য, হিলারি তাঁর এই সফরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধুত্বের সম্পর্কের শর্তের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনের কথাও উল্লেখ করে যান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধানও এরই মধ্যে মিয়ানমার সফরে এসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কার্যালয় খোলার বন্দোবস্ত করে গেছেন।

এই সব কিছু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মিয়ানমারের গণতন্ত্র উদ্ধারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যতটুকু তৎপররতা দেখা গেছে ততটা দেখা যায়নি গণতন্ত্রচর্চায়। আসলে গণতন্ত্রচর্চা হবে কি? বার্মিজদের মতে, রোহিঙ্গাদের তো নাগরিক অধিকারই নেই, তাদের আবার গণতান্ত্রিক অধিকার কী!

আজকের রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীনতার দায় কার? রোহিঙ্গারা ঘরে জন্ম নিচ্ছে যে রোহিঙ্গা তার দোষ কি এই যে, তার দলিল নেই? মিয়ানমারের রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীনতার জন্য দায়ী। তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার যে অভিপ্রায় হয়েছে তার ফল যেন দুই ভূমির মাঝে ভাসতে থাকা নৌকায় অগণিত মানুষ আর সাগর তীরে ভেসে ওঠা লাশ না হয়!

বাংলাদেশ সব সময়ই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ আশ্রয় দিতে না চাইলেও ভেসে আসা রোহিঙ্গারা নানাভাবে সাঁতার কেটে রাতের আঁধারে সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে আশ্রয় নিচ্ছে স্থানীয় গ্রামগুলিতে। কেউ ধরা পরে গ্রেপ্তার হচ্ছে, কেউ পালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে। বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত আটকিয়েও ঠেকাতে পারছে না মানুষের ঢল।

আমাদের গণমাধ্যমগুলো সারাক্ষণ প্রচার করে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা কত খারাপ, ইত্যাদি। তাদেরকে এই মুহূর্তেই আবার নতুন করে দায়ী করা হচ্ছে ইয়াবা চোরাচালানের জন্য, বাংলাদেশের অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছে নাকি রোহিঙ্গাদের জন্য। কিন্তু আমরা যদি উল্টা দিক থেকে জিজ্ঞেস করি, আজকে রোহিঙ্গাদের পথ বন্ধ করলে কি ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ হবে?

আমরা সবাই জানি চোরাচালানির সংঘ দেশব্যাপী বিস্তৃত, আর রোহিঙ্গারা ব্যবহৃত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাদের দিয়ে। কোনো একটি দুর্বল জনগোষ্ঠী পেলে সকলেই তাদের ব্যবহার করে। রোহিঙ্গারা তার ব্যতিক্রম নয়। আজকে রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দিলে যে অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

এখন যদি দেখি, আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কী করছে? যতদুর জানি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে এর আগে কাজ করেছিল | নতুন করে কি এমন আলাদা ঘটনা ঘটল যে তাদের এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না ? এখন তারা কোথায়?

মিয়ানমার কী করছে? নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চি তাঁর দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজের পারিবারিক জীবন ত্যাগ করে নিজ দেশে বন্দিজীবন যাপন করে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই সু চি তাঁর নিজ দেশে হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হতে দেখেও ইউরোপে বসে রইলেন। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সএর আমন্ত্রণে একটি রাউন্ড টেবিল বৈঠকে যখন সু চির জন্মদিনে হলভর্তি দর্শক 'হ্যাপি বার্থডে টু ইউ' বলে উইশ করছে, তখন বাংলাদেশের সীমান্তে সাগরের জেটিতে ভেসে এসেছে একটি নৌকা আর তাতে শুধু একটি নবজাতককে পাওয়া গেছে ক্রন্দনরত অবস্থায়। মা শিশুটির জীবন রক্ষা করতে ওকে ফেলে রেখে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাননি।

বাংলাদেশ এই সব শিশুদের আশ্রয় দিতে না চাইলেও এই সব শিশুরা ছড়িয়ে পড়ছে, অভুক্ত থাকছে, লুকিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে কারও বাড়িতে। কিছুদিন পর এরা অপরাধচক্রের অংশ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে এই বিপদসংকুল মানুষদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকে তার কাছে দায়বদ্ধ করতে পারত।আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে দরকষাকষির মাধ্যমে বাংলাদেশ আদায় করার চেষ্টা করতে পারত অর্থনৈতিক সুবিধা। এতে এই বিপন্ন মানুষগুলি বাঁচত। বাঁচত এই দেশের মানুষ এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার গ্লানি থেকে।

যত দিন যাচ্ছে আমাদের গ্লানি বাড়ছে। কোনো এক দেশ অপরাধ করেছে বলে আমাদেরও কি অপরাধ করতে হবে?