বেতন বৃদ্ধিই গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র সমাধান নয়

আরিফ জেবতিক
Published : 19 June 2012, 12:49 PM
Updated : 19 June 2012, 12:49 PM

কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়, কোনো রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়েও নয়, নিজেদের শ্রমিকদের উপর রাগ করে একসঙ্গে এতগুলো শিল্প কারখানা বন্ধের কাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কী না সন্দেহ। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ৩ দশকের পুরোনো একটি শিল্পের এই হচ্ছে অর্জন।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের অস্থিরতা নিয়ে খুব প্রচলিত একটি কথা চালু আছে, সেটি হচ্ছে ষড়যন্ত্র। একদিকে মালিকপক্ষ বলেন- বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের উস্কানিতে গার্মেন্ট শিল্পে তাণ্ডব হয়, অন্যদিকে আমাদের শ্রমিক নেতারাও বলেন যে এসব ভাংচুরের সঙ্গে শ্রমিকরা জড়িত নয়, বহিরাগত ষড়যন্ত্রকারীরা ভাংচুর করে শ্রমিকদের নায্য আন্দোলনকে সমাজের চোখে দোষী করে তোলে। আসলে এই দুই পক্ষই মূল সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে পারছেন না নাকি করছেন না, সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। পেশাগত ভাবে আমি একসময় গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা থেকে এখানে দুটো কথা লেখার সাহস করছি।

আসলে গার্মেণ্ট সেক্টরের শ্রমিকদের বড় সমস্যা বেতনে নয়, বড় সমস্যা হচ্ছে জীবনের স্বস্থি। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি শুধুমাত্র বেতন বাড়ালেই শ্রমিক অসন্তোষের সমাধান হবে না। আশুলিয়া-সাভার এলাকায় গত ১০ বছরে কয়েকশত বড় বড় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হয়েছে। কমপক্ষে একহাজার থেকে কুড়ি হাজার পর্যন্ত শ্রমিক একেকটি শিল্পগ্রুপের অধীনে এখানে কাজ করছেন। এই যে কয়েক লক্ষ মানুষ এখানে শ্রমিক হিসেবে গেছেন, তাঁদের জন্য কোনো বাসস্থানের ব্যবস্থা ভাবা হয়নি কখনোই। এর ফলে আশুলিয়ার গ্রামে গঞ্জে পুকুর ভরাট করে, বাঁশগাছ কেটে, নিজের ভিটা আর ধানী জমিকে সংকুচিত করে একশ্রেণীর লোক রাতারাতি বাড়িওয়ালা বনে গেছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে আধাপাকা করে তৈরি করা ১০ ফুট বাই সাড়ে ৯ ফুটের টিনশেড এসব ঘরের মাসিক গড় ভাড়া দুই হাজার টাকা! এসব ঘর তৈরির ৬ মাসের মাথায়ই পুঁজি উঠে যায়। প্রথম বছরেই বিনিয়োগের এরকম ২০০ ভাগ লাভের নিশ্চিত ব্যবসা পৃথিবীতে কয়টি আছে সন্দেহ। এখন আশুলিয়াতে যতই বেতন বৃদ্ধি করা হোক, বাড়িওয়ালার চক্কর থেকে শ্রমিককে বের করতে না পারলে বর্ধিত বেতনে শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে না। আজ যদি একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়, তাহলে আগামীকালই স্থানীয় বাড়িওয়ালারা এসব গড় একশ বর্গফুট বাড়ির ভাড়া সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে ফেলবেন। তাহলে শ্রমিককে সেই আগের দেড় হাজার টাকা নিয়েই সারা মাস হিমশিম খেতে হবে।

এর সহজ সমাধান হচ্ছে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির পক্ষ থেকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল নিয়ে যাঁদের স্বচ্ছ ধারণা আছে, তাঁরা জানেন যে এখানে কিছু গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বিঘার পর বিঘা জমি কিনে রেখেছে। এসব জমিতে শুধু ফ্লোরের পর ফ্লোর বাড়িয়ে গেলেই যে চলবে না, কয়েকদিন পর পর শ্রমিক অসন্তোষ এর একটি বড় প্রমান। গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের নিজেদের জমিতে শ্রমিকদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা জোরেশোরে ভাবতে পারে। এটি বিনামূল্যে দিতে হবে, এরকম আবদার করছি না। এ এলাকায় বাসস্থানও একটি বড় ব্যবসা হবে। একশ বর্গফুটের একেকটি ঘর তৈরিতে যে খরচ পড়বে, যদি একহাজার টাকা করে সে ঘরগুলোর ভাড়া রাখা যায়, তাহলেও মাত্র কয়েক বছরে ডরমিটরি তৈরির সব খরচ উঠে আসবে। স্বস্থিদায়ক বাসস্থান থাকলে সুস্থ শ্রমিক ব্যবসার জন্যই শুভকর হবে। এই ডরমিটরি যে দামি জায়গায় করতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আরেকটু গ্রামের দিকে গিয়ে কমদামের জায়গাতেই ডরমিটরি তৈরি করা সম্ভব।

গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর জন্য একটি বড় উদ্যোগ হতে পারে সমবায় ভিত্তিক দোকান তৈরি করা। এখানেও আমি ভর্তুকির কথা বলছি না। আমরা সবাই জানি খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারের দামের তফাৎ কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত। কোনো কোনো পণ্য কেজিতে ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত তফাৎ হয়। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো যদি সমবায়ের ভিত্তিতে না লোকসান-না লাভ ভিত্তিতে দোকান পরিচালনা করে পাইকারি বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করে সেটি শ্রমিকদের সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেন, তাহলে তাঁদের জীবন ধারণ আরেকটু সহনীয় হয়। আমার জানা মতে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি এমন উদ্যোগ নিয়ে চমৎকার ফল পেয়েছেন। দোকান চালানোর জন্য মাত্র ৩ জন কর্মচারি রেখে তাঁরা প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের জীবন যাপনকে তুলনামূলক সহজ করে দিয়েছেন।

বড় শিল্পাঞ্চলে বিনোদনের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা তৈরি হয়নি। এই বিনোদনের সুযোগ তৈরি করাও খুব পরিশ্রমসাধ্য কাজ নয়। একটি প্রজেক্টরে সিনেমা দেখাতে কি আদৌ খুব বেশি টাকা খরচ হয়? হয় না। শুধু প্রয়োজন সুন্দর মন নিয়ে পরিকল্পনা। বায়ারদের চাপে পড়ে সব গার্মেন্ট কারখানাতেই একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই ডে-কেয়ার সেন্টারের খুব কমই আসলে ফাংশনাল। অধিকাংশ ডে-কেয়ারে শ্রমিকদের বাচ্চাদের নিয়ে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এর চাইতে ভালো হয় যদি কয়েকটি গার্মেন্ট কারখানা মিলে একেকটি অঞ্চলে একটু বড় করে ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি করে। এতে করে কারখানার অভ্যন্তরের স্থানাভাবেরও সমাধান হয়, খরচ শেয়ার করার কারণে ফ্যাক্টরিগুলোর গায়েও চাপ লাগে না। এত এত কর্মজীবি মায়েরা যদি বাসায় ফেলে আসা সন্তানের চিন্তা নিয়ে কাজ করেন, তাহলে উৎপাদন ব্যহত হবেই, সেটি আমাদের গার্মেন্ট মালিকরা বুঝুন কি না বুঝুন।

আমরা প্রায়ই শুনি যে গার্মেন্ট ব্যবসা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে আছে, কারখানাগুলো লাভ করছে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কথাটি আমরা দশকের পর দশক ধরেই শুনে আসছি, কিন্তু এতে করে বড় বড় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এমন নজির একটিও দেখি না। আশুলিয়া এলাকায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বড় বড় শিল্পগ্রুপগুলো প্রতিবছরই তাঁদের কারখানা বাড়িয়ে চলছেন। সুতরাং এসব খোঁড়া যুক্তি আমলে নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের দেশে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার অন্তত নিকট ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে না। চীনে শ্রমমূল্য বেড়ে যাওয়ায় গার্মেন্ট শিল্প থেকে চীন বেরিয়ে আসছে, তাঁরা এখন মাঝারি মানের শিল্প কারখানায় জোর দিচ্ছে। এ তুলনায় আমাদের সামনে নিকট ভবিষ্যতে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বৈশ্বিক মন্দার কারণে দামি কাপড়ের বাজার সংকুচিত হলেও, আমরা যেমানের সস্তা কাপড় তৈরি করি, তাঁর বাজার সহজে কমবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে কাপড় একটি মৌলিক চাহিদা, মানুষ বেঁচে থাকলে সে খাবার এবং কাপড় কিনবেই।

আসলে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবে গার্মেন্ট কারখানার বিস্তার। বড় বড় কারখানা নিজেদেরকে এত বড় করে তুলেছে যে তাঁরা কাজের জন্য যেকোনো মূল্যে অর্ডার সংগ্রহ করছে। এতে করে ছোট ছোট কারখানা টিকে থাকতে পারছে না। অনৈতিক ভাবে অযৌক্তিক মূল্যে কাজ সংগ্রহ করার কারণে কারখানাগুলোর লাভের হার কমে গেছে এটি সত্যি, কিন্তু এর জন্য দায়ী কারখানার মালিকপক্ষ। বার্গেনিং পাওয়ার কমে আসার দায় শ্রমিকদের উপর ফেলা হবে অন্যায়।

এর বাইরে সরকারের উচিত এখন সিরিয়াসলি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর নিয়ে চিন্তা করা। এই কাজটি অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল, কিন্তু কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। ঢাকা এবং এর আশেপাশে প্রায় আড়াই হাজার গার্মেণ্ট কারখানা আছে। গড়ে একহাজার করে শ্রমিক কাজ করলেও ন্যূনতম ২৫ লক্ষ লোক এই পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন। অথচ এই কারখানাগুলো ঢাকায় থাকার কোনো যুক্তিই নেই। গার্মেন্টের কাচামাল আসে বিদেশ থেকে, পণ্যও রফতানি হয় বিদেশে। এর শ্রমিকরাও কেউ ঢাকার আদি বাসিন্দা নন, তাঁরা কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে এসেছেন।
সুতরাং কোন যুক্তিতে আমরা এতদিন পরেও ঢাকা শহরে গার্মেন্ট কারখানা চালিয়ে যাচ্ছি তা আমার মাথায় কুলোয় না।
সবচাইতে ভালো হবে যদি গার্মেণ্ট কারখানাগুলোকে এখন থেকেই মংলা পোর্টের আশেপাশে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হয়। মংলা পোর্টকে শুধু গার্মেণ্ট পণ্যের জন্যই নির্ধারিত করে দেয়া যেতে পারে। এতে করে এই প্রায় পরিত্যক্ত বন্দরটিকে ব্যস্ত করা যায়, চট্টগ্রামের বন্দরের উপর থেকেও চাপ কমিয়ে আনা যায়। গার্মেন্ট কারখানা সরে গেলে ঢাকা থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০ লক্ষ লোকের চাপ কমে যাবে, এতে ঢাকা শহরের নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করাও সুবিধাজনক হবে। নির্মিতব্য পদ্মা সেতুও তখন বেশি করে অর্থকরী হবে আমাদের জন্য।

আমি জানি, মুখে বললেই গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা তাঁদের কারখানা ঢাকা থেকে সরিয়ে নিবেন না। এজন্য সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। মংলা পোর্টের আশেপাশে বৃহত্তর খুলনায় এজন্য নতুন করে শিল্পনগরী গড়ে তোলা যেতে পারে। এছাড়া ঐ এলাকার কারখানাগুলোকে কর রেয়াত দেয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরে ঢাকায় অবস্থান করা ফ্যাক্টরিগুলোর উপর বেশি করে কর আরোপ করলেই কারখানাগুলো ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাবে। পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে খুলনা অঞ্চলকে গার্মেন্ট ডিস্ট্রিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে।

একথা সবাই জানেন এবং মানেন যে পোশাক কারখানা আমাদের দুর্বল অর্থনীতির মূল ধমনী। এই ধমনী রোগাক্রান্ত হলে গোটা দেশের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব আসবে। কিন্তু ব্যথানাশক বড়ি দিয়ে এই অসুস্থতাকে জিইয়ে রাখার কিছু নেই। একটি করে ইস্যু তৈরি হবে, শ্রমিক আন্দোলন হবে তারপর এর সাময়িক সমাধান করা হবে, এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। শ্রমিকরা কারো শত্রু নয়, তাঁরা এখানে মারামারি করতে আসেন নি, তাঁরা এসেছেন শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের জীবনটা যাপন করতে। সুতরাং কারখানায় অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর রগচটা কর্মকর্তা আর শিল্প পুলিশের হুইসেল দিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধংদেহী অবস্থায় শিল্প চালানো কোনো বুদ্ধিমত্তার বিষয় নয়।

পোশাক শিল্প এখন তার শৈশব কাটিয়ে উঠেছে, এখন শক্তভাবে এর বিরাজমান সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হবে।
শুধুমাত্র কয়েক বছর পরপর কয়েক শ টাকা বেতন বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

আরিফ জেবতিক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্লগার।