পরীক্ষিত জীবনঃ বাংলাদেশে নৈতিক বিশ্বাসের উপর একটি জরিপ

রেইনার এবার্ট
Published : 16 Nov 2013, 03:20 PM
Updated : 12 June 2012, 03:01 PM

বাংলাদেশীরা নিজস্ব মতামতের প্রতি অবিচল থাকা ধরনের মানুষ। রাজনীতি, ধর্ম ও বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে নিজস্ব মতামতের জায়গায় তাদের অবস্থান পরিষ্কার। একজন বিদেশী দুলাভাই হিসাবে আমার ভাইয়া ও আপু, চাচা-চাচী আর খালা-খালুদের সাথে অনেক যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে যেয়ে আমি এটাই শিখেছি। জার্মানী ( যেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (যেখানে এখন আমার নিবাস) মানুষের সাধারণ বিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশী মানসিকতার অমিলের জায়গাগুলোও আমি এখন ওয়াকিফহাল। আমি এখন জানতে পেরেছি যে বাংলাদেশে বড়দের সামনে কেউ ধুমপান করে না এবং যুবক-যুবতীরা নিজেদের মধ্যে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত যৌন সংসর্গে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে কতজন মানুষ মনে করে যে বিবাহপূর্ব যৌণ মিলন একটি অনৈতিক কাজ? শতকরা হিসাবে অবশ্যই এই বিষয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকতে পারে, কিন্তু এই মতামতের একটি গ্রহণযোগ্য উপাত্ত বা ডেটা আমি খুঁজে পাইনি। জার্মানী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায়শঃই জনগনের নৈতিক ইস্যুগুলোর উপর জরিপ চালানো হয়। বাংলাদেশে সম্ভবতঃ এই প্রথম এমন একটা জরিপে অংশ নেবার জন্য আমি তাই আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি আশা করছি যে আপনারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার ভিত্তিতে এই জরিপে অংশ নিয়ে আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন। আপনারা যত বেশী সংখ্যক অংশ নিবেন, জরিপের ফলাফল তত বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও আগ্রহউদ্দীপক হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার এই জরিপের প্রশ্নগুলো আরও একটি সাধারণীকৃত প্রশ্নের আওতার মধ্যে পরে যা আজ থেকে ২৪০০ বছর পূর্বে শুধুমাত্র সকরেতেস উদ্দীপ্ত করে যান নি, বরং আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন যার মুখোমুখি হচ্ছিঃ আমরা কি ভাবে আমাদের জীবন ধারন করবো? আমরা ক্রমাগত আমাদের পছন্দগুলো নির্ধারন করি এবং এই পছন্দগুলো আমাদের নিজেদের বা অন্যদের উপর প্রভাব ফেলে- যেগুলো কখনও ভালো, কখনও বা মন্দ অর্থে। উদাহরণ স্বরূপ, নীচের তিনটি ঘটনাকে বিবেচ্যে আনা যেতে পারে।

আপনার এক বান্ধবী ভীষণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য আছে আর এই পর্যায়ে সে আপনার পরামর্শ প্রার্থনা করলো। সে আপনাকে বললো যে গত দুই বছর ধরে সে একটি ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে আছে। তারা বিয়ে করতে চায়। কিন্তু এই সম্পর্কের কথা সে তার বাবা-মা কে কখনই বলতে পারেনি কেননা সে জানে যে তাঁরা এই মেলামেশাটা মেনে নিবেন না এবং তার উপর যখন সে একজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী আর তার প্রেমিক কখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মারায়নি। আপনার এই বান্ধবীর বাবা-মা চাইবেন বান্ধুবী যেন তাঁদের পারিবারিকভাবে নির্বাচিত কোন ছেলেকে বিয়ে করে। বাস্তবতা হলো এই যে, বেশ কিছু পাত্র ইতোমধ্যেই তাঁদের তালিকার মধ্যে আছে। আপনার কি মনে হয় যে এমতাবস্থায় বাবা-মা'র ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রেমিককে বিয়ে করার বিষয়টি আপনার কাছে নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? অথবা আপনি কি বান্ধবীকে এই পরামর্শই দিবেন যে সেই ভালবাসার মানুষটিকে বাদ দিয়ে পারিবারিকভাবে নির্বাচিত পাত্রকেই তার বিয়ে করায় রাজী হওয়া উচিত?

দ্বিতীয় ঘটনাটিতে দেখা যাচ্ছে যে, আপনার অফিসের বস তার বাসার একটা পার্টিতে আপনাকে নিমন্ত্রণ করলো। পার্টিতে শ্যাম্পেন দ্বারা আপ্যায়িত করা হচ্ছে। জীবনে এর আগে আপনি কখনও মদ্যপান করেননি। আপনার অন্যান্য কলিগরা আপনাকে শ্যাম্পেন পানে প্ররোচিত করলো। তাদের যুক্তি হচ্ছে, একটু চেখেই দেখ না, এটা তেমন কোন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না এবং যতক্ষণ তুমি পরিমিত পরিমাণে মদ্যপান করছ, ততক্ষণ এটা দোষের কিছু নয়। আপনি কি এতে রাজী হবেন, না কি আপনি বিশ্বাস করেন যে কলিগদের এই অনুরোধে রাজী হওয়াটা আপনার কাছে নৈতিক ভাবে অগ্রহণযোগ্য? এর পরিবর্তে আপনাকে যদি গাঁজা জাতীয় কোন মাদক গ্রহণে অনুরোধ করা হতো তাহলে কী করতেন?

এবার তৃতীয় ঘটনাটি দেখা যাক। অস্ট্রেলিয়ার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্নাতকোত্তর কোন কোর্সে পড়ার জন্য আপনাকে স্কলারশীপ প্রদান করলো। এই কোর্সে অংশ নেয়ার প্রাক্কালে আপনাকে আপনার জন্মনিবন্ধনের সনদপত্র জমা দিতে হবে, যা আপনার কখনই ছিল না। আপনি যদি চার সপ্তাহের মধ্যে এই সনদপত্র জমা না দেন তাহলে আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতকালীন টার্মে অংশ নিতে পারবেন না এবং এতে করে আপনি একটি বছর পিছিয়ে যাবেন। এমতাবস্থায় আপনি সংশ্লিষ্ট একটি সরকারী অফিসে গেলেন এবং সেখানে জন্মনিবন্ধনের সনদপত্রের জন্য আবেদন করলেন। যদিও আপনাকে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে বলা হলো যে, এই সনদ পেতে আপনাকে তিন থেকে ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু আপনি বুঝতে পারলেন যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাজার দুয়েক টাকা গোপনে ধরিয়ে দিলে খুব দ্রুত সনদপত্রটি আপনি পেয়ে যাবেন। এমতাবস্থায় আপনার কি করা উচিত?

এই ধরনের প্রশ্নগুলোর উত্তর কি দেব, তার উপর আমাদের জীবনটা একটা আকার ধারণ করে। আমাদের নৈতিক বিশ্বাসগুলো আইন ও গণনীতি সমেত আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাজগুলোকে প্রভাবিত করে। নৈতিকতা মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা। ভাল ও মন্দ আচরণের একটি প্রথাগত মানের ভিত্তিতে প্রতিটি মানব সমাজ তাদের নিজ নিজ সুনীতির ধারণাগুলো বিকশিত করেছে। মানুষ এই সকল সামাজিক মানদন্ডের মধ্যে যেমন, তেমনি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে তার নৈতিক পথনির্দেশনা খুঁজে। শেষ অব্দি আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজ নিজ পছন্দ ও কাজের জন্য দায়ী।

নৈতিকতা সবসময় বৈধতা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আইন ও সমাজ দ্বারা অনুমোদিত দাসপ্রথা এখন সার্বজনীনভাবেই ত্যাজ্য- এবং সংগত কারণেই এটা সঠিক। এমন কী যে সকল আপেক্ষিকতাবাদীরা, যারা নৈতিকতার একটি সার্বজনীন চরিত্রের ব্যাপারে সন্দিহান, তারাও দাশপ্রথা যে নৈতিকভাবেই তিরস্কারযোগ্য- এটা অস্বীকার করতে পারেন না। আজ আমরা সকলেই একমত যে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, গোষ্ঠি ও জন্মস্থানের বিভিন্নতা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি মানুষ মর্যাদা ও অধিকারের দিক থেকে সমান। যদিও বিভিন্ন সমাজ ও নির্দিষ্ট কোন এক সমাজের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও মতদ্বৈততা বিরাজমান। উপরোল্লিখিত গ্রীক দার্শনিক নাকি একবার বলেছিলেন, অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। কথাটি নিশ্চিত ভাবেই একটি অতিরঞ্জন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের জীবন, মূল্যবোধ ও দৃঢ় প্রত্যয়গুলো- যা আমাদের জীবনকে একটি অবয়ব দেয়, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সুখ না কি সদ্‌গুনাবলীকে জীবনের লক্ষ্য করবো? কি আমাদের কর্মকে নৈতিকভাবে সঠিক বা ভুল ব'লে গণ্য করে? কোন জিনিস ও আচরণগুলো ভালো আর কোনগুলো খারাপ? আমাদের পরিবারের প্রতি আমাদের কি কোন বিশেষ বাধ্যবাধকতা আছে, না কি সকল মানুষকে আমরা সমান ভাবে গণ্য করবো? মানব নয় এমন প্রাণীজগত কি আমাদের নৈতিক বিবেচনা দাবী করে?

আমরা সবাই একটি বহুত্ববাদী ও ক্রমঃবর্ধমান বিশ্বায়নের জগতে বাস করি যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এক জায়গায় এসে মিলিত হয়। এবং প্রত্যেকেই আমরা নিজ নিজ নৈতিক কম্পাস বহন করে চলি। আমাদের প্রচলিত সংস্কারকে অতিক্রম করে পরস্পরকে বুঝবার জায়গাটা অর্জন করার জন্য আমাদের পরস্পরকে আরও ভালো ভাবে চিনতে হবে। বাংলাদেশে কোন নৈতিক ইস্যুগুলো সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত? বাংলাদেশীরা কোন জায়গায় একমত হন? বাংলাদেশ ও পাশ্চাত্য জাতিগুলোর মধ্যে নৈতিকতার ফাটলটি সত্যিকার অর্থে কতটা গভীর? এই প্রশ্নগুলোর সুলুক সন্ধানে আরও এক কদম এগিয়ে যাবার জন্য বাংলাদেশে সামাজিক নীতিমালা ও আচরণগত নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাগুলো চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে আমি একটি জরিপের রূপরেখা সাজিয়েছি। জরিপে উল্লেখিত প্রশ্নগুলো বিস্তৃত টপিক নিয়ে আবর্তিত। জরিপটি ব্যক্তি পরিচয়হীন। বিবাহপূর্ব যৌণ সংসর্গ, পারিবারিক বিয়ে, যৌতুক, বিবাহ বিচ্ছেদ, পর্ণোগ্রাফি, ধুমপান এবং মৃত্যুদন্ড সহ আরও বিভিন্ন ইস্যুতে আপনার নৈতিক বিশ্বাসটি চিহ্নিত করে জরিপে অংশ নেবার জন্য আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এই প্রথমবারের মতো একটি মূলধারার পত্রিকায় জরিপের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষযভিত্তিক প্রশ্নগুলো রাখা হলো। ট্যাবু বা নিষিদ্ধ সংসর্গে সম্পৃক্ত হওয়াটা চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের বিচারেই এই বিষয়গুলোকে কম্বলের নীচে লুকিয়ে না রেখে খোলা মনে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশে নৈতিক বিশ্বাসের উপর জরিপে অংশ নিতে দয়া করে নীচের লিঙ্কটি অনুসরণ করুনঃ

শুধু মাত্র বাংলাদেশী নাগরিকরাই দয়া করে এই জরিপে অংশ নিন। আপনাকে আরও অনুরোধ করা যাচ্ছে যে, শুধু মাত্র একবারই এই জরিপে অংশ নিন। জরিপে অংশগ্রহণনকারীর সংখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য জায়গায় পৌঁছা মাত্র আমি অন্যত্র একটি মতামতধর্মী নিবন্ধে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করবো এবং সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে যাওয়া একই চরিত্রের একটি জরিপের ফলাফলের সাথে এই জরিপের ফলাফলের একটি তুলনামূলক আলোচনা করবো। এই জরিপে আপনার অংশগ্রহণকে সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদ।

ভাষান্তরঃ সেলিম তাহের।

রেইনার এবার্ট: আমেরিকা টেক্সাস-এর রাইস ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত একজন দর্শনের ছাত্র।