সাধ ও সাধ্যের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ বাজেট

এম এম আকাশ
Published : 13 Nov 2013, 06:42 PM
Updated : 10 June 2012, 09:53 AM

গত ৭ জুন দুপুর ৩টা থেকে মহাজোট সরকারের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটটি পেশ করেছেন মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত। সব ভালোয় ভালোয় চললে আগামী বছর জুন মাসে তিনি আরেকটি বাজেট পেশের সুযোগ পাবেন কিন্তু তার শেষ দেখে যাওয়ার সময় মহাজোট সরকার পাবেন না কারণ দেড় বছর পরই নির্ধারিত নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। তাই এই বাজেটটি বর্তমান সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজেট। এই বাজেটে সরকারকে তাই বলতে হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সমূহের কতটুকু তারা বাস্তবায়িত করেছেন, কতটুকু বাস্তবায়নের চলমান প্রক্রিয়াধীন আছে এবং কোন প্রতিশ্রুতিগুলি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আগামীতে সরকার শুরু করবেন। এই জন্য এই বাজেট দলিলের নামকরণ করা হয়েছে 'তিনটি বছরের খতিয়ান : আগামীর পথ রচনা : বাজেট বক্তৃতা ২০১২-১৩'।

এবারের বাজেটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'কতিপয় ব্যতিক্রমী পরিশিষ্টের তালিকা'। অর্থমন্ত্রী নিজেই তার সুদীর্ঘ ১৫৯ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতার প্রারম্ভেই অকপটে উল্লেখ করেছেন,
'সকলের সুবিধার্থে আমি পরিশিষ্ট-ক এর ১ম সারণিতে বিগত তিন বছরের বাজেটে উল্লিখিত নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে যেগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার একটি তালিকা তুলে ধরেছি। ২য় সারণি-তে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সমূহের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়নাধীন অথবা চলমান তার একটি তালিকা দিয়েছি এবং ৩য় সারণি-তে যেসব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি সেরকম বিষয়ের আরো একটি তালিকা প্রদান করেছি।' (পৃ:-৩)

লক্ষ্যণীয় যে অর্থমন্ত্রী নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলির পরিবর্তে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন বাজেটে প্রদত্ত প্রতিশ্রুত নীতি ও কর্মসূচিগুলির মধ্যে। ফলে এই বাজেটকে তাই পরিপূর্ণভাবে নির্বাচনমুখী বলা যাবে না অথবা নির্বচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোন হিসাব-ও এখানে তুলে ধরা হয়নি।। এই বাজেট কিছুটা নির্বাচনের চাপ এবং কিছুটা সাধ্য ও সাধের পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে। গত বছরে প্রচুর ঘাটতি, প্রচুর ব্যাংক ঋণের বোঝা এবং বিদেশি সাহায্যের অপ্রতুলতার সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ বছরের বাজেটে উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত এই সমস্যাগুলির প্রবল ছায়াপাত ঘটেছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার এক লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। যেহেতু মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি, সেহেতু ধরে নেয়া যায় বাজেটের আয়তনের প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ ৭ শতাংশের বেশি হবে না। সমগ্র বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয়ই প্রধান ব্যয়, যার পরিমাণ এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শতাংশ হিসাবে প্রায়৭১ শতাংশ যা পরবর্তীতে আরো বাড়বে বৈ কমবে না!

সরকার যে রাজস্ব আয় করেন তা দিয়ে প্রথমে অনুন্নয়ন ব্যয় মেটাতে হয়। এরপর যে উদ্ধৃত্ত থাকে সেটাকে ভিত্তি করেই রচিত হয় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেন। এর সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ যোগ করে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়। সেই দিক থেকে ২০১২-১৩ প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের আনুমানিক প্রাক্কলন হচ্ছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে রাজস্ব ব্যয় এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব ব্যয় মিটিয়ে উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে থাকবে মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে, যার আয়তন ৫৫ হাজার কোটি টাকা। তার মানে হচ্ছে, ৫২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি। এই ৫২ হাজার কোটি টাকা সরকার কোন উৎস থেকে পূরণ করবে এবং কিভাবে ব্যয় করবে তার ওপর নির্ভর করছে আগামী বাজেটের সফলতা ও বিফলতা।

গত বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হয় এক্ষেত্রে সরকার খুব একটা বিদেশি সাহায্য পাবেন না। যদি পান তাহলে এমন শর্ত তাকে গলাধঃকরণ করতে হবে, যা বিপুলভাবে তার জনসমর্থন হ্রাস করতে পারে। দেড় বছর পর নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যা করা খুবই কঠিন হবে। যদি তারপরও সরকার তা করে তাহলে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সার ইত্যাদি খাতে ভতুর্কি কমাতে হবে। এসবের দাম তাতে প্রচুর বৃদ্ধি পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতির বিপদ অব্যাহত থাকবে। জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য বরং সেটিই বেশি বিপজ্জনক।

অন্যদিকে সরকার যদি ভতুর্কি ধীরে ধীরে কমাতে চায়, তাহলে প্রথমে আইএমএফ'র (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) সঙ্গে তাকে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় সম্পদের মাধ্যমেই সেই ভর্তুকির সংস্থান ঘটাতে হবে। স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহের একটি উপায় হচ্ছে 'আনট্যাপড ট্যাক্স সোর্স'গুলো থেকে ট্যাক্স (কর) আদায় করা। কর হার বৃদ্ধি করে অথবা করের ব্যপ্তি বাড়িয়ে।

রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা যায়, এই পদ্ধতিতে বর্তমানে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ যা আছে তাকে দ্বিগুণ করা সম্ভব। অবশ্য সেজন্য প্রথমে কর প্রশাসনকে দুর্নীতিশূন্য ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে অঙ্গীকারসম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সরকারের শ্রেণিভিত্তির কল্যাণে এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ট ব্যবসায়ী এমপি'দের আধিপত্যের দরুন ওই পথে অগ্রসর হওয়া বা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার ক্ষমতা সরকারের আদৌ হবে কি? তাহলে আবার গত বছরের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তখন সরকারকে প্রচুর ব্যাংক ঋণ নিতে হবে। ব্যক্তি খাতে 'ক্রাউডিং আউট এফেক্ট' হবে এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে এমনকি 'ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং'র আশ্রয় নিতে হতে পারে। বাজেটে অর্থমন্ত্রী এমনকি "সভরেন বন্ড" অপশনের কথাও বলে রেখেছেন!

শেষ অবধি কম প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি তথা 'স্ট্যাগ ফ্লাশন' বা মন্দাস্ফীতির ফাঁদে আটকে যেতে পারে অর্থনীতি। তাই এই বাজেট সাধ ও সাধ্যেও চাপের মুখে প্রণীত একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজেট।

এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।