পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ : প্রতিযোগিতার নামে অসম প্রতিযোগিতা

Published : 24 May 2012, 05:09 PM
Updated : 24 May 2012, 05:09 PM

মে মাসের ঘটে যাওয়া দুইটি ঘটনা দিয়ে আজকে লেখা শুরু করতে চাই | প্রথম ঘটনাটি ঘটে মে মাসের ৯ তারিখে, নকল বই বিক্রী করতে রাজী না হওয়ায় বাংলাবাজারের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করেছে পাঠ্য বই নকল চক্রের হোতারা | দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে মে মাসের ১৯ তারিখে, ঝিনাইদহে এক ট্রাক ভর্তি বিক্রয় নিষিদ্ধ পাঠ্য বই নিয়ে ধরা পরে এক পুরানো কাগজ ব্যবসায়ী | এবং তার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে সন্ধান পাওয়া যায় হাজার হাজার মাধ্যমিক পাঠ্য বইয়ের | এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে| দুইটি ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা | কিন্তু তাদেরকে একই সুতায় বাধলে বেরিয়ে আসে একটি গল্প | একদিক থেকে নকল পাঠ্য পুস্তক বিক্রীর সিন্ডিকেট সচল, অন্যদিকে সরকারী অর্থায়নে মুদ্রিত বিনামূল্যে বিতরণযোগ্য পাঠ্য পুস্তক নিয়ম অনুযায়ী বিতরণ না হয়ে তার আরেকটি বাজার সচল | তার মানে সবদিকেই অসাধু ব্যবসা | এবং অসাধু ব্যবসায় বাধা পড়লে সন্ত্রাস | এই সব দৃষ্টান্ত থেকে জনগনের মধ্যে মুদ্রন শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে যত নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় ততটা তৈরি হয় না এর ইন্ধনদাতাদের সম্পর্কে | পাঠ্যপুস্তক বিতরণে অনিয়ম ও নকল বইয়ের বাজার তৈরির প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই ঢালাওভাবে সকল মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হয় | উল্লেখ্য ২০১০ সালে জাতীয় পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের গুদামে আগুন লাগার সময়ও কিছু বিশেষ মহল দায়ী করতে থাকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে | ঢালাও ভাবে দেশী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে, প্রতিযোগিতা তৈরির নামে বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা করার ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয় | পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি | দেশী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর এই অনিয়মের দায় চাপিয়ে এবং বেশী দাম দিয়ে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলিকে |

২০১০ সাল থেকে সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের ছাত্রছাত্রীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ করা শুরু করেছে। এর আগে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুধু প্রাথমিক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল | বর্তমান সরকার আসার আগ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রতি বছর সাধারণত দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মুদ্রণ করিয়ে এই বই প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করে এসেছে। এভাবে দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বই ছেপে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পৌছে দেয়ার কাজটি করে আসছিল | কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন বিনা মূল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন হিসাব করে দেখা যায় যেখানে আগে ৯ কোটি বই লাগত সেখানে ১৯ কোটি বই ছাপানোর প্রয়োজন হয়ে পরে | এর মানে এই নয় যে রাতারাতি শিক্ষার্থী ও পাঠ্য পুস্তকের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় | এর কারণ বিনামূল্যে বিতরণের আগের বছর গুলোতে আগের বছরের বই পরের বছর পুনরায় ব্যবহার করা হত আর তাই চাহিদাও ছিল কম | হঠাত সরকার যখন ঘোষণা দেয় যে পরের বছর ১৯কোটি বই ছাপানো হবে তখন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো রাতারাতি এই দ্বিগুন সংখ্যক বই প্রকাশে সক্ষমতা অর্জন করে উঠতে পারেনি | এর কারণ রাতারাতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাচামাল আমদানী তখন সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি | তাছাড়া পাঠ্য পুস্তকের পরিবর্তন ও রঙ্গীন প্রিন্ট বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান অল্প সময়ের নোটিশে রঙ্গীন বই প্রকাশে হিমশিম খেতে থাকে |আর এই সুযোগে মুদ্রণের মান, দ্রুততা, ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, ও নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সরকার আর্ন্তজাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার কাজটি দিয়ে দেয়। যদিও তখন থেকে দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সক্ষমতা অর্জনে নানাভাবে সচেষ্ট হয়, তাদের এই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে গত বছর সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাররঙা পাঠ্যপুস্তক ছাপার জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে বই মুদ্রণের কাজটি ভারতকে দিয়ে দেয় | এই প্রসঙ্গে একটি বিবৃতিতে বাংলাদেশ পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণ শিল্প সমিতির উপদেষ্টা তোফায়েল খান বলেন, "সরকার নিজেদের ব্যর্থতার দায় প্রেস মালিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ছাপার কাজ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে"।

এখন দেখা যাক আর কি পরিবর্তন হয়েছে হঠাৎ করে | আগে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেই প্রেস মালিকরা ছাপার কাজ পেতেন | এখন নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ ও মুদ্রণ মান নিশ্চিত করতে সরকার কয়েকটি শর্ত আরোপ করেছে | এই শর্ত অনুযায়ী শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা হলেই কাজ পাওয়া যাবে না। কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা হবে প্রেস মালিকদের ব্যাংকিং সুবিধা, বই ছাপানোর প্রিন্টিং মেশিনের কার্যক্ষমতা ও বই ছাপানোর অভিজ্ঞতার সনদ। এ ছাড়া আগের বছর যেসব প্রতিষ্ঠান বই ছেপেছিল তারা নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করেছে কি না, সেটাও দেখা হবে। এসবই ভাল কথা| কিন্তু মান যাচাই করা হঠাৎ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো কেন? এই মান যাচাই করতে যেয়ে সরকার অসম প্রতিযোগিতার পথ তৈরি করছে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ থেকেই যায় |

বিশ্বায়নের যুগে অনেকেই ভাবতে পারেন যে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নেই বলে নিরুপায় হয়েই সরকার আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করেছে | কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে সরকার বইয়ের বিষয়বস্তু পরিবর্তন, চার রঙের বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত, এবং বিনা মূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত সুপরিকল্পিতভাবে নিলেই মুদ্রণ শিল্পের এই সমস্যাটি মোকাবেলা করা যেত | পরিকলপনাটি করার সময় যদি মুদ্রণ শিল্পের স্বার্থটাও একই সাথে মূল্যায়ন করা হত তাহলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারত | কিন্তু তা না করে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে সরকার | গত কয়েক বছরে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে সক্ষম হয়ে উঠেছে, কিন্তু যখন প্রায় সক্ষম হয়ে উঠেছে ততদিনে তারা দেখে তাদের কাজের একটি বড় অংশের সুযোগ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে দিয়ে দেওয়ার পথ সুগম হয়ে গেছে |

এখন দেখা যাক দরপত্রে প্রস্তাবিত মূল্য নিয়ে কী বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে এবং কী অজুহাতে বেশী দামে ভারত থেকে পাঠ্য পুস্তক মুদ্রিত হয়ে আসছে | মুদ্রণ শিল্প সমিতির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ২০১২ সালে ২৩ কোটি পাঠ্য পুস্তক বিতরণ করা হয় |এর মধ্যে ৩ কোটি ছাপা হয়ে আসে ভারত থেকে | ২০১৩ সালে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, দাখিল, এফ্তেদারী, ও প্রাইভেট স্কুলগুলোকে এই প্রজেক্টের মধ্যে আনার লক্ষ্যে ২৭ কোটি পাঠ্য পুস্তকের প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে | মুদ্রণ শিল্প সমিতির মতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যদি ছাপানোর কাজটি দেওয়া হয় তাহলেও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা ছিল না | কিন্তু সম্প্রতি মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দাবী করছে যে এই আন্তর্জাতিক টেন্ডার অব্যাহত রেখে সরকার অসম প্রতিযোগিতার পথ প্রশস্ত করছে | উদাহরণ স্বরূপ মুদ্রন শিল্প সমিতির দেওয়া একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে | ২০১১-২০১২ সালের বাজেট অনুযায়ী পাঠ্য পুস্তক আমদানীতে শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ আমদানীকারককে মোট ২০.৪৩% কর পরিশোধ করে আমদানী করতে হবে |অর্থাত ১০ টাকার বই আমদানী করতে হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে পরিশোধ করতে হবে ১২..৪৩ টাকা | এদিকে দেশীয় মুদ্রণ ব্যবসা উত্সাহিত করতে সরকার নিয়ম করে দিয়েছে যে আন্তর্জাতিক টেন্ডার হলে দেশীয় কোম্পানি গুলো বিদেশী কোম্পানির প্রদত্ত দামের চাইতে ১৫ % বেশী দামে বিডিং করতে পারবে | অর্থাত বিদেশী কোম্পানী যা ১০ টাকায় বিক্রী করতে পারে দেশী কোম্পানিগুলি তা ১১.৫ টাকায় বিক্রী করার অধিকার পাবে | বিদেশী কোম্পানির ১০ টাকা দেশী কোম্পানির ১১.৫ টাকা সমতুল্য ধরা হবে | কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ম কানুন দেশীয় কোম্পানির পক্ষেই কাজ করার কথা | কিন্তু দেখা গেছে যখন দরপত্রের প্রদত্ত মূল্য তুলনা করা হচ্ছে তখন বিদেশী কোম্পানির প্রদত্ত মূল্য হিসাবে ধরা হচ্ছে কর দেওয়ার আগের দাম (১০ টাকা) আর দেশী কোম্পানীর ক্ষেত্রে ধরা হচ্ছে তাদের প্রদত্ত দাম (১১.৫ টাকা) | অর্থাৎ বিদেশী কোম্পানীর ক্ষেত্রে দাম কর সহ ১২.৪৩ টাকা না ধরে ধরা হচ্ছে ১০ টাকা আর এই ১০ টাকা তুলনা করা হচ্ছে দেশী কোম্পানীর দেয়া দাম ১১.৫ টাকার উপরের দামের সাথে | আর এতে সব চাইতে কম দাম নিশ্চিত করতে গিয়ে টেন্ডারে জিতে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানি গুলো | অথচ বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী আমদানীকারক কর সহ সম্পূর্ণ দাম অর্থাত ১২.৫ টাকা দিতে বাধ্য |

বিদেশী কোম্পানী থেকে যদিও এনসিটিবি বেশী দামে কিনছে কিন্তু বিডিং করার সময় দাম দেখানো হচ্ছে কম | অর্থাৎ এনসিটিবি বাড়তি টাকা খরচ করলেও এবং সরকারি কোষাগারে কর আকারে সে টাকা জমা হলেও মাঝখান থেকে মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে বিদেশী কোম্পানী | অথচ এদিকে বইয়ের কাচামাল আমদানী করতে দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান গুলিকে ৬১.৫% পর্যন্ত কর দিতে হচ্ছে সরকারকে | এই অর্থও সরকার পাচ্ছে | অনেকেই বলবেন যে এতে দেশের টাকা দেশেই থাকছে, মাঝখান দিয়ে সরকার অল্প দামে পাঠ্য পুস্তক কিনতে পারছে | কাজেই লাভ তো সরকারেরই | এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে সরকারের এরকম লাভ করার সুযোগটাই যদি মুখ্য হয়ে থাকে তাহলে সরকার নিজেই পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণ শুরু করে আরো কম খরচে পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণ করতে পারত | তা না করে তাহলে বেসরকারী ব্যবসায়ীদের হাতে দিচ্চ্ছে কেন? আর যদি বেসরকারী খাতে দিতেই হয় তাহলে বিদেশী কোম্পানিকে কেন? খরচ কমানোর অজুহাত আসলে কতটুকু যৌক্তিক | এখানে দেখতে হবে এই টেন্ডার দেওয়ার মাধ্যমে যতটুকু খরচ সরকার বাচায় সেই টাকা খরচ করে অন্য খাতে কতজন নাগরিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে | আর তাছাড়া এটাও ভাবতে হবে যে দেশীয় শিল্প রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব, একটি উন্নয়ন অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্রের জন্য স্রেফ খরচ কমানো মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে না |

বিদেশী কোম্পানিকে সুযোগ করে দেয়ার মধ্যে দিয়ে দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলির আমদানীকৃত যন্ত্রপাতির পূর্ণ ব্যবহার অনিশ্চিত হয়ে পরবে | কিছু মেশিন যা শুধু পাঠ্য পুস্তক প্রকাশের জন্যেই আমদানী করা হয়েছে সেগুলি অকেজো হয়ে পরে থাকতে পারে, এবং যেগুলি ব্যবহার করা হবে তা পর্যাপ্ত ব্যবহার না হলে উত্পাদনক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাবে | এই অব্যবহৃত কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে যেয়ে অন্যদিকে অসাধু ব্যবসার ইন্ধন জোগাতে পারে |

সরকার এই পাঠ্য পুস্তক বিনা মূল্যে বিতরণের কাজ হাতে নিয়ে তা সুপরিকলিতভাবে বাস্তবায়ন না করে বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে | মুদ্রণ শিল্প সমিতির মতে, প্রায় তিন কোটি পাঠ্য পুস্তক প্রকাশের দায়িত্ব বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে দিয়ে প্রায় এক লক্ষ্য শ্রমিক ও কর্মজীবির চার মাসের কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে | পরের বছর এরকম হলে আরো বেশী শ্রমিক তাদের কাজের সুযোগ হারাবে | এই কাজের মধ্যে রয়েছে বাইন্ডিং, প্লেট মেকিং, পজিটিভ তৈরি, কম্পিউটার চালনা, ডেলিভারি ইত্যাদি | বর্তমানে দুই লক্ষের বেশী শ্রমিক ও কর্মজীবি মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত | মুদ্রণ সমিতির একটি হিসাব অনুযায়ী ১৮ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস রফতানির মধ্যে প্যাকেট, স্টিকার, লেবেল, ট্যাগ, বক্স ইত্যাদির খরচ পরে প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার | তাছাড়া ওষুধ শিল্পে, হিমায়িত খাদ্য রফতানিতেও বিপুল পরিমান প্যাকেজিং প্রয়োজন পরে | বিশ্বায়নের সাথে সাথে মুদ্রণ শিল্পের গুরুত্ব যেমন বেড়ে চলেছে তেমনি বেড়ে চলেছে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা | কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্য নীতি নির্ধারক মহল নতুন ধরনের অনেক ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ে ঋণ দেওয়ার নতুন নতুন পথ তৈরী করছে, বিদেশী বিনিয়োগ এনে দেশে শিল্প খাত সমৃদ্ধ করে কর্মসংস্থান তৈরীর উদ্যোগ নিচ্ছে, বিদেশে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান খুজছে| এই সব কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা যেমন একদিক থেকে ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী, তেমনি অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য ঝুকিপূর্ণ | অথচ সামান্য কিছু উদ্যোগের অভাবে যেই সব খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে এবং আমরা অনেকদিন ধরে সক্ষমতা অর্জন করে এসেছি সেগুলোকে আমরা ঠিক মত কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছি |

সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণের এই প্রজেক্টের ২০% অর্থায়ন করে বিশ্ব ব্যান্ক | উদারীকরণ নীতির অনুসারী এই দাতা সংস্থা তাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের অংশীদারিত্বের পক্ষে | এবং তাদের সাথে সুর মেলানো যেহেতু আমাদের রাজনীতিবিদদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট, কাজেই পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণের ব্যাপারেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি | আমাদের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান গুলোকে এখানে যত অক্ষম হিসাবে হাজির করানো যাবে, যত বেশী দাতাসংস্থার শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রমান করা যাবে, এবং তত বেশী বিদেশী ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে | আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের আত্ববিশ্বাস ও সামর্থ্যকে গুড়িয়ে ফেলেই একমাত্র এই ব্যবসা সম্ভব |

এই পর্যালোচনা শেষে এখন ফিরে আসি মে মাসের ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রসঙ্গে | কেন এই ঘটনাগুলি ঘটছে?এর জন্য কি সকল মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করব না সরকারের পাঠ্য পুস্তক বিতরণের ব্যর্থতা ও পাঠ্য বই নকল চক্রের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতাকে দায়ী করব? আমাদের বুঝতে হবে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের তৈরির পিছনে কাদের ভূমিকা রয়েছে? কারা তাদের ইন্ধন যোগাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের কর্মসংস্থান বিপন্ন করে আমরা আসলে কি অর্জন করব?

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট-এর অর্থনীতির প্রভাষক।