বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে আমরা উদ্বিগ্ন

ড. মিজানুর রহমান
Published : 17 May 2012, 02:49 PM
Updated : 17 May 2012, 02:49 PM

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ রহস্য নিয়ে দেশে তোলপাড় হয়েছে অনেক। এ রহস্য উন্মোচনের দাবিতে বিরোধী দল কয়েকদিন হরতালও করেছে। আমি এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলছি, কোন ব্যক্তির নিখোঁজ বা অন্তর্ধান মূলত তিনটি কারণে ঘটতে পারে। প্রথমত, ব্যক্তি নিজে কোনো কারণে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যেতে পারেন। সেটি যদি ঘটে, তো তা একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি। এ নিয়ে রাষ্ট্রের উদ্বেগের কোনো বিষয় নেই। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিকে গুম বা নিখোঁজ করে দিতে পারেন কোনো ধরনের অপরাধী বা অপরাধী চক্র। এ ধরনের ঘটনা সারা বিশ্বেই ঘটে। তবে একটি দেশে বা সময়ে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে গেলে তা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির প্রমাণ দেয়। এটাও মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে আসলে একটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থতির উদ্ভব হয় তখনই যখন রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী ব্যক্তিকে নিখোঁজ বা গুম করেন। এ ধরনের ঘটনা যদি ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকে, তাহলে এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আমরা মূলত এই ধরনের গুম বা অন্তর্ধান নিয়েই উদ্বিগ্ন।

আমাদের দেশে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে ২০০৪ সালে যখন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হল, অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু হল, তখন থেকেই। ওই বাহিনীটিকে কিন্তু এমন অধিকারই দেয়া হয়েছিল যাকে বলা যেতে পারে 'লাইসেন্স টু কিল'। সেক্ষেত্রে অপরাধীদের ধরার পাশাপাশি ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে অপছন্দের কাউকেও নিশ্চিহ্ন করে ফেলা ওই বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়ে গেল। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হতে থাকলে এ পরিস্থিতিকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলা যেতে পারে।

এ কারণেই আমরা বরাবর একটা দাবিতে অনড় ছিলাম বা রয়েছি যে বিচারবহির্ভূতভাবে কাউকে অপহরণ, গুম বা হত্যা বন্ধ করতে হবে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুন্ন হয়। এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বা ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গুম করে ফেলার ঘটনা কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল। তখন এক বছরের চেয়ে পরের বছরের ঘটনার উর্ধ্বগতি দেখেছি আমরা। ২০১০ সালের ২৩ জুন মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে আমরা তাই রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা বা বাহিনীর দ্বারা ব্যক্তির গুম, অপহরণ বা হত্যাসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছি। এর ফলে ২০১১ সালের দিকে এটা দৃশ্যমানভাবে কমে এসেছিল। আমাদের পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত পরিকল্পনার মধ্যেও অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্বাচন করেছি এ বিষয়গুলোকেই। তবে ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে হঠাৎ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়তে শুরু করল। বিশেষ করে নরসিংদীর ঘটনা, কয়েকজনকে গণপিটুনিতে হত্যা, ঢাকায় দুজনকে পিটিয়ে হত্যা, এগুলো আমাদের খুবই উদ্বিগ্ন করেছে। এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠীর কলেজ ছাত্র লিমন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদিরের ওপর নির্যাতনের কথা বলব, মানবাধিকার কমিশন খুব সক্রিয়ভাবে এ দুজনের পাশে ছিল বলেই ওরা প্রতিকার পেয়েছে। এটা আমরা দাবি করতেই পারি। একইভাবে এখনও যেসব ঘটনা ঘটছে সেক্ষেত্রেও আমাদের ভূমিকা রাখতে হবে যাতে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পান।

তবে একটা ব্যাপারে আমি দাবি করব যে, রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা বাহিনীর হাতে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বা যাকে বলা হয় বিচারবহির্ভূত খুন বা গুম ইত্যাদি ঘটনা কিন্তু এখন আগের চেয়ে খুব বেশি বাড়েনি। তবু বর্তমানের ঘটনাগুলোও আমাদের কাছে প্রত্যাশিত নয়।

রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী যে নিখোঁজ হলেন, সেটা নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কেন কোনো উদ্যোগ নেয়নি সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। এ ধরনের ঘটনায় প্রথমত, ব্যক্তির পরিবার কমিশনে কোন অভিযোগ দাখিল করলে তার তদন্তের ভার আমাদের ওপর পড়ে। ইলিয়াস আলীর ঘটনায় এমনটি হয়নি। তার পরিবার কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেন নি। দ্বিতীয়ত, কমিশন বিষয়টি জেনে নিজ দায়িত্বে উদ্যোগ নিতে পারত। ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি ভেবেছিলামও। কিন্তু এ সময়ই দেখলাম তার পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়টি নিজে তদন্ত করেন, সেখানে আমাদের উদ্যোগের প্রয়োজন থাকে না।

আরেকটি কথা হল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। আমাদের আইনে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো ঘটনায় মামলা হয়ে গেলে সেটা কমিশনের এখতিয়ার-বহির্ভূত হয়ে যায়। আমরা দেখেছি, স্ব-প্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট বিভাগ এ ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছেন, রুল জারি করেছেন, তদন্তের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে সাগর-রুনি হত্যার ঘটনাটিও বিচারাধীন বলে এখানেও আমাদের কিছু করার নেই। আমরা শুধু তদন্তকারীদের অনুরোধ করতে পারি যাতে তারা তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করেন। কারণ দ্রুত বিচার পাওয়াও তো মানবাধিকার। দ্রুত বিচারকাজ শেষ না হলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয় বলে এ নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু এমন ক্ষেত্রে আমাদের বলতেই পারেন যে এ বিষয়ে আপনাদের কথা বলার কোনো এখতিয়ার নেই বা ইত্যাদি। তারা তা করেন না বরং আমি বলব তারা আমাদের কাছে তাদের অগ্রগতির তথ্য দিয়ে যথেষ্ট সহযোগিতাই করেন।

আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বলে সরকার আমাদের ওপর এ পর্যন্ত কখনো কোনো চাপ দেননি। কোনো মাধ্যমে বা টেলিফোনেও কখনো এটা আসেনি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি কিছু বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কথা বলেছি বলে তারা কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া এসেছে। এটাও স্বাভাবিক। তাদের বিরুদ্ধে যেহেতু এত কথা বলাবলি হচ্ছে বা লেখালেখি হচ্ছে তাই তাদের দিক থেকেও কিছু বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু এটা কোনো চাপ নয়। তাই আমি বলব, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ে আমাদের কমিশন অনেক বেশি স্বাধীন।

আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রথমত ও প্রধানত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। আমরা ২০১০ সালে যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করি তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অফিসে স্টাফ ছিলেন মাত্র ২৮ জন। এর মধ্যে ১২ জন হচ্ছেন সহযোগী সদস্য যাদের দিয়ে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ হবে না। বাকি ১৬ জনের মধ্যে ক'জন ক্লার্ক, কম্পোজারসহ অন্য ধরনের স্টাফরা রয়েছেন। মাত্র পাঁচজন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তদন্তের কাজ করেন। এই লোকবল দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এত এত ঘটনার পূর্ণ তদন্তভার দক্ষতার সঙ্গে পালন করা কীভাবে সম্ভব? তাই নিজেদের দায় স্বীকার করব আমি।

তবে এভাবে তো চলতে পারে না। তাই এই প্রতিষ্ঠানের লোকবল বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছি আমরা। সব মিলিয়ে ৯৩ জনের একটা জনকাঠামো দেয়া হয়েছে। এই লোকবল পেলে এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনকে পূর্ণ কমিশনার হিসেবে পাব। তাদের আমরা তদন্তের কাজে ব্যবহার করতে পারব। আমাদের আইন অনুযায়ী বিভাগীয় সদর এবং জেলা পর্যায়েও মানবাধিকার কমিশনের একটি করে অফিস থাকার কথা। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এটাও হবে। ধীরে ধীরে এভাবে মানবাধিকার কমিশনের বিস্তার হবে। তেমন এক দিনের স্বপ্ন দেখি আমি যখন অন্যান্য দেশের মতো আমাদের কমিশনটিও ডালপালা মেলে প্রসারিত হবে দিগন্তে। এই কমিশনের কাজের মাধ্যমে সারা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হবে। মানুষ আস্থা রাখবে কমিশনের ওপর।

আরেকটা কথা সত্যি, এ যুগে জাতীয়ভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি না করে কোনো দেশ এগুতে পারবে না। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতেও পারে না। কারণ আন্তর্জাতিকভাবেই বিষয়টি এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতেই হবে। আমাদের সরকারের পলিসিতেও এটা রয়েছে। আশা করছি মানবাধিকার কমিশনের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকবে। যখন ওটি হবে, তখন আমাদের ওপর চাপ বাড়বে ঠিকই, কিন্তু অপরাধীচক্র আমাদের কমিশনের তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার ভয় পাবে।

আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশেই মানবাধিকার কমিশন আকারে আয়তনে বড়। তাদের কাজের পরিধি ব্যাপক। ভারতে কেন্দ্রীয়ভাবে ৫০০ লোকবলের একটি টিম রয়েছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে দেড়-দুশো জনের দল। নেপালে রয়েছে ৩৫০ জনের দল। সেখানকার কমিশনটি আমাদের চেয়ে পুরনো। এসব দেশে আজ যেভাবে মানবাধিকার কমিশনগুলো কাজ করছে আমরাও সে লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে চাই।

একটা বিষয়ে আমি আশাবাদী, আজ দেশের মানুষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কথা জানেন। তারা এখানে আসছেন, এটাও সুখের কথা। এখানে সুখ এই অর্থে যে মানুষের ভরসাস্থল হতে পারছি আমরা। তাই বলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাড়ুক এটা তো নিশ্চয়ই কেউ চাইব না। বরং চাইব, সামাগ্রিকভাবেই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বদলে যাক। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম-খুনসহ কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কোনো ধরনের অন্যায়ের ঘটনা না ঘটুক। দেশের প্রতিটি কোণে সব নাগরিক তার সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার পান।

ড. মিজানুর রহমান : বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।