রাজউকের কর্তৃত্ব এবং আমাদের নগর পরিকল্পনা

তানভীর ইসলামতানভীর ইসলাম
Published : 9 May 2012, 01:17 PM
Updated : 9 May 2012, 01:17 PM

বিডিনিউজের ৭ই মের খবরে দেখলাম রাজউক গুলশানে অবস্থিত শিশু-কিশোরদের বিনোদন পার্ক 'ওয়ান্ডারল্যান্ড' ভেঙে ফেলতে শুরু করছে। রাজউকের মেজিস্ট্রেট বিডিনিউজকে বলেছেন, "এটা রাজউকের জায়গা। সবার জন্য উন্মুক্ত শিশু পার্ক করার জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বরাদ্দ দিয়েছিলো। কিন্তু এই নিয়ম না মেনে সিটি কর্পোরেশন বেসরকারিভাবে লিজ দেয়।"

ঢাকা শহরে নিয়ম বহিভূর্তভাবে যে অগণিত স্থাপনা রয়েছে এবং সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার স্বার্থে সেগুলো যে ভেঙে ফেলা প্রয়োজন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত এত অবৈধ ভবন-দালানকোঠা বাদ দিয়ে পার্কের মতো খোলা জায়গা যখন রাজউকের ভাঙচুরের তালিকায় অগ্রাধিকার পায়, তখন সেটা বেশ অবাক করার মতো ঘটনা বটে। ১৯৯০ সালে ওয়ান্ডারল্যান্ড কাজ শুরু করে এতদিন কীভাবে টিকে ছিলো সে প্রশ্নও আমাদের মনে আসে বৈকি। খবরে আরও যেটা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো- রাজউক জমি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে লিজ দিয়েছিলো, সিটি কর্পোরেশন নিয়ম না মেনে বেসরকারীভাবে পার্ক করার জন্য লিজ দেয়ায় তারা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করছে। অর্থাৎ এখানে রাজউকের কর্তৃত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ে বেশি।

আমি নগর পরিকল্পনায় সামান্য পড়াশোনা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ ও থাকার সুবাদে দেখেছি যে একটি শহরে নগর কর্তৃপক্ষের হাতেই সাধারণত নগর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভার নিয়োজিত থাকে। সেখানে ঢাকা শহর (বাংলাদেশের অন্য বড় শহরগুলোরও প্রায় একই অবস্থা) একমাত্র ব্যতিক্রম। এখানে সিটি কর্পোরেশনের ওপর কর্তৃত্ব করে রাজউক! একটা শহরে নগর কর্তৃপক্ষকে সহায়তার জন্য রাজউকের মতো পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকতেই পারে। কিন্তু তাদের কাজগুলো হওয়া উচিত নগর কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে, তাদের পাশ কাটিয়ে নয় এবং তাদের কাজের জন্য নগর কর্তৃপক্ষের কাছেই দায়বদ্ধ হওয়া উচিত। রাজউকের মতো একই শহরে নগর কর্তৃপক্ষের প্যারালাল কোন নগর প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর আর কোন শহরে আছে কিনা আমি জানি না।

টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৩ এর যে ধারায় ডিআইটি বা রাজউক সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে ডিআইটিকে মূলত একটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (development authority) হিসেবে গঠন করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইন সংশোধন করে এর উপর পরিকল্পনার (planning) ভার ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী এর প্রাতিষ্ঠানিক কোন পরিবর্তন আজও করা হয় নি! ফলে কোন প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত সংস্কার ছাড়াই (পরিকল্পনার ক্ষেত্রে) ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা প্রণয়ণ, উন্নয়ন এবং বিল্ডিং নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজউক একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতগুলো দায়িত্ব একসাথে নিলেও রাজউক তার আগের মূল দায়িত্ব অর্থাৎ ভূমি বা প্লট উন্নয়নের দিকেই বেশী মনোযোগী। ফলশ্রুতিতে রাজউক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাদের এ পর্যন্ত যে সব মাস্টার প্ল্যান উপহার দিয়েছে তার সিকিভাগও বাস্তবায়ন হয় নি। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিকটি উপেক্ষা রেখে প্লট উন্নয়ন এবং বিল্ডিং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে রাজউকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে।

রাজঊক বা ডিআইটির সম্ভাব্য এ পরিণতির কথা উপলব্ধি করে স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে 'ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৪' পাস করা হয়েছিল, যেখানে ডিআইটিকে সরিয়ে 'কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি'র মত আরও অধিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্ত্ত রাজনৈতিক ডামাডোলে পড়ে এ অধ্যাদেশটি কালক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান শাঙ্কল্যান্ড কক্স 'ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যান'-এর যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য দুটি পৃথক সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়। এর একটি ছিল 'ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি', যা ডিআইটিকে সরিয়ে ভূমি উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্যটি ছিল 'ঢাকা মেট্রোপলিটন প্ল্যানিং অথরিটি'- যার কাজ হবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং ভূমি উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের কাজ তদারকি করা। কিন্ত্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ রিপোর্ট কখনো গৃহীত হয় নি।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে রাজউক গঠন করা হয়েছিল তা আজ মোটামুটিভাবে ব্যর্থ বলা যায়। এর সমাধানে 'ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যান'(১৯৮১)-এর রিপোর্টে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা (planning) ও উন্নয়নের (development) জন্য পৃথক দুটি কর্তৃপক্ষ গঠনের যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তা বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নতুন আর কোন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি না করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে মহানগরীর পরিকল্পনা এবং রাজউককে সিটি কর্পোরেশনের তদারকিতে শুধু উন্নয়নের ভার দেয়া যেতে পারে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর জনবল ও দক্ষতাও সেভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।

ড. তানভীর ইসলাম: নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহকারী অধ্যাপক, জ্যাকসনভিল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।