গণহত্যাকারী মিয়ানমার রাষ্ট্রটি বিচারের মুখোমুখি হোক

তুরিন আফরোজ
Published : 17 Sept 2017, 07:08 AM
Updated : 17 Sept 2017, 07:08 AM

রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হল রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সরকারি হিসাব মতে, প্রায় আট লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান আরাকানে বসবাস করে। এরা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, রোহিঙ্গা মুসলমানরা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাদের সরকারের মতে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা হল বাংলাদেশি, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে।

ইতিহাস বলে, সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীততে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণ ছিল এই জাতির মধ্যে। পরবর্তীতে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্যীয়, মধ্য এশীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়দের মিশ্রণে উদ্ভুত এই শঙ্কর জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিজেদের রাজ্য ছিল। মিয়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গা মুসলমানরা হল ভারতীয়, বাঙালি ও চাটগাঁইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা তদানীন্তন বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা আরাকানে একটি জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।

মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় সকল প্রকার নাগরিক ও মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গা মুসলমানরা। মিয়ানমারে ভ্রমণ, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পরিচয়পত্র থাকা খুব জরুরি। কিন্তু সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের পরিচয়পত্র ইস্যু করে না। ফলে এমনিতেই পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়ছে।

মিয়ানমারের সরকারের ভূমি ও সম্পত্তি আইন অনুসারে বিদেশিরা কোনো সম্পত্তি ও ভূমির মালিক হতে পারে না। রোহিঙ্গা মুসলমানরা সরকারের দৃষ্টিতে অবৈধ অভিবাসী তথা বিদেশি। তাই তারা কোনো ভূমি বা স্থায়ী সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। বর্তমানে তারা যে সকল ভূমিতে বসবাস করছে, সরকার চাইলে যে কোনো মূহূর্তে সেগুলো দখল করে নিতে পারে।

সরকারি নিপীড়নের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাখাইনসহ অন্যান্য বৌদ্ধ আরাকানিদের উস্কানি দিচ্ছে অবশ্য সরকার নিজেই। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে বৌদ্ধ মৌলবাদে সরাসরি ইন্ধন ও মদন যোগাচ্ছে তারা। এর ফলে অনেকদিন ধরে মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও নির্লজ্জ গণহত্যা চালানো হচ্ছে।

মিয়ানমার রাষ্ট্র এর দায়ভার এড়াতে পারে না। নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা দেওয়া প্রত্যেক রাষ্ট্রের কর্তব্য। এছাড়া নাগরিকদের উপর গণহত্যা চালানো হলে কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকভাবেও দায়বদ্ধ থাকে। তবে শুধু মিয়ানমার রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিয়ে বলব না, বরং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিও আকর্ষণ করব। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমারের শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে বটে, কিছু রাষ্ট্র সহমর্মিতাও প্রকাশ করছে এ বিষয়ে– তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণও পাঠাচ্ছে– কিন্তু তাদের কি আর কোনো দায়িত্ব নেই?

আজকে বিশ্বে গণহত্যা বিচারের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত রয়েছে যার নাম হল International Criminal Court বা আইসিসি। কেন মিয়ানমারকে আইসিসি আইন অর্থাৎ Rome Statute 1998 এর অধীনে বিচারের মুখোমুখি করবার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ব সচেষ্ট হচ্ছে না? Rome Statute এর আর্টিকেল ১৩ অনুযায়ী, ৩ উপায়ে আইসিসিতে কোনো রাষ্ট্রের বিরদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে বিচার করা সম্ভব।

প্রথম উপায়টি হল, Rome Statute এর পক্ষভুক্ত কোনো রাষ্ট্র যখন নিজেই তার রাষ্ট্রীয় সীমানার অধীনে সংগঠিত গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে অপারগতা বা অনিচ্ছা প্রকাশ করে বিচারের দাবিতে আইসিসিতে আবেদন জানায়। এমনকি কোনো রাষ্ট্র যদি পক্ষভুক্ত নাও হয়ে থাকে তবে বিশেষ ঘোষণা দিয়ে সে আইসিসিতে বিচারের আবেদন জানাতে পারে। কিন্তু যেহেতু মিয়ানমার রাষ্ট্র নিজেই মুসলমানদের উপর সচেতনভাবে এই গণহত্যা সংগঠিত করছে সেহেতু আমরা আশা করতে পারি না যে, মিয়ানমার রাষ্ট্র এই কাজ করবে। মিয়ানমার রাষ্ট্র Rome Statute এর পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র নয় এবং সঙ্গত কারণেই ঘোষণা দিয়ে এই গণহত্যার বিচার তারা আইসিসিতে চাইবে না। তাহলে Rome Statute আর্টিকেল ১৩ অনুযায়ী উপায় থাকে আর মাত্র দুইটি।

একটি হল, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রেজ্যুলেশন পাশ করে মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর সংগঠিত গণহত্যার বিচারের বিষয়টি আইসিসিতে রেফার করে পাঠাতে পারে। ইতোমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর সংগঠিত গণহত্যার বিচারের উপর একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তবে এখনও তারা এ ব্যাপারে আইসিসিতে বিচারের জন্য কোনো রেজ্যুলেশন পাশ করেনি।

Rome Statute এর আর্টিকেল ১৩ অনুযায়ী শেষ যে উপায় রয়েছে তা হল, আইসিসিএর প্রসিকিউশন টিম স্বপ্রণোদিত হয়ে মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর সংগঠিত গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত করে মিয়ানমার রাষ্ট্রকে আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমরা দেখছি আইসিসিএর সংশ্লিষ্ট টিম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমি আন্তর্জাতিক বিশ্বের এহেন নির্লিপ্ততা দেখে হতাশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করছে। আমাদের সঙ্গে কিছু বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রও রয়েছে যারা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি শুধু শরণার্থী সহায়তার নয়, আরও ব্যাপক। এখানে একটি আইনি লড়াইয়ের ইস্যু রয়েছে। গণহত্যাকারী রাষ্ট্রকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

শুধু উঁহু-আহা না করে, ত্রাণ-সহায়তার আশ্বাস না দিয়ে, সমালোচনার ঝড় না তুলে আন্তর্জাতিক মহলের উচিৎ গণহত্যাকারী মিয়ানমার রাষ্ট্রকে আইসিসিতে বিচারের মুখোমুখি করা।