সু চির কাছে খোলা চিঠি

সালেক উদ্দিন
Published : 20 Sept 2017, 05:28 AM
Updated : 20 Sept 2017, 05:28 AM

প্রিয় অং সান সু চি,

আপনাকে চিঠি লেখার কোনো বাসনা ছিল না। সে যোগ্যতাও আমার নেই। আজও লিখতাম না যদি না আপনি বলতেন, রাখাইনে সবাই নিরাপদ। সেখানে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সংবাদ অপপ্রচার মাত্র।

রাখাইনের রোহিঙ্গাদের উপর হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ দীর্ঘদিন থেকেই চলছে। তাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য আপনার আগের সামরিক শাসকরা বহুবার বলেছেন, তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। যখন সারা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং উগ্র বৌদ্ধরা– যখন নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিচ্ছে পাহাড়ে-জঙ্গলে ও বাংলাদেশের সীমান্তে– হাজার হাজার মহিলা-শিশু-বৃদ্ধসহ আপামর জনতার কাফেলা ঢুকছে জীবন বাঁচানোর জন্যে– তখনও আপনি তাদের পক্ষে নেই। আপনার এই আচরণে সারাবিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ অবাক হয়েছেন। কারণ মানবাধিকার রক্ষার জন্যে নোবেল শান্তি পুরস্কারের তকমা রয়েছে আপনারই।

আপনার এই আচরণ, আপনার কথাগুলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি' কবিতার কথা মনে করিয়ে দিল। তখন ভারতের গুজরাটে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। হাজার হাজার ঘরবাড়ি রেললাইন গাছপালা উপড়ে পড়েছে। পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বৃদ্ধের চশমা। মৃত পশুর পাশে ঘুরছে ছন্নছাড়া বালক। সেই সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুজরাটের আকাশে বিমানে করে বন্যার দৃশ্য দেখতে না আসার জন্য কবি অনুরোধ করেছিলেন সেই কবিতায়। কারণ কবি ভয় পাচ্ছিলেন, বিমানের জানালায় বসে শূন্য থেকে তিনি দেখতে পাবেন চারিদিকে সাদা থৈ থৈ পানি, তার মধ্যে সবুজ গাছপালা। প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখে তাঁর মুখ ফসকে হঠাৎ বের হয়ে যেতে পারে, 'বাহ কী সুন্দর!'

যদিও ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেত্রী এমন কথা কখনও বলেননি। কিন্তু শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আপনি সেই কথাই বলে দিলেন। দাউ দাউ আগুনে রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা যখন জ্বলছে, নিষ্পাপ অসহায় শিশুর লাশ নাফ নদীতে ভাসছে, সেই সব দৃশ্য দেখেও বললেন, ভুয়া তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে রাখাইনের পরিস্থিতি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের প্রত্যেকের সুরক্ষা দিচ্ছে বলে দাবি করলেন। অথচ আপনিই সবচেয়ে ভালো জানেন আপনার এই দাবি যৌক্তিক কিনা।

আপনি আরও বললেন, মানবাধিকার বঞ্চনা ও গণতান্ত্রিক সুরক্ষার অর্থ আপনি খুব ভালো করেই জানেন। তাই আপনার দেশের সব মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অধিকারের সুরক্ষা আপনি নিশ্চিত করেছেন।

তাই তো হওয়ার কথা ছিল। তাই হবে বলেই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অক্লান্ত সংগ্রামের জন্যে আপনি শান্তির দূত হিসেবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু তা না করে কাদের প্ররোচনায় কীসের আশায় আপনি এমন অপরাজনৈতিক বক্তব্যের পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা ঈশ্বরই ভালো বলতে পারবেন।

মিয়ানমারের প্রিয় নেত্রী,

আপনি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে অপপ্রচার চলছে পৃথিবীজুড়ে যা সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। রাখাইনের সংখ্যালঘুদের জাতীয়তাবাদের চেতনার বিরুদ্ধে এবং তাদের জাতিগত নির্মূল করার প্রচেষ্টার সপক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার সে এক চমৎকার প্রচেষ্টা আপনার! আর তাই একটিবারের জন্যেও বললেন না নির্বিচারে হত্যা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা যে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে তাদের কথা। এতে কি আপনার সারাজীবনের মানবাধিকার রক্ষার সাধনা বাধাগ্রস্ত হয়নি?

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর যদি না বলত শুধুমাত্র আগস্ট মাসে রাখাইনে নির্যাতিত এক লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাহলে সম্ভবত সেটাও অস্বীকার করে বসতেন।

প্রিয় মানবাধিকারের প্রতীক,

আপনি জানেন কি, সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে এই যাত্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে? না, এটা আমার কথা নয়। জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার প্রতিনিধি ইয়াংহি লিএর কথা। বার্তা সংস্থা এএফপিকে এমন কথাই বলেছেন তিনি। জাতিসংঘ বলেছে, শুধুমাত্র সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের থাকার মতো যথেষ্ট জায়গাও হচ্ছে না। গুলিবিদ্ধ অনেক রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করছে আশ্রয় শিবিরে। সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে ৬ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছে।

শুধু কি তাই? নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় প্রবল স্রোতে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা নারী-শিশু প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে তার হিসাব কে রাখে প্রিয় সু চি!

প্রিয় গণতন্ত্রকামী নেত্রী,

ডেসমন্ড টুটুর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ১৯৮০ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তিনিও আপনার মতো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। সম্প্রতি তিনি টুইটারে আপনাকে লিখেছেন, 'রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা আপনার সময়েও চলছে। ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হয়ে ওঠা আপনার মতো একজন মনীষীর জন্য এমন একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া বড়ই বেমানান!' ন্যায়বিচার মানবাধিকার এবং জনগণের একতার কথা ভুলে না যাওয়ার জন্য তিনি আপনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রার্থনা করেছেন, আপনার সুমতির জন্য– বাড়তে থাকা রোহিঙ্গা সংকট যেন আপনার হস্তক্ষেপেই প্রশমিত হয় সেজন্য।

সারা পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী ও মানবাধিকার পূজারী মনীষীরা আপনার আচরণে আজ বিব্রত বোধ করছেন। 'দ্য পারফেক্ট হোস্টেজ' এর লেখক যুক্তরাজ্যের জাস্টিন উইন্টল সম্প্রতি বলেছেন, 'সু চি তাঁর নিজের প্রচার করা মূল্যবোধই মানছেন না। অথচ এই মূল্যবোধ তাঁকে একজন মহান ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।' তিনি দুঃখ করে বলেছেন, 'আপনার জনসমর্থন আছে, ক্ষমতা আছে, কিন্তু বহির্বিশ্ব আপনাকে নিয়ে কী ভাবছে সে বিষয়ে পাত্তাই দিচ্ছেন না। আপনি আপনার মূল্যবোধের খেই হারিয়ে ফেলেছেন।'

প্রিয় শান্তির দূত,

আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি মুসলিম-অধ্যুষিত সেই স্বাধীন আরাকান রাজ্যের কথা। আজকের রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা সেই রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। পরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বার্মা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই সময়েও মুসলিম রোহিঙ্গারা অন্যদের মতো নাগরিক অধিকার ভোগ করতেন। শত শত বছর ধরে বাস করে আসছি্লেন তারা– সেই আরাকান রাজ্যই আজকের রাখাইনরা। তারা আজ মিয়ানমারের অধিবাসী নয়, উগ্রবাদীদের এই যুক্তি কীভাবে আপনার সম্মতি পায়?

আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি তৎকালীন বার্মার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আপনার মানবতার জয়গান গাওয়ার কথা? আপনার অনুপ্রেরণা ছিল মহাত্মা গান্ধীর কথা। আপনি সেই সময়কার বার্মায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। এজন্য প্রায় ১৫ বছর কারা ও গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হয় আপনাকে। তারই স্বীকৃ্তি হিসেবে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান আপনি। আর সেই আপনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে রাখাইনে গণতন্ত্র হত্যা ও মানবাধিকারের অপমৃত্যুর জন্যে বিশ্বজুড়ে যে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে, নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার যে দাবি উঠছে তা কি একেবারেই অমূলক?

না, সু চি– এটা হতে পারে না। আপনাকে যারা ভালোবাসেন পৃথিবীর সেই মানবিক গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী মানুষদের মতো আমারও ধারণা, আপনি একটি বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন এবং সেই সুযোগটাই ব্যবহার করছে মিয়ানমারের উগ্রবাদীরা। এখনই সময় সেই বিভ্রান্তির বলয় থেকে বের হয়ে আসার।

প্রত্যাশা রইল, আজকের এই অং সান্ সু চির মধ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মানসকন্যা শান্তির দুত সেই সু চি ফিরে আসুন।