মিয়ানমারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উৎপাদিত সমস্যা ও বাংলাদেশের দায়

লুৎফুল হোসেন
Published : 16 Sept 2017, 08:32 AM
Updated : 16 Sept 2017, 08:32 AM

দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করা বন্যার পানি শুকায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দোরগোড়ায় পৌঁছানো দেশটার অবর্ণনীয় ফসলহানির হিসাব এখনও সম্পন্ন হয়নি। বন্যায় গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন মানুষের আহাজারি স্তিমিত হয়নি। এমন একটা সময়ে মাত্র দুসপ্তার ব্যবধানে চেপে বসেছে তিন লক্ষ উদ্বাস্তু সামাল দেওয়ার মতো জটিল এক চাপ। আশি শতাংশ নারী ও শিশু– বাকি কুড়ি শতাংশ নানান বয়সী পুরুষ। নির্মমভাবে জবাই হওয়া, পেট চিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরা কিংবা মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে পরিবার ও নিকটজনদের সামনে গুলি; হত্যাপর্ব শেষে নারীদের ধর্ষণ। উন্মুক্ত পাহারা চৌকি থেকে পালাবার পথ পেলেই প্রাণভয়ে ছুটে আসা এ উদ্বাস্তুদের অনেক মরেছে পথে পিছু ধাওয়া করা সেনাদের গুলিতে; পথে, বনে-জঙ্গলে, গাদাগাদি-চাপাচাপি করে অজানার পথে ভাসিয়ে দেওয়া নৌযানে।

প্রতিবেশি দেশের অন্তর্গত সমস্যার জের ধরে অকস্মাৎ চেপে বসেছে খোলা আকাশের নিচে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-পানি-পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যাজর্জরিত এ উদ্বাস্তুদের বিষয়টি। এদের অপরাধ, এরা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা। সাদা উচ্চারণে বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ মানুষ বলছে, জাতিগত সংঘাতের জের ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবৈধ নাগরিক বিবেচনায় দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই এর পেছনের কারণ।

বাস্তবতা এই যে, জাতিগত সংঘাত সংগঠিত হবার পেছনে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যুৎপত্তিভিত্তিক বৈষম্য কারণ হবার কথা সে প্রেক্ষাপট দৃশ্যমান হবার অন্তত তিন থেকে চার দশক আগে থেকে এ সংঘাত সেখানে বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া মুসলিম বলেই যদি শুধু এই বিদ্বেষের শিকার হতে হত তবে সেখানকার যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানেই ঘটনাটা ঘটবার কথা। তা নয়। অন্তর্গত অন্য সমস্যার কারণে সৃষ্ট এ সমস্যার মাধ্যমে সত্যকার বিবেচনায় মিয়ানমার তাদের নিজ ঘরের সমস্যার উছিলায় ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে উদ্বাস্তু শিরোনামে চাপিয়ে দিচ্ছে এমন এক বোঝা যা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতেও এ মাত্রায় সামাল দেবার নজির নেই।

আঞ্চলিক ও জাতিগত বিভেদ ঘিরে কেন্দ্রের সঙ্গে সব প্রদেশের কমবেশি সহিংসতা বিরাজমান থাকার দেশ মায়ানমার। অর্ধশতাব্দী ধরে চলমান পরিকল্পিত এক নির্মূল প্রক্রিয়ার জের ধরে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের প্রতি নজিরবিহীন নৃশংসতায় সংঘটিত হচ্ছে সহিংসতা, সেই ১৯৪২ সাল থেকে। বৌদ্ধ-অধ্যুষিত দেশটির প্রাচীন আরাকান অর্থাৎ বর্তমান গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য অতীত থেকে। সমুদ্রসীমা আর (বিশ্বখ্যাত আকিয়াব) বন্দর সুবিধার বিবেচনায় রাখাইন প্রদেশের গুরুত্ব অন্য রকম। এর দখল ঘিরে নানান শক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষাই এ সংঘাতের মূল।

কিচিন বা শান প্রদেশের মতো সহিংস রাখাইনের রোহিঙ্গারা কখনও ছিল না। হয়তো এটি দুর্বলতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুতা বিবেচনায় রোহিঙ্গা মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারে নিশ্চিহ্ণ হবার লক্ষ্য এক জনগোষ্ঠী। অবশ্য পুরো রাখাইন প্রদেশের চিত্র এক নয়। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষেই এ উন্মত্ততা সীমাহীন। তাড়া-খাওয়া রোহিঙ্গারা সর্বাধিক সংখ্যায় বসবাস করছে বুচিদং, মঙডু, রাথেডুঙ এলাকাগুলোতে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী, নাসাকা এবং সহিংস বৌদ্ধ গোষ্ঠী মিলে হটিয়ে তাড়িয়ে এক প্রান্তে এনে হাজির করছে এদের।

রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে ঘর গুণে মানুষের নাম নথিবদ্ধ করে পরিচয়পত্র দিয়েছে সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ পাণ্ডাদের দল। যখন-তখন মাইকিং করে ঘোষণা দিয়ে ওরা গ্রাম ঘেরাও করে, শুমারি করে। কোনো ঘরে সদস্য কম থাকলে বা কোথাও বাড়তি কাউকে পেলে নেমে আসে নির্মম শাস্তি– হত্যা। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ কারও রেহাই নেই। তারপর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ণ করে তবে শেষ।

এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে সেনাবাহিনীর পূর্বানুমতি নিয়ে যেতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকার কয়েক দশক ধরে বলছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকই নয়। তারা আগন্তুক, মিয়ানমারে অবৈধভাবে থাকছে, থাকতে চাইছে। অর্ধশতাব্দী সময়কাল ধরে বিরামহীন অত্যাচার আর প্রাণহানির ঝুঁকির ভিতর কেউ কি ভুলেও কোথাও গিয়ে অভিবাসী হতে চায়! অথচ মিয়ানমার সেটাই বলতে চাইছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের ওরা নাম দিয়েছে বাঙালি। কারণ হিসেবে বলতে চায়, চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে ভাষাগত সামঞ্জস্যের কথা। তেমন হলে তো ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সব মানুষ বাঙালি বাংলাদেশি হত।

বর্তমানে আশ্রয় নেওয়া তিন লক্ষের পাশাপাশি আরও অর্ধলক্ষ ঠাঁই নিয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডে বা সীমান্তবর্তী জঙ্গলে। ১৯৭৭ সালে রোহিঙ্গা সমস্যা স্বরূপ পাল্টাবার পর থেকে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আগে থেকেই এদেশে ছিল। যাদের কেউ কেউ এদেশের পাসপোর্ট বাগিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।

যারা রয়ে গেছে তারা সস্তা শ্রমিক হচ্ছে বাঁচার তাগিদে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পাশাপাশি অনৈতিক এবং ড্রাগ বা অন্য চোরাচালান সংক্রান্ত-কাজে বৃহৎ সংখ্যায় নিযুক্ত হয়ে আছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ও সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলোয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে ছাড়িয়ে আনছে তাদের স্থানীয় কর্মসংস্থানকারীরা। এক অর্থে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যপক ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে বিবিধ অপকর্মের সহযোগী শক্তি।

বাংলাদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে আশ্রয় নিয়েছে আরও প্রায় ছয় লক্ষ রোহিঙ্গা। পাকিস্তানে ও সৌদি আরবে দুই লক্ষ করে। থাইল্যান্ডে এক লক্ষ, মালয়েশিয়া ও ভারতে চল্লিশ হাজার করে; ইন্দোনেশিয়ায় বার হাজার। মোট মিলিয়ে বার লক্ষ থেকে বেড়ে এখন পনের লক্ষ রোহিঙ্গা দেশছাড়া। আর মাত্র চার লক্ষের মতো রোহিঙ্গা আছে মিয়ানমারে। যারা সুযোগ পেলেই দেশ ছেড়ে পালাবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে।

কোনঠাসা হতে হতে মাঝে মধ্যেই প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে উঠতে চাচ্ছিল রোহিঙ্গারা। কিন্তু কঠোর অবরোধ আর সারাক্ষণ নজরদারির মধ্যে থেকে খুব একটা কিছু করতে সক্ষম হওয়া বাস্তবে সম্ভব ছিল না তাদের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বেশ কিছু সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের খবর শোনা যাচ্ছে। 'আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি' বা আরসার সশস্ত্র সংঘাতের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়বার কথা আছে সেসব খবরের শিরোনামে। আগে 'ফেইথ মুভমেন্ট' বা 'হারাকাহ আল ইয়াকিন' নামে পরিচিত এ দলটির হাতে সাম্প্রতিক সময়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখা গেছে। রাখাইনে রাশিয়ার বিনিয়োগের সূত্র ধরেই বুঝিবা তাদের হাতে দেখা গেছে চকচকে কালাশনিকভ। এমন যদি সত্যিই হয় তবে রাশিয়ার স্বার্থ বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়।

আরসার নাম মূলত শোনা যাচ্ছে গত তিন বছর ধরে। যার নেতৃত্বে পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া আরাকানি রোহিঙ্গা 'আতাউল্লাহ' ওরফে 'আবু আমর জুনুনি'। পাকিস্তান থেকে জুনুনি সৌদি আরবে চলে যান, সেখানে মক্কার দশ শীর্ষনেতা ও সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা এবং অর্থায়নে জন্ম নেয় আরসা। আরসার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী গ্রুপ নয়, নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের মৌলিক অধিকার ও নাগরিকত্ব আদায়ের দাবিতে শুধুমাত্র নির্যাতনকারী সেনাবাহিনী সদস্যদের প্রতি জিহাদ সংঘটনের লক্ষ্যে সৃষ্ট একটি বিপ্লবী দল।

এমন প্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকারের সহিংসতায় সমর্থন দিচ্ছে অধিকাংশ দেশ আর রোহিঙ্গাদের উৎসাহ দিচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ। তা বাদে বাকি পক্ষ-প্রতিপক্ষ সব এক সুরই গাইছে। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে মোড়লিপনা আর আমেরিকার তাঁবেদারির লক্ষ্যে। ইরান ইসলামি ভাতৃত্ববোধে রোহিঙ্গাদের অধিকারের দাবিতে সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়ার বিনিয়োগ আছে রাখাইনে ও মিয়ানমারে– তাই এবং হয়তো কালাশনিকভ সংযোগ-সূত্রেও। আমেরিকা, ইউকে আর জাতিসংঘের ভূমিকা একসূত্রে গাঁথা; যার স্বার্থ ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির অর্থনৈতিক ঔপনিবেশবাদ। চীনের ভূমিকা বেশি দীর্ঘতম সীমান্তরেখার ভাগীদার ও দীর্ঘদিনের মিত্র শক্তি হিসেবে যতটা না, তার চেয়ে আসলে বাণিজ্যিক আধিপত্যবাদ ঘিরে। ভারতের ভূমিকাটাও ওই বাণিজ্যিক আধিপত্যবাদের ঘেরাটোপেই বাকি সবার মতো মিয়ানমার সরকারের পক্ষে।

অতিউন্মুক্ত নীতিতে চলা বর্তমান মিয়ানমারে বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যক্তিখাতের কিছু বিনিয়োগ থাকলেও তা হয়তো রাষ্ট্রের বিবেচনায় আনবার মতো সুবিশাল কিছু নয়।

পাকিস্তান, সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের মদদ দিচ্ছে ইসলামি জিহাদের প্রস্তাবনায়। সার্বিক অরাজকতার সুযোগে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রতিরোধের পথে ঠেলে দিতে চাইছে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থী দলগুলো। কিন্তু বিশ্বের এগারতম বৃহৎ ও নৃশংসতার ঐতিহ্যের ধারক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকশ বা কয়েক হাজার বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা বিপ্লবী দিয়ে আসলে কোনো কিছুই যে করা সম্ভব নয় তা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই বুঝতে পারছে। সহিংসতার বুদ্ধিতে অস্ত্র আর ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধারা পরিশেষে পারিপার্শিক এলাকায় সামাজিক সঙ্কটের কারণ ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারবে না।

মগ জলদস্যুতার ঐতিহ্য নিয়ে গোটা মিয়ানমারের অমানবিকতার ইতিহাস অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের। শত শত বছরের সেই ঐতিহ্য এখন দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো ক্ষুদে বিদ্রোহী দল-উপদলগুলো স্থানীয়দের সহানুভূতি কতকাংশে অর্জন করলেও আস্থা সেভাবে অর্জন করতে পারেনি। কিছু তরুণ এবং পুরুষ ছুরি-তলোয়ারের নিচে বা বুলেটে মারা যাওয়ার চেয়ে জিহাদি বা বিপ্লবী তকমায় আত্মঘাতী হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে যোগ দেওয়া মানে কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়া নয়। এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা।

মিয়ানমারের অন্তর্গত সমস্যার জের ধরে উদ্ভুত উদ্বাস্তু সমস্যা বাংলাদেশের উপর মিয়ানমার সরকারের চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। মিয়ানমারের বৌদ্ধ-বংশোদ্ভুত রোহিঙ্গা গবেষক, ১৯৮৮ সালে মিয়ানমার ত্যাগ-করা ড. মঙ জার্ণির বিশ্বব্যাপী অগণিত উপস্থাপনা অনুযায়ী, নিকটবর্তী চট্টগ্রাম এলাকার বাংলাভাষীদের সঙ্গে ভাষাগত মিলের সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা আসলে গোয়েবলসের পূনপুন মিথ্যা উচ্চারণের মাধ্যমে সেটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার সফল এক মিয়ানমার সরকারি অপচেষ্টা। গণহত্যার চার চারটি সূত্র ভয়ানকভাবে প্রমাণিত, নির্মূল লক্ষ্যে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞটি মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ঘটমান ভয়াবহ এক গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুঃখজনক আরও এই যে, নোবেলজয়ী অং সান সু চি গণহত্যার সত্যটি বারবার অস্বীকার করে নোবেলকে নয়া ঔপনিবেশবাদের এক হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। সারাবিশ্বের মানুষ এ নিয়ে হতাশ হলেও রাষ্ট্রপক্ষ নীরব বা কখনও এমনকি সরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল মিয়ানমার সরকার এবং নির্লিপ্ত সু চিকে। সবার আগে নৈর্ব্যাক্তিকভাবে সত্যের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া বক্তব্যে সোচ্চার হয়েছেন কানাডার রাষ্ট্রপ্রধান জাস্টিন ট্রুডো। বাংলাদেশ সরকারের কুটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং কফি আনান কমিশনের প্রস্তাবনার জের ধরে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বজনমত একটু একটু করে নড়তে শুরু করেছে।

তবু প্রশ্ন থেকে যায় অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থের বিবেচনা পাশ কাটিয়ে মানবতার স্বার্থ বিবেচনা করবার মতোন সত্য অবস্থানে আসতে পারবে কি বিশ্বনেতৃত্ব? বাংলাদেশের কুটনৈতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে সম্ভবত খোদ রোহিঙ্গাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। আর তাতে সফল হলে এদেশের জন্য দীর্ঘদিনের পুরোনো এবং জ্বলন্ত এক সমস্যার সমাধানও সম্ভব হয়ে উঠবে। এ লক্ষ্যে কুটনৈতিক মঞ্চকে সচলতর, সক্রিয়তর করা সময়ের সবচেয়ে জোর দাবি।

সরকার সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখে গত দুদিনে দেশে ও বিদেশে নিজেদের অবস্থান এবং ভাবমুর্তি যতটা স্পষ্ট করেছে ততটাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সরকারের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন, বিশাল শরণার্থী এলাকা বরাদ্দ, মানবাধিকারের প্রশ্নে মানবতার ঝাণ্ডা তুলে ধরবার মানসিকতা প্রসংশিত হচ্ছে। পাশাপাশি আপামর জনতার সোৎসাহ মানবিক সাহায্যের হাত অগণিত মানুষের খাদ্য ও বস্ত্রের সংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাসস্থানের ব্যবস্থাকল্পে সরকারের জায়গা ব্যবস্থা করবার সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি ব্যক্তি ও সামাজিক কল্যাণ উদ্যোগগুলো তাঁবু ও অন্যান্য অস্থায়ী আয়োজন এবং পয়নিষ্কাশন ব্যবস্তা স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে।

কিন্তু তিন লক্ষ সহায়সম্বলহীন আশি ভাগ নারী ও শিশুর পরিসংখ্যান মিললে সঙ্কটের গায়ে আরও কিছু শঙ্কা জুড়ে যায়। সেটা সামাল দেওয়া, বায়োমেট্রিক উদ্যোগের নগন্য সাফল্যকে দ্রুত পুর্ণাঙ্গ সম্পন্নতায় পৌঁছে দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা একটা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে এনে সুযোগসন্ধানী লোকদের আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বড় তহবিল আসার আগেই সামলে না নিলে ফলাফল বাংলাদেশকে আরও বিবিধ জটিল সমস্যার মুখোমুখি করবে তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য দ্রুততর সময়ের ভিতর উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

কল্যাণমুখী উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় মানবতা রক্ষার পাশাপাশি সঙ্কট মোচনের প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উদ্বাস্তু প্রশ্নে যা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। কারণ এমন দৃততার সঙ্গে মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার নজির বড় ও শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোও অতীতে দেখাতে সমর্থ হয়নি। এর পিঠে জোর আশাবাদের সঙ্গে নেতিবাচক সম্ভাব্য পথগুলো রুদ্ধ করবার জন্য সরকার ও জনগণ হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে দেশ ও নেতৃত্বের জন্য সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি আশীষও জুটবে বলে বিশ্বাস।