নিসর্গসখার মহাপ্রয়াণ

অপূর্ব শর্মা
Published : 15 Sept 2017, 04:13 PM
Updated : 15 Sept 2017, 04:13 PM

মানুষ-প্রকৃতির মিশে থাকার সভ্যতা চাওয়া দ্বিজেন শর্মা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সাতসকালে যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে জানতি পারি বিষণœতায় আচ্ছাদিত হয়ে ওঠে হৃদয়। যদিও আগে থেকেই জানতাম, যে কোনও সময় এমন সংবাদ শুনতে হতে পারে। তারপরও মনকে সান্তনা দিতে পারছিলামনা।

পরিণত বয়সেই মৃত্যু হয়েছে দ্বিজেন শর্মার। তবে, সকল মৃত্যুই বেদনার। স্বভাবতভাবেই তাঁর মৃত্যুতে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষ আজ শোকাতুর। প্রচারের সহজ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যানে সারাদেশের মানুষ ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছে তাঁর প্রয়ানের খবর। দেহ আছে, অথচ সেখানে প্রানটি নেই। নিথর দেহ, পড়ে আছে হিমঘরে। 'জন্মিলে মরিতে হবে।' এটাতো চিরায়তই। কিন্তু মহাজ্ঞানীদের মহাপ্রয়ান মেনে নিতে কষ্ট হয় আমাদের। কবি, লেখক ফরিদ কবিরের বক্তব্য থেকেই তা স্পষ্ট। তিনি তার ফেবু স্ট্যাটাসে লিখেছেন, 'সকালে তাঁর চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে! সমীহ করার মতো, কাছে গেলে শ্রদ্ধায় অবনত হওয়ার মানুষ এখন চারপাশে খুব বেশি নেই।' আর কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের লিখেছেন, 'একটি বৃক্ষ কিংবা একটি ফুল কিংবা একটি উদ্ভিদ (দ্বিজেন শর্মা) চলে গেলেন!' এভাবে ফেসবুকে চলছে দ্বিজেন শর্মার প্রয়ানে শোক প্রকাশ, আর বন্ধনা। মরচুয়ারিতে শুয়ে থাকা দ্বিজেন দার কাছে কি এসব কথামালা, অনুভূতি পৌছাচ্ছে? প্রশ্নটি আপেক্ষিক! পৌছাচ্ছে হয়তবা!

ফুলকে ভালোবাসতেন তিনি। আজওতো ফুল ফুটেছে, নানা রঙের ফুল! তারা কি কাঁদছে তাঁকে হারানোর বেদনায়। বৃক্ষকে ভালোবাসতেন তিনি, তারাও কি আজ অশ্রæসিক্ত নয়নে প্রলাপ বকছে স্বজন হারানোর বেদনায়? প্রকৃতি কি ব্যাথাতুর সন্তান হারানোর বিষন্নতায়? হয়তো! সখার প্রয়ানে কেনও কাঁদবেনা তারা? মানুষের পাষাণ হৃদয়ে যখন ক্ষরণ হচ্ছে, প্রকৃতির কেনও হবে না? এমন সখাতো আগে পায়নি বাংলার ভূ-প্রকৃতি!

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ইশ্বর। দ্বিজেন শর্মা, দেখালেন প্রকৃতিকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'ঢাকার প্রায় সব গাছপালাই আমি চিনি।' আমরা যে শহরে বাস করি তার সব মানুষকে কি চিনি? নিশ্চই না। আর বৃক্ষ সেটাতো অনেক দূরের পথ! অথচ দূরের, কঠিন এই পথের সঙ্গে থাকা বৃক্ষরাজিকে তিনি ঠিকই চিনতেন। তাদের ছায়াতলে বসে নিতেন নিঃশ্বাস।

তিনি বার বার বলেছেন, প্রকৃতির বিনাশ মানেই আমাদের নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনা। আমরা কি তাঁর কথা শুনেছি, একটি বারও তাঁর মতো করে ভেবেছি? জগদীশ চন্দ্র বসু যেখানটায় শেষ করেছিলেন, 'গাছেরও প্রাণ আছে।' ঠিক সেখান থেকেই প্রাণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত হলেন তিনি। কঠিন এক সংগ্রাম। মানুষকে ভালোবাসার মানুষের সংখ্যাই যে সময়টায় কমে যাচ্ছে, সে সময়টায় উদ্ভিদকে, ফুলকে ভালোবেসে, তাদের সম্পর্কে জাতিকে সচেতন করার কঠিন ব্রতে রত হলেন তিনি। হাতে তুলে নিলেন কলম। তাঁর সেই অভিযাত্রার সূচনা কিন্তু হয়েছিল প্রাকৃতির সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি সিলেট থেকেই। বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে যে সময়টায় দ্বিজেন শর্মা জন্মগ্রহন করেন (১৯২৯ সালের ২৯ মে) সেই সময় প্রকৃতির অপার সৌন্দয্য ছিলো তাঁর বাড়ির চারপাশে। সেটাই বৃক্ষ অরণ্য আর প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা গড়তে সহায়তা করে তাঁর মানসপটে। বাড়ির পাশের পাথারিয়া পাহাড় সেই ভালোবাসাকে আরও প্রবল করে তোলেছিলো। বাবা ছিলেন কবিরাজ। সে কারনে বাড়ির বাগানে ছিল অজ¯্র গাছগাছালি। ছিলো নানা ফুলে সমারোহ। শৈশবে দেবতার জন্য ফুল তুলতে গিয়ে গন্ধে বিমোহিত হতেন, সেই থেকেই এক অদ্ভুত মায়া জন্মে ফুলের প্রতি। সে ভালোবাসা আজন্ম লালন করে গেছেন তিনি।

একদিকে, লেখাপড়া অন্যদিকে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। এযেনো এক অদ্ভুত সমন্বয়। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে দ্বিজেন শর্মা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন করিমগঞ্জ কলেজে। এরপর বি এম কলেজ ও নটর ডেম কলেজে করেন শিক্ষকতা। যেখানেই ছিলেন সেখানেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সমারোহ ঘটিয়েছেন বৃক্ষরাজির। তবে তাতে ছন্দপতন ঘটে ১৯৭৪ সালে। সোভিয়েতে প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে মস্কো চলে গিয়ে নতুন এক সৃষ্টির নেশায় বুদ হন তিনি। চল্লিশটিরও বেশি বই অনুবাদ করে অনুবাদ সাহিত্যে যুক্ত করেন ভিন্নমাত্রা। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চলে আসেন দেশে। তবে, দীর্ঘ প্রবাস জীবনের স্মৃতি মুছতে পারেননি মন থেকে। সাম্যের সোভিয়েত, তাঁর চেতনাকে সর্বদাই করেছে আলোড়িত। দেশে ফিরে যুক্ত হন এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে।

বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগ থাকায় কিছুকাল তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। শুধু তাই নয়, কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি 'দুর্লভ' আখ্যা দিতেন সবসময়। জীবনের প্রয়োজনে যেখানেই কর্মে নিয়োজিত হয়েছেন, সেখানেই রত ছিলেন প্রাণ ও প্রকৃতির রূপের সন্ধানে। যার ফলশ্রæতেতে আমরা পেয়েছি উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে তাঁর লেখা প্রায় দেড় ডজন বই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে, 'সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস', 'ফুলগুলি যেন কথা', 'গাছের কথা ফুলের কথা', 'এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি', 'নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা', 'সমাজতন্ত্রে বসবাস', 'জীবনের শেষ নেই', 'বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ', 'ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি', 'বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা', 'গহন কোন বনের ধারে', 'হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার', 'বাংলার বৃক্ষ'।

উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে তাঁর লেখা 'শ্যামলী নিসর্গ'কে আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রন্থটিতে গাছ, ফুল বা ফলের বর্ণনায় ফিরে ফিরে এসেছে ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সিলেটের লোকগীতি কিংবা মধ্যযুগের কাব্যগাথা।

লেখালেখির জন্য তিনি অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মান তার কর্ম সম্পৃহাকে করেছে বেগবান। কিন্তু এর সবকিছুই তিনি করেছেন দায়বদ্ধতা থেকে। সমকালে যাকে এককথায় বিরল বলা চলে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির বৃক্ষ লাগিয়ে, বাগান তৈরী করে অনুসারীদের বৃক্ষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় তা শিখিয়ে তিনি পালন করেছেন সত্যিকারের বৃক্ষাচার্য্যরে দায়িত্ব। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য প্রচারণা চালাতে গিয়ে সর্বদাই তিনি বলেছেন, 'আমি একদিন থাকব না, কিন্তু গাছগুলো থাকবে। মানুষকে অক্সিজেন বিলাবে। জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই।'

আনন্দে থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি। তাই মানুষকে ভালোবাসতেন। বলতে পারি, অন্যদের চাইতে একটু বেশিই ভালোবাসতে পারতেন। 'বেশি' কথাটা এ কারনেই জোর দিয়ে বললাম কারন তার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ হয়েছিলো আমার। যখনই কথা বলতাম, উচ্চস্বরে হাসি দিয়ে বলতেন কেমন আছো? তাঁর এই কেমন আছোতে, ছিলো ভালোবাসার আবেশ। তাঁর ইচ্ছে ছিল, একবার সিলেট আসার। গত মার্চ মাসে বড়লেখা, মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট এসে অবস্থান করার কথা ছিলো। সিলেটের তরুনদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার বাসনা ছিলো তাঁর মনে। পরিকল্পনাও করেছিলাম তাঁর সাথে কথা বলে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা সায় না দেওয়ায়, সেই বাসনা পুরন হলোনা!

তবে, করুণ একটি কথা বলে, শেষ করতে চাই লেখাটি। দ্বিজেন শর্মারা বার বার জন্মায় না। তারা ক্ষনজন্মা। কিন্তু এই ক্ষনজন্মা পুরুষকেও নিঃসঙ্গতার বেদনায় আচ্ছাদিত হতে দেখেছি। হতাশার সুরে বলতে শুনেছি, তাঁর প্রায় একা হয়ে যাওয়ার কাহিনী। বইমেলায় অভিজিৎ যেবার খুন হন, সেবার শেষ দিকটায় আমাকে তাঁকে বইমেলায় নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আকস্মিক এই ঘটনার পর ফোন করে জানালেন, রক্তাক্ত বইমেলায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর!

মৃত্যুতে আমরা তাঁর গুনের কদর করছি। অথচ জীবদ্দশায় বার্ধক্যজর্জরিত তাঁকে কি সঙ্গ দিয়েছি, নিঃসঙ্গতায়! দেওয়াটা কি খুব বেশি কঠিন কাজ ছিলো? ছিলো না! পারতাম, কিন্তু আমরা যে ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি! দ্বিজেনদাকে সম্মান জানাতে হলে, এই ভালোবাসাটাই জাগ্রত করতে হবে হৃদয়ে; মানুষে মানুষে, মানুষে উদ্ভিদে কিংবা ভিন্ন প্রানীতে। তাইলেই যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে দ্বিজেনদাকে। তিনি যে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন সেটাও পুরণ হবে এই ভালোবাসায়। যা অসহিষ্ণুতার এই সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন।