মেয়েশিশুদের প্রতি আরও সংবেদনশীলতা কাম্য

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 18 Sept 2017, 02:00 PM
Updated : 18 Sept 2017, 02:00 PM

একটি রাষ্ট্র, একটি সমাজ কতটুকু সভ্য, কতটুকু মানবিক, কতটুকু সংবেদনশীল, এমনকি কতটুকু গণতান্ত্রিক সেটা পরিমাপের একটি বড় মাপকাঠি হল ওই রাষ্ট্র, ওই সমাজ মেয়েশিশুদের প্রতি, নারীদের প্রতি কেমন বা কী ধরনের আচরণ করে। মানবউন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা ও অবস্থান ক্রমাগত ভালো হচ্ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে। কিছু কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। কিন্তু মেয়েশিশু তথা নারীদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজ কি পুরোপুরি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পেরেছে?

অগ্রগতি একেবারে নেই সেটা বলা ঠিক হবে না। সরকারের কিছু নারীবান্ধব আইন ও নীতি এবং বেসরকারি উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহের ধারাবাহিক চেষ্টায় মেয়েশিশুদের এবং নারীদের অগ্রগতি খোলা চোখেই দৃশ্যমান। মেয়েরা দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছে, এমনকি সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা সাইকেল চালিয়েও স্কুলে যাচ্ছে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর হার সমান সমান, কোথাও-বা মেয়েরা একটু এগিয়ে। তবে উচ্চ ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েরা এখনও পিছিয়ে আছে।

মেয়েশিশুদের প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাবও বদলাতে শুরু করেছে। মেয়েদের প্রতি আগে যে প্রবল বৈষম্যমূলক মনোভাব পোষণ করা হত, যেরকম বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত, এখন অনেক ক্ষেত্রেই সেরকম করা হয় না। ছেলেশিশুদের তুলনায় মেয়েশিশুদের খারাপ খাবার দেওয়া কিংবা অবহেলা করার ঘটনা এখনও হয়তো আছে, কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সচেতনতাও বাড়ছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে অভিভাবকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আগে যেভাবে বলা হত– মেয়েরা বেশি লেখাপড়া করে কী করবে, ওদের তো শেষপর্যন্ত চুলার কাছেই সময় কাটাতে হবে অর্থাৎ রান্নাবান্নার কাজই করতে হবে– এটা ছেলের কাজ, ওটা মেয়ের-– এই বিভাজনরেখা ক্রমেই কমতে শুরু করেছে।

যেসব কাজ মেয়েদের জন্য কঠিন বলে মনে করা হত, যেসব শুধু ছেলেদের কাজ বলে মনে করা হত, এখন সেসব ক্ষেত্রে আর বাধার পাহাড় নেই। মেয়েরা পাহাড়চূড়ায় যেমন অবলীলায় পৌঁছে যাচ্ছে, তেমনি বিমানচালনাতেও পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সব ধরনের পেশায় মেয়েদের সরব উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে যে, তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা না হলে তারাও ছেলেদের, পুরুষদের পাশাপাশি এগিয়ে যেতে সক্ষম।

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নারীদের, মেয়েদের এগিয়ে আসার লক্ষণ স্পষ্ট। ১৯৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী পদে নারীকেই দেখা যাচ্ছে। এটাকে অবশ্য কেউ কেউ নারীর ক্ষমতায়ন বলে মানতে চান না মূলত দুটো কারণে। এক, এঁরা কেউ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে আসেননি। তবে যেভাবেই এসে থাকুন না কেন, রাজনীতিতে তাঁরা যোগ্যতার পরিচয় যে দিয়েছেন সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুই, প্রায় দুই দশক ধরে সরকারপ্রধান বা বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব দুইজন নারী পালন করলেও তাঁরা মূলত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করেন বলে নারীমুক্তি বা নারীজাগরণের কাজের ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা আছে।

তারপরও এটা স্বীকার করতে হবে যে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকার নারীবান্ধব নীতি ও আইন প্রণয়নে এগিয়ে আছেন। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এবং পশ্চাৎগামী মানসিকতা বহাল থাকায় অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হচ্ছে বার বার।

এই আলোচনা থেকে কেউ আবার ভেবে বসবেন না যে, বাংলাদেশের মেয়েদের বোধহয় আর কোনো সমস্যা নেই। বাধা অতিক্রম করেই মেয়েরা এ পর্যন্ত এগিয়েছে। তাদের চলার পথে এখনও অনেক কাঁটা বিছানো আছে। সব কাঁটা সরিয়েই মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে। সে চেষ্টা তারা জারিও রেখেছে। মেয়েদের, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে মেয়েশিশুদের জীবনে একদিকে যেমন আছে নিরাপত্তার সমস্যা, অন্যদিকে বাল্যবিয়ের অস্বাভাবিক প্রবণতা। শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ, হয়রানি, যৌননির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণের মতো বিষয়গুলো কমার লক্ষণ দেখতে না পাওয়াটা উদ্বেগের ব্যাপার।

বাল্যবিয়ে এমন একটি সামাজিক ব্যাধি যেটা দূর না হলে আসলে নারীমুক্তির পথ সুগম হবে না। মেয়েদের চলাচল নিরাপদ করতে না পারলে, বাল্যবিয়ে এবং ঝরে-পড়া রোধ করতে না পারলে আমরা আজ নারীরা এগিয়েছে বলে যে বড়াই করছি তা করতে পারব না।

মেয়েদের পথেঘাটে উত্ত্যক্তকরণ, হয়রানি ও যৌননির্যাতন বন্ধ করার জন্য সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা বাস্তবে 'বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেড়ো'র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা কোনো সভ্য, মানবিক সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়। ধর্ষণ, গণধর্ষণের যেসব নিষ্ঠুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তা পাঠ করে কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা কঠিন। প্রশ্ন উঠছে, কিছু সংখ্যক মানুষ এমন অমানুষের আচরণ করছে কেন? কেন শিশুধর্ষণ, নারীধর্ষণের মতো পাশবিকতা বন্ধ হচ্ছে না? ভয় ও আতঙ্ক সঙ্গী করে আমাদের মেয়েদের বাঁচতে হবে, চলতে হবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকে অনেকভাবে খুঁজছেন। কেউ বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দুষছেন। কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা-অদক্ষতা-নারীর প্রতি নেতিবাচক মানসিকতার কথাও বলছেন। কারও-বা চোখে পড়ছে সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়টি। পরিবারের শিথিল গ্রন্থিকেও দায়ী করছেন অনেকে। কোনো একটি কারণে নয়, অনেক কারণের সম্মিলিত ফল হয়তো ধর্ষকামী করে তুলছে একশ্রেণির পুরুষকে।

পারিবারিক সচেতনতা এক্ষেত্রে একটি বড় বিষয় বলে আমার মনে হয়। যে বা যারা এসব অপরাধ করছে, সে বা তারা কোনো না কোনো মায়ের সন্তান, কোনো না কোনো বোনের ভাই, কোনো না কোনো স্ত্রীর স্বামী। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একজন এমন দুর্বৃত্ত হয়ে উঠছে কী করে? পরিবারের সকল সদস্যের নজরদারি থাকলে একজনের পক্ষে বখে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। সেজন্যই আমার মনে হয়, আমাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সচেতন ও দায়িত্বশীল হলে নারীনিগ্রহ, নারীর প্রতি অসম্মান, নারীনির্যাতনের ঘটনা কমে আসবে।

আমদের দেশে নারীনির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে আইন এবং নীতিমালা থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আইন যেন মাকড়শার জালে পরিণত না হয়, সেদিকে সবার নজর রাখতে হবে। নাগরিক সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ, অপরাধীর শাস্তি হওয়া, নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের নেতিবাচক আচরণের জন্য সামাজিক-পারিবারিক নিন্দা-ধিক্কার-– এই বিষয়গুলোর সম্মিলিত বাস্তবায়নেই আমরা কন্যাশিশু এবং নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ভূবন গড়তে পারব।

সবশেষে বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গ। আমাদের দেশে বাল্যবিয়ের হার খুব বেশি। রীতিমতো উদ্বেগজনক। এজন্য কোনো পরিসংখ্যান উল্লেখ না করে সাদা চোখে দেখা সত্যটা স্বীকার করলেও এর ভয়াবহতা অনুমান করতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কেও নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নারীর অগ্রগতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে একটি বড় বাধা। আশার কথা এটাই যে, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে কিছুটা সামাজিক সচেতনতা গড়ে উঠেছে। বাল্যবিয়েকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বাল্যবিয়ে নিরোধের লক্ষ্যে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যদিও এই আইনের একটি বিশেষ ধারা নিয়ে অনেকের আপত্তি-সমালোচনা আছে। তারপরও আমরা যদি আইনটি ইতিবাচকভাবে দেখি এবং এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে বাল্যবিয়ের কুফল থেকে সমাজকে মুক্ত করতে বেশি বেগ পেতে হবে না।

শুধু আইন দিয়ে কোনো অপরাধ দূর করা যায় না। আইন একটি বড় হাতিয়ার অবশ্যই। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি হল মানুষের সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কন্যাশিশুদের যদি বোঝা মনে না করে সম্পদ মনে করা হয়, তাহলেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গার্লস সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বয়সীদের বিয়ের হার শূণ্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন। আমরা আশা করব প্রধানমন্ত্রী তাঁর অঙ্গীকার পূরণে আন্তরিক থাকবেন।

একই সঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তাদের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। বিভিন্ন সংগঠন এই ইস্যু নিয়ে কাজ করলে নিজেদের কাজের সমন্বয় করতে হবে। আমাদের সম্পদ ও সামর্থের সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে সব ধরনের অপচয়রোধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

সে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, মেয়েশিশুদের, মেয়েদের জীবন আলোকিত করা, সমৃদ্ধ করা– সরকার বা কারও একার কাজ নয়। সবার কাজে সবার অংশগ্রহণই পারবে বিদ্যমান অবস্থার দৃশ্যমান বড় পরিবর্তন আনতে।