নেটওয়ার্ক জটিলতায় বাংলাদেশ!

রাশেদ মেহেদী
Published : 10 Sept 2017, 07:28 AM
Updated : 10 Sept 2017, 07:28 AM

ইংরেজি 'নেটওয়ার্ক' শব্দটির যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ কী হতে পারে? এর আক্ষরিক এবং সহজ বাংলা হতে পারে 'জালের মতো বিস্তৃত'। তবে এর আরও রোমান্টিক ভাবানুবাদ হতে পারে 'মায়াজাল'। আসলে নেটওয়ার্ক শব্দটি এখন এত পরিচিত যে, এর অর্থ বোঝার জন্য প্রতিশব্দ খোঁজার দরকার হয় না। বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নেটওয়ার্ক– সবচেয়ে বেশি ব্যয়ও হচ্ছে নেটওয়ার্কের জন্যই। একাধিক ব্যক্তির মধ্যে– একাধিক প্রতিষ্ঠানের কী একাধিক দেশের মধ্যে– কিংবা আন্তমহদেশীয় সম্পর্কের বিষয়ে– প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তি, ক্ষমতা, প্রবৃদ্ধি, প্রগতি যা-ই বলি না কেন, তার দৃঢ়তা নির্ভর করে নেটওয়ার্কের সক্ষমতার উপর।

আজকের আলোচনায় নেটওয়ার্ক সংকুচিত করে 'টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক'এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। অবশ্যই এই আলেচনার ক্ষেত্র বাংলাদেশ এবং দেশের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের কারিগরি সক্ষমতা, দুর্বলতার বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাবে।

পুরো টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে একাধিক পৃথক কিন্তু সমন্বিত নেটওয়ার্কের উপর। এই যে চোখের সামনে মোবাইল নেটওয়ার্ক দেখছেন তার মূল ভিত্তি কিন্তু ভূমির উপরে, ভেতরে কিংবা সমুদ্রের তলদেশে বিস্তৃত ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক। আবার ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্কের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে এর ভেতরের অপটিক্যাল ট্রান্সমিশন সিস্টেমের দৃঢ়তার উপর। ফাইবার অপটিক কেবলের অভ্যন্তেরে তরঙ্গপ্রবাহের সঞ্চালন আলোক সংকেতের মাধ্যমে অতিমাত্রায় গতিশীল করার যে প্রযুক্তিগত বিন্যাস সেটি হচ্ছে ফাইবার অপটিক কেবলর ভেতরে অপটিক্যাল ট্রান্সমিশন সিস্টেম যেটিকে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কও বলা হয়।

এই ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যেমেই বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পরিবহণ করা হচ্ছে মহাদেশ থেকে মহাদেশে, দেশ থেকে দেশে, শহর থেকে বন্দরে, বন্দর থেকে গ্রামে। আবার এই ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের উপর ভর করেই বাতাসে বেতার-তরঙ্গের ব্যবহারে পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। অতএব এটাও স্পষ্ট যে, ভূমির ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক দৃঢ় ও নিরবচ্ছিন্ন না হলে বাতাসের মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকেও কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তির প্রজন্মের রূপান্তরে টু-জি থেকে ফোর-জি পর্যন্ত পথচলায় বড় যে বিবর্তন হয়েছে সেটিও ভূমিতে বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের শরীর বেয়ে বয়ে চলা ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ঘিরে।

এখানে খুব সহজ করে বলতে গেলে, অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওর্য়াক যত শক্তিশালী হবে, যত বেশি স্মার্ট ও বুদ্ধিমান হবে, টেলিযোগাযোগ নেওটয়ার্কও তত সচ্ছন্দ হবে। এই অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির দীর্ঘ বিবর্তন ঘটেছে। সেই বিস্তৃত ইতিহাসে না গিয় এটুকু বলা যায়, দুনিয়া যখন টু-জি থেকে থ্রি-জিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে তখনই ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কে 'আইপি' প্রযুক্তির বদলে এসেছে 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তি। 'ডিডব্লিউডিএম'এর পুরোটা হচ্ছে 'ডেন্স ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং'।

এখানে 'মাল্টিপ্লেক্সিং' শব্দটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টু-জি থেকে ফোর-জি কিংবা ফাইভ-জির যে অগ্রসারমান যাত্রাপথ, সেখানে প্রযুক্তি একটা পথের পরিবর্তে বহুপথ আর আর বহুমাত্রিকতার ব্যবহারই প্রজন্মের ব্যবধানের বিষয়টি স্পষ্ট করছে।

প্রথম প্রজন্ম থেকে দ্বিতীয় প্রজন্ম বা টু-জির প্রবর্তনই হয়েছে অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল কোড ডিভিশনের ভিত্তিতে। আর টু-জি থেকে থ্রি-জির বিবর্তন হয়েছে কোড ডিভিশন প্রযুক্তির 'মাল্টিপ্রেক্সিং' বা বহুমাত্রিকতা কেন্দ্র করে। বহুমাত্রিক পথ সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রযুক্তির এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নেটওয়ার্ক নিরবচ্ছিন্ন করার কাজটি সফলভাবে সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতিতিতে নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্কই আজকের দুনিয়ায় 'স্মার্ট ইনটেলিজেন্ট' নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত।

যেমন 'ডিডব্লিউডিএম' নেটওয়ার্কে নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ পরিবহণের জন্য চল্লিশটি চ্যানেলের ট্রান্সপোর্ট প্ল্যাটফরম রয়েছে, যেটা আশি চ্যানেল পর্যন্ত বৃদ্ধির বিকল্প প্রযুক্তিও সর্বশেষ সংযোজন করা হয়েছে। অর্থাৎ, আগে আইপি প্রযুক্তির নেটওয়ার্কে যেখানে দুটিমাত্র বিকল্প পথ ছিল সেখানে 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তি ৪০টি বিকল্প পথ খুলে দিচ্ছে। এর অর্থ, যদি ৩৯টি ক্ষেত্রেও নেটওয়ার্কে সংকট বা ত্রুটি দেখা দেয়, তারপরও ৪০তম বিকল্প পথ ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সম্ভব হবে স্মার্ট ইনটেলিজেন্ট 'ডিডব্লিউডিএম' নেটওয়ার্ক।

তাছাড়া আগে আইপি প্রযুক্তিতে যেখানে আপনার ব্যান্ডউইথ পরিবহন ক্ষমতা ১০, ২০ এমবিপিএস (মেগাবিট পার সেকেন্ড) এর মধ্যে নির্ধারণ করতে হিমশিম খেতে হত সেখানে 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তি এখনই ১০০ জিবিপিএস (গিগাবিট পার সেকেন্ড) কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে এত অর্থে আনলিমিটেড সক্ষমতার ব্যান্ডউইথ পরিবহনের সুযোগ দিচ্ছে। এরই মধ্যে ৪০০ জিবিপিএস সক্ষমতার ডিডব্লিউডিএম কার্ডও পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি হয়েছে। এর অর্থ, 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তি ব্যান্ডউইথ সক্ষমতার সংকট নিয়ে দুশ্চিন্তা পুরোপুরি দূর করে দিয়েছে।

এখানেই আমাদের দুভার্গ্য। আমরা যেমন থ্রি-জি চালু করতে পিছিয়ে ছিলাম, ফোর-জি প্রযুক্তি চালু করতে পিছিয়ে রয়েছি, তেমনি 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তির সর্বাধুনিক ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতেও এখন পর্যন্ত সফল হতে পারিনি। ফলে ভবিষ্যতে দেশে ফোর-জি চালু হলেও মানসম্পন্ন গ্রাহক-সেবা নিশ্চিত করা অপারেটরদের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে সে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক্ষেত্রেও আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১১ সালেই সরকারের নীতিনির্ধারকরা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিটিসিএলকে দিয়ে 'টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট' বা টিএনডিপি প্রকল্প নিয়েছিলেন। এর একটা অংশ 'লট-এ'এর মাধ্যমে ঢাকায় অত্যাধুনিক 'ট্রিপল-প্লে' নেটওয়ার্ক তৈরির উদ্যেগ নেওয়া হয়, যেখানে একটিমাত্র সংযোগ থেকেই গ্রাহকরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, কেবল টিভি এবং ল্যান্ড টেলিফোনের সুবিধা পাবেন।

তাছাড়া 'লট-বি'র মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ৪০টি বিকল্প পথে বিটিসিএলএর নেটওয়ার্ক স্মার্ট ইনটেলিজেন্ট 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তিতে হালনাগাদ করার উদ্যেগ নেওয়া হয়। এর ফলে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত শক্তিশালী ও নিরবচ্ছিন্ন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের মালিক হত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিটিসিএল। অর্থাৎ দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানির নিয়ন্ত্রণেই দেশে পরিকিল্পিত, নিরবচ্ছিন্ন ও দৃঢ় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠত যেটা হত দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের মূল মেরুদণ্ড।

এই নেটওয়ার্ক আগামী দিনে স্বল্প খরচে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা যেত সহজেই। শুধু তাই নয়, কুয়াকাটায় দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে ব্যান্ডউইথ পরিবহনে নতুন ট্রান্সমিশন লিংক তৈরির প্রয়োজন হত না, যদি টিএনডিপির 'লট-বি' বাস্তবায়ন করা হত। জাপানি অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প ছিল টিএনডিপি যার 'লট-এ'এর জন্য প্রায় চারশ কোটি টাকা এবং 'লট-বি'এর জন্য প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়।

'লট-এ'এর মাধ্যমে কোনোরকমে একটা ট্রিপল-প্লে নেটওয়ার্ক বিটিসিএল শেষ পর্যন্ত তৈরি করেছিল। কিন্তু এর বাণিজ্যিক ব্যবহার এখন পর্যন্ত শুরু করতে পারেনি। কয়েকটি অভিজাত এলাকায় হাতেগোনা কিছু ট্রিপল-প্লে সংযোগ আছে যেগুলোর সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আর 'লট-বি' বাস্তবায়নই করতে দেওয়া হয়নি। টেন্ডার নিয়ে বিটিসিএলএর কতিপয় কর্মকর্তা এতটাই অনিয়ম করেন যে, শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পের অর্থদাতা জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাইকা সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগে এই প্রকল্প থেকে অর্থসহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়। গোষ্ঠীগত হীনস্বার্থে টিএনডিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সময়োপযোগী উদ্যোগটি ছলেবলেকৌশলে নস্যাৎ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের ঘাঁপটি মেরে থাকা ধান্দাবাজরা।

টিএনডিপি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে, তাই বলে কি দেশে শক্তিশালী ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি হবে না? বিশেষ করে ইন্টারনেটের ব্যবহার বিস্তৃত করতে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত শক্তিশালী অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরির বিকল্প নেই। এবার এগিয়ে এল বাংলাদেশ কস্পিউটার কাউন্সিল, বিসিসি। তারা ইনফো সরকার-১ নামে একটি প্রকল্প নিয়ে বিভাগীয় শহরে সরকারি অফিসগুলোতে ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা দেখিয়ে তারা হাতে নিল ইনফো সরকার-২। এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে সরকারি অফিসগুলোতে ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি দেওয়া হবে। এখানে ব্যবহার করা হল বিটিসিএলএর পূর্বের নেটওয়ার্ক, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে দুটি প্রাইভেট এনটিটিএন অপারেটর নিজেরা নেটওয়ার্ক তৈরি করল।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে সময় দেশেই 'ডিডব্লিউডিএম' প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে সে সময় বিসিসির মতো প্রযুক্তি গবেষণায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করল পুরনো আইপি প্রযুক্তি। বিটিসিএলের নেটওয়ার্কের উপর ভর করে পুরনো প্রযুক্তির এই প্রকল্পে ব্যয় করা হল ১,৩৩৩ কোটি টাকা। যেখানে টিএনডিপির 'লট-বি' অংশে মাত্র আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয় করে উপজেলা পর্যায়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন ব্রডব্যান্ড কানেকিটিভিটি হালনাগাদ করার কথা ছিল, সেখানে ইনফো সরকার-২ তে শুধুমাত্র সরকারি অফিসের জন্য পুরনো প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক তৈরিতে ব্যয় করা হল ১,৩৩৩ কোটি টাকা!

বিটিসিএলএর 'লট-বি' বাস্তবায়ন কেন ঠেকানো হয়েছে তা বুঝতে কি আরও বাকি থাকে? যদিও চলতি বছরে অভ্যন্তরীন নেটওয়ার্ক সমন্বয় কমিটির সভায় জানানো হল, ইনফো সরকার-২ প্রকল্পে যে ১৮ হাজার কানেকটিভিটি দেওয়ার কথা ছিল তার মধ্যে মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার চালু রয়েছে। এত উচ্চমূল্যের প্রকল্পের সফলতার চিত্র কি এটাই?

খেলা এখানেই শেষ নয়। 'লট-বি' প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ বিটিসিএলকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তো নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন করতে হবে। এ কারণে বিটিসিএল প্রায় দেড় বছর পর 'লট-বি' প্রকল্পের কারিগরি নকশা আর কাজের ক্ষেত্র কিছুটা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে 'এমওটিএন' নামে একটি নতুন প্রকল্প নিল। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হল প্রায় ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১,৯০০ কোটি টাকা। যদিও অতিরিক্ত ব্যয় ধরার কারণে এমওটিএন প্রকল্প এখনও একনেকের অনুমোদন পায়নি বলে জানা গেছে।

তবে এই সময়ে আবারও বড় চমকটি দেখাল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। এবার তারা উপজেলা থেকে ২ হাজার ৬০০ ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড কাকেটিভিটির জন্য ইনফো সরকার-৩ প্রকল্প হাতে নিল যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। এবার শুধু সরকারি অফিসে সংযোগ নয়, বেসরকারি দুটি এনটিটিএন অপারেটর ২০ বছরের জন্য এই নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবসা করবে। ব্যবসার একটা অংশ শেয়ার করবে বিসিসির সঙ্গেও। ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন প্রণয়ন এবং পরবর্তী সময়ের এনটিটিএন লাইসেন্স গাইডলাইনের পর শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী এনটিএিন কোম্পানি ছাড়া আর কারও দেশে এনটিটিএন সেবার ব্যবসার সুযোগ নেই। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে লাইসেন্স ছাড়াই বিসিসি দিব্যি এনটিটিএন ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে ইনফো সরকার-৩ এর মাধ্যমে।

তাহলে বিটিসিএল রাখার দরকার কি? দুটি বেসরকারি এনটিটিএন কোম্পানি রাখারই-বা কী প্রয়োজন? হয়তো এমনও হতে পারে যে, বিসিসি এনটিটিএন লাইসেন্সের জন্য বিটিআরসিতে আবেদনও করতে পারে। কারণ এর আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং পিজিসিবিকেও বিটিআরসি লাইসেন্স দিয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বহু আগে থেকেই ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক আছে বলেই কি তাদের টেলিযোগাযোগ খাতের ট্রান্সমিশন ব্যবসার লাইসেন্স দিতে হবে?

এমন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হলে দেশে যে কোনো প্রতিষ্ঠান এনটিটিএন ব্যবসায়ী হয়ে যেতে পারে। অতএব বিসিসি এনটিটিএন পরবর্তী সময়ে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন নিয়ে এনটিটিএন লাইসেন্স পেয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকেবে না!

দেশে কম্পিউটারের ব্যবহার এবং এ-সংক্রান্ত জ্ঞানবৃদ্ধি-সম্পর্কিত কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিসিসি কেন, কার স্বার্থে রূপ বদলে পুরোদস্তুর এনটিটিএন ব্যবসায়ী হয়ে উঠছে সেটাই প্রশ্ন। ইনফো সরকার-২ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রযুক্তি নির্ধারণে অদূরদর্শিতার পরিচয় এবং দৃশ্যত এ প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর আবারও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইনফো সরকার-৩ বাস্তবায়নের যৌক্তিকতাও কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?

এখানেই নেটওয়ার্ক জটিলতা। টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, সম্প্রসারণ আর আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে সমন্বিত এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক, একটি ধান্দাবাজ চক্র সেটা চায় না। তারা চায় টুকরো টুকরো করে অধিক ব্যয়ে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হবে এবং প্রতিবারই তাদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত স্বার্থের ফায়দা তোলাই থাকে মূল লক্ষ্য।

এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ; সেটা হচ্ছে, বিটিসিএলএর টিএনডিপি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল জাপানি অর্থায়নে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ইনফো সরকার-২, ৩ এবং বিটিসিএলএর এমওটিএন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনা সরকারের ঋণ-সহায়তায়। আমরা সবাই জানি, এখন পর্যন্ত জাপান সরকার জাইকার মাধ্যমে যে ঋণ দিয়েছে তার কোনোটি ফেরত দিতে হয়নি বাংলাদেশকে। কিন্তু চীনের ঋণ সুদে-আসলে কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত দিতে হয়। আর এ কারণে চীনা ঋণের প্রকল্প-ব্যয় অন্য যে কোনো দেশের অর্থায়ন প্রকল্পের চেয়ে তিন-চার এমনকি দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। প্রকল্প-ব্যয় যেহেতু জ্যামিতিক হারে বাড়ে সে কারণে এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারও চীনা প্রকল্পের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। সহজে মোটা অংকের টু-পাইস কামানোর জন্য চীনা প্রকল্পের চেয়ে আদর্শ কিছু নেই, এমন একটা প্রবাদও আমলাতন্ত্রের মধ্যে চালু রয়েছে!

চীনা প্রকল্পের আরও একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, চীনা কোম্পানির বাইরে অন্য কোনো দেশের কোম্পানির যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। ফলে যন্ত্রপাতির গুণগত মান যাচাই এবং দাম নিয়েও দরকষাকষি করা যায় না। দেখুন বিটিসিএল 'লট-বি' প্রকল্পে ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানি সিয়েনাকে নির্বাচন করেছিল। আর এখন বিশ্বের সেরা দশ কোম্পানির তালিকায় আরও নিচের দিকে থাকা চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে কিংবা জেডটিই'এর যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে সিয়েনার দামের চেযে দ্বিগুণেরও বেশি দামে!

শুধু তাই নয়, নেটওয়ার্ক জটিলতার খেলায় ঢাকা-কুয়াকাটা দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ব্যাকহল ট্রান্সমিশন লিংক তৈরিতে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ডিডব্লিউডিএম প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে একবারেই অপরিচিত 'তেজাশ' নামে এক কোম্পানিকে নিয়ে আসা হয়েছে। এই কোম্পানির সক্ষমতা বিবেচনা করে পুরো ট্রান্সমিশন লিংকের প্রথম নকশা বদলে এর সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে এখন একাধিক বিকল্প পথ নেই বললেই চলে। ফলে দেশের অন্যতম প্রধান ব্যান্ডউইথ ব্যাকবোন তৈরি নিয়ে এক ধরনের ছেলেখেলাই করলেন সংশ্লিষ্টরা। বোঝা যাচ্ছে, এই কাজের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলরা নিজেদের হীন স্বার্থে ভবিষ্যতে দেশের ডিজিটাল নেটওয়ার্কের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় রেখে যাচ্ছেন।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ, বিটিসিএলের টিএনডিপি থেকে এখন পর্যন্ত দেশের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ যা কিছু হয়েছে তার নিবিড় তদন্ত করে অনিয়মের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া হোক। টেলিযোগাযোগ খাত ঘিরে থাকা ধান্দাবাজ চক্রের 'মায়াজাল' ছিন্নভিন্ন করা না গেলে ডিজিটাল বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়ন অসম্ভব। ফলে দেশের দৃঢ় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির বদলে টুকরো টুকরো দুর্বল জটিল এক নেটওয়ার্ক তৈরি হবে, যে জটিলতা কাটাতে চাইলে ভবিষ্যতে আবার বিপুল ব্যয় করতে রাষ্ট্রকে।