যাত্রাপালা: ‘চন্দ্রগুপ্ত – ২’

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 Sept 2017, 05:31 PM
Updated : 8 Sept 2017, 05:31 PM

২য় অঙ্ক, ১ম দৃশ্য

[পাটলিপুত্র নগরের গোপন রাজকীয় মন্ত্রণাকক্ষ। চাণক্য উচ্চাসনে তাকিয়ায় হেলান দিয়া উপবিষ্ট। কক্ষের আবছা অন্ধকারে নিম্নাসনে উপবিষ্ট তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-নেতৃবৃন্দ। সাক্ষাতের গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনে সলিতা নামাইয়া কুলুঙ্গিতে রক্ষিত রত্নপ্রদীপের উজ্জ্বলতা কমানো হইয়াছে। কক্ষের আলো-আঁধারিতে জনাত্রিশেক অধ্যাপকের উপস্থিতি অনুমান করা যাইতেছে বটে, কিন্তু মুখমণ্ডল পরিষ্কার দেখা যাইতেছে না।]

মার্গশুদ্ধ কৌমল: ঐরাবিণের অষ্টবর্ষ শাসনামলে বহু অনিয়ম হইয়াছে। অগণিত অযোগ্য প্রার্থী তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিয়োগ পাইয়াছে।

চৈতকা হৈলম: প্রথমবার নির্বাচন ব্যতিরেকে, দ্বিতীয়বার নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং তৃতীয়বার নিয়মের কমবেশি ব্যত্যয় ঘটাইয়া ঐরাবিণ পর পর তিনবার উপাধ্যক্ষ হইতে যাইতেছেন। একজন অযোগ্য ব্যক্তি আর কত সুবিধা পাইবেন? আমার পিতৃদেব একদা অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। মহান চন্দ্রগুপ্ত যদি মহাত্মা শাক্য মজ্জবের উত্তরাধিকারসূত্রে আর্যাবর্তের মহামাত্য হইতে পারেন, তবে আমারও কি অনুরূপ সুযোগ পাওয়া উচিত নহে?

কবিরাজ শৈহর্মদ: চতুর ঐরাবিণ বিধানসভায় নিবন্ধিত স্নাতক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে উপাধ্যক্ষ হিসাবে নিজের নাম প্রস্তাব করাইয়া লইয়াছেন। ইহাকে নিয়মের ব্যত্যয় ছাড়া আর কী-ই-বা বলা যাইতে পারে?

লালিমা অকৈত্র: সম্প্রতি কিছু শিক্ষক নামধারী গুণ্ডা তাকসু (তক্ষশীলা ছাত্রসংসদ) নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করিয়া তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ভুলুণ্ঠিত করিয়াছে। অতীতে আমার ছাত্রাবস্থায় একই অপরাধে এক উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করিতে হইয়াছিল। এক যাত্রায় কেন পৃথক ফল হইবে?

জবহরক মৈজমদ্র: ঐরাবিণ অষ্টবর্ষ উপাধ্যক্ষ থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যাচর্চা হইয়াছে, বহু বিভাগ সৃষ্টি হইয়াছে, একাধিক ভবন নির্মিত হইয়াছে– এই সকল তথ্য যেমন সত্য, তেমনি শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান উন্নতি যে হয় নাই, তাহাও বিবেচনা করা উচিত নহে কি? তাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান করিতে না পারাও ঐরাবিণের অসাফল্যের টুপিতে অন্যতম একটি পালক।

চাণক্য: হুম। অজ্ঞাত কারণে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ও চন্দ্রগুপ্তের প্রতি চিরঅসূয়াসম্পন্ন, 'বলদে যাও, বলদে দাও!' আহ্বানের উদ্গাতা, দৈনিক প্রিয়তম হুলো পত্রিকায় একাধিক নিবন্ধ পড়িয়া এবং বিশেষত ঐরাবিণের সুযোগ্য ছাত্রী (ক্ষণে ক্ষণে অ্যা-অ্যা করা) অপেশাদার পত্রকার চাঁদনী সাহার 'অশ্রাব্য' (সর্বার্থে) সাক্ষাৎকার শুনিয়া, আর্যাবর্তের অন্য অনেক নাগরিকের মতো আপনাদিগের 'বহুচর্বিত' বক্তব্য আমারও প্রায় মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। আপনাদের বক্তব্য দুই অর্থে 'বহুচর্বিত'; প্রথমত, এই একই বক্তব্য বহুজন বহুবার চিবাইয়া চিবাইয়া বলিয়াছে ও লিখিয়াছে এবং দ্বিতীয়ত, ইহার মধ্যে পুষ্টিকর মাংস যতটা নাই, স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর চর্বি তাহা অপেক্ষা অধিক আছে।

মহোদয়গণ, আমার প্রগলভতা মার্জনা করিবেন। মহান চন্দ্রগুপ্ত অবশ্যই তাকসু নির্বাচন চাহেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার কথা তাঁহাকে সর্বাগ্রে ভাবিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার বিষয়ে ফোনালাপের কথা আপনারা কি ইতিমধ্যেই বিস্মৃত হইয়াছেন? গবেষণা যদি শিক্ষকেরা আদৌ করিতে চাহিতেন, তবে ঐরাবিণ নিশ্চয়ই তাহাতে বাধা দিতেন না। গবেষণা বা উচ্চশিক্ষায় শ্রী মৈজমদ্র কিংবা তক্ষশীলার বেশিরভাগ ক্ষমতালিপ্সু শিক্ষকের যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই, তাহাও কি ঐরাবিণের দোষ? ঐরাবিণ যদি নিয়োগে অনিয়ম করিয়াই থাকেন, তবে সেই অনিয়মের কথা আপনারা অষ্টবর্ষ ধরিয়া গোপন রাখিলেন কেন? যেহেতু আপনাদিগের মধ্যেও অনেকে সেই সব নিয়োগসভায় সশরীরে উপস্থিত ছিলেন সেহেতু অপনিয়োগের কিছুটা দায় আপনাদিগের উপরও বর্তায় না কি? নিজেরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুবিধা ষোল আনার উপর আঠারো আনা চাটিয়া-পুটিয়া খাইতেছিলেন, তখন কি আপনারা ঐরাবিণের সকল কাজে সম্মতিসূচক মৌনতা অবলম্বন করেন নাই? এখন ঐরাবিণের ক্রান্তিকালে স্রেফ ক্ষমতাদখলের উদ্দেশ্যেই আপনাদিগের এত নর্তন-কুর্দন– এমত অভিযোগ যদি কেহ করে, তবে কি তাহা নির্জলা মিথ্যা হইবে?

শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় আপনারা কি চন্দ্রগুপ্তের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করেন নাই? কেন করিয়াছিলেন? কারণ আপনারা জানিতেন, আর্যাবর্তে চন্দ্রগুপ্তের ইচ্ছাই আইন। নৈক্ষলপাড়ার বৈঠকখানাতেই যে চন্দ্রগুপ্তের সমর্থনের তুলাদণ্ড ঐরাবিণের দিকে ঝুঁকিয়াছিল, তাহা কি আপনারা লক্ষ্য করেন নাই? বিধানসভায় নিবন্ধিত স্নাতক প্রতিনিধি না রাখার অভিযোগ আপনারা করিতেছেন। কিন্তু ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও চন্দ্রগুপ্তের নির্দেশ আপনারা উপেক্ষা করিতে পারিতেন কি? আঞ্চলিক বঙ্গভাষায় একটি প্রবাদ আছে: 'যেমনে নাচাও তেমনে নাচে, পুতুলের কী দোষ?' চন্দ্রগুপ্ত যতদিন ইচ্ছা করিবেন, ততদিন ঐরাবিণ উপাধ্যক্ষ থাকিবেন, ততদিন তাকসু নির্বাচন হইবে না– কাহারও চাওয়া বা না-চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। ক্ষুদ্রতম বাঙ্গালা গল্প দিয়া আমার বক্তব্য শেষ করি: 'গদাই ও বলাই দুই ভাই। গদাই ভালো ছেলে, আর বলাই বাহুল্য!' এমন হওয়া অসম্ভব নহে যে, মহান চন্দ্রগুপ্তের বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐরাবিণই উপযুক্ততম উপাধ্যক্ষ, আর বাকিরা– বলাই বাহুল্য!

২য় অঙ্ক, ২য় দৃশ্য

[পাটলিপুত্র নগরের গোপন রাজকীয় মন্ত্রণাকক্ষ। আলোক-ব্যবস্থাপনা পূর্ববৎ। চাণক্য উচ্চাসনে তাকিয়ায় হেলান দিয়া উপবিষ্ট। নিম্নাসনে উপবিষ্ট তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ শ্রী অয়মস ঐরাবিণ সৈদক।]

ঐরাবিণ: 'আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি, আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত গ্লানি!' কিন্তু নতুন কোন পদ, নবতর কোন সুবিধা দিয়া আমি তাহাদিগকে সন্তুষ্ট করিব? তাহাদিগের মধ্যে একাধিক জনকে আমি পাঁচটির অধিক পদ দিয়াছি। মার্গশুদ্ধ কৌমলকে আমি কী দিই নাই, বলুন? বাকি আছে হাতের পাঁচ উপাধ্যক্ষের পদটি। যদি সে যাঞ্ছা করে, তবে সেটিও দিয়া দিতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু এই পদ তাহাকে প্রদান করা কি আমার সাধ্যায়ত্ত, আপনিই বলুন, প্রভু?

চাণক্য: বৎস, রাজনীতি বা ক্ষমতার অদলবদল একটি ক্রীড়া বৈ তো নয়। মার্গশুদ্ধকে তুমি নিজের স্বার্থেই, অর্থাৎ ক্রীড়ার কৌশলগত কারণেই, পঞ্চপদে অধিষ্ঠিত করিয়াছিলে। একটিমাত্র ঝুড়িতে সকল ডিম্ব রাখিতে নাই, কিন্তু রাখিলে ডিম্ব বহনে যে সুবিধা হয় তাহাও তো সত্য। স্মরণে রাখিও, ক্ষমতা ও ধন গোময়ের মতো। গোময় একস্থানে স্তুপীকৃত হইলে দুর্গন্ধে ভুত পলাইবার উপক্রম হয়, অথচ ক্ষেত্রের সর্বত্র ছড়াইয়া দিলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

যে কোনো প্রভুর জানা উচিত, দাস তিন প্রকারের হয়: সুদাস, কুদাস ও উদাস। সুদাস প্রভুর কথামতো চলিবে, ভালোমন্দ বিচার করিবে না। কুদাস সব সময় প্রভুর পশ্চাদ্দেশে বংশপ্রদানের সুযোগ খুঁজিবে। কেহ কেহ আচরণে সুদাস, কিন্তু অন্তরে কুদাস। কাহাকেও আচরণে কুদাস বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সুদাস। অন্যদিকে উদাসেরা নিরপেক্ষভাবে নিজের কর্তব্য করিয়া যায়, প্রভু বা অন্য কাহারও ক্ষতির চিন্তা করে না। যোগ্য কোনো উদাসকে উপেক্ষা করিয়া তুমি অতীতে এমন কোনো আপাত-সুদাসকে সুবিধা প্রদান কর নাই তো, যে প্রকৃতপক্ষে কুদাস ছিল, অথবা যাহার যোগ্যতারই অভাব ছিল? এই ধরনের কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তই তোমাকে ডুবাইবার জন্যে যথেষ্ট।

শাসককে শম-দান-ভেদ-দণ্ড– এই চতুরঙ্গ আর্ষরাজনীতি মুন্সিয়ানার সহিত প্রয়োগ করিতে জানিতে হয়। লোকে সুখকর রৌদ্র দেখিবে, যন্ত্রণাকর সূর্য দেখাইবার প্রয়োজন কী? এমন কোনো উপায় কেন অবলম্বন করিলে না, যাহাতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীরই সৃষ্টি না হয়? নিরাময় অপেক্ষা নীরোগ থাকাটাই উত্তম নহে কি? স্মরণ রাখিও, নেতার যাবতীয় অসাফল্যের জন্য নেতা একা দায়ী থাকেন, অন্য সব কারণ বাহুল্যমাত্র। মহান শাক্য মজ্জব, মহামাত্য চন্দ্রগুপ্ত বা তুমি, সবার ক্ষেত্রে এই আপ্তবাক্য সমান প্রযোজ্য।

গুপ্তচরের মুখে শুনিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার কর্মকক্ষে এবং বাড়ির বৈঠকখানায় পারিষদেরা নাকি গভীর রাত্রি পর্যন্ত তোমাকে ঘিরিয়া থাকে। ফুলে মধু থাকিলে মৌমাছি আসিবেই, কিন্তু পারিষদ-ব্যবস্থাপনা না জানিলে সফল রাজা হওয়া যায় না। রাজাকে কান দিয়া দেখিতে হয়। যে রাজা কান দিয়া শুধু শোনে, কিংবা শুধু চোখ দিয়া দেখে, তাহার বিপদ অনিবার্য। তুমি নিশ্চয়ই তক্ষশীলা নগরদুর্গের প্রস্তরনির্মিত প্রাকার দেখিয়াছ। প্রাকারের প্রস্তরসমূহ রাজাকে রক্ষা করে বটে, কিন্তু এই একেকটি প্রস্তর আবার রাজার অনেক ক্ষতিও করে। কারণ প্রজার ফরিয়াদ এই প্রস্তরে প্রতিধ্বনিত হইয়া ফিরিয়া যায়, রাজার কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছে না। পারিষদেরা প্রাকারের এক একটি প্রস্তরের মতো। রাজাকে তাহারা রক্ষা করে সত্য, কিন্তু তাহাদিগের কারণেই রাজা জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। স্বার্থবুদ্ধিতে অন্ধ হইয়া স্তাবক-পারিষদেরা রাজার কাছে সত্য গোপন করে, আপন মনের মাধুরী মিশাইয়া বিভিন্ন ঘটনা উপস্থাপন করে। অতিপ্রশংসা করিয়া রাজার প্রিয়পাত্র হইতে গিয়া তাহারা অনেক ক্ষেত্রে রাজাকে জনগণের কাছে হাস্যকর করিয়া তোলে। সম্প্রতি দেখ নাই, মহান গৌরমিত্রের তিরোধান দিবসে অতিউৎসাহী কিছু বায়স (ঐবদুল্ল কদ্রের ভাষায় 'কাউয়া') কীভাবে বিলাপ করিতে করিতে ভোঁতা ছুরিকা দিয়া নিজ নিজ পৃষ্ঠদেশে আঘাত করিতেছিল?

যাহা হউক, তুমিও জান, আমিও জানি এবং অদ্যাবধি যে না জানে এই দণ্ড সেও জানুক: তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষের আরামদায়ক কেদারাটি কাহার নিতম্বগত হইবে, কিংবা হইবে না, তাহা নির্ধারণ করেন স্বয়ং মহান চন্দ্রগুপ্ত। পশুমেধ উৎসব উপলক্ষে তুমি ফোকটে কয়েক মাস সময় পাইয়া গেলে। এই অবসরে ভাবিয়া দেখ, যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করিবে কিনা, কিংবা কোথাও কোনো বিচ্যুতি থাকিলে সংশোধন করিবে কিনা। আপাতত তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অর্বাচীন ল্যাটিনে এই বাক্যটি শুনাইয়া দাও: Ille vult, ergo sum! অর্থাৎ 'তিনি চাহেন বলিয়াই আমি আছি!' এই বাক্যটি স্মরণে থাকিলে অবশ্য তাহারা অনর্থক মামলার ঝামেলায় জড়াইত না।

যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত। ২য় অঙ্ক, ৩য় দৃশ্য।

[পাটলিপুত্র নগরের গোপন রাজকীয় মন্ত্রণাকক্ষ। চাণক্য উচ্চাসনে উপবিষ্ট। নিম্নাসনে যুক্তকরে উপবিষ্ট চন্দ্রগুপ্ত।]

চন্দ্রগুপ্ত: প্রভু, আপনি ঠিকই বলিয়াছেন, নির্বাচন দ্বারে করাঘাত করিতেছে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে ঐরাবিণের পরিবর্তে অন্য কোনো অপরীক্ষিত ব্যক্তিকে তক্ষশীলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বরণ করিলে সমস্যা হইতে পারে। কোনো যন্ত্র যদি ঠিকঠাকমতো কাজ করে, তবে সেই যন্ত্র পরিবর্তন করিয়া কাজ নাই। আমি আপনার পরামর্শমতো শম ও দানের মাধ্যমে তক্ষশীলার সঙ্কট সমাধান করিয়া আসিতেছি। তক্ষশীলার বিদ্রোহী অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে শমের আশ্রয় লইয়াছিলাম। কাজ হইয়াছে। ইতিমধ্যে ঐরাবিণের প্রতিদ্বন্দ্বী হরণ্য রৌশদ, তদীয় অন্ধভক্ত মৈশর, অর্হদুজ্জমন চান্দ্র, মজ্জন্যর রৌহমন, ফৌর্দদ্দিন অর্হমদ প্রমূখ অধ্যাপককে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়াছি। বাকিদেরও ব্যবস্থা হইতেছে। আশা করি অচিরেই এই সব দানের ফল ফলিবে এবং সমস্ত ঝামেলা মিটিয়া গিয়া মধুরেণ সমাপয়েৎ হইবে। বাকি থাকে জবাহরক, ফৈহমদ্য বা শৈশরকের মতো কয়েকজন উদাস, তক্ষশীলার প্রতি যাহাদের ভালোবাসা প্রশ্নাতীত। তবে পদ বা অর্থ দিয়া ইহাদেরও নষ্ট করিয়া কাজ নাই, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্মুখ বিবেক হিসাবে আরও কিছু কাল ইহারা ভূমিকা রাখিলে আখেরে জাতি উপকৃত হইবে। তবে একটি কথা ভাবিয়া মন মাঝেমধ্যে উতলা হয়, প্রভু। শম, দান, ভেদ, দণ্ড– আপনার এই চতুরঙ্গ কৌশলক্রম আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে ঠিক 'গণতান্ত্রিক' প্রতীয়মান হয় না।

চাণক্য: বৎস, খাঁটি স্বর্ণে কি কদাপি অলংকার নির্মিত হয়? গণতন্ত্রের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রিসে গরুছাগলের মতো মনুষ্য কেনাবেচা হইত। মহিলা, দাস ও দাসীর গর্ভজাত পুত্রদের ভোটাধিকার ছিল না। গণতন্ত্র নামে যে শাসনব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রচলিত, তাহা তো প্রকৃতপক্ষে গোষ্ঠীতন্ত্র। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ হইতে বিশেষ একজন ব্যক্তি একটানা বা কিছু সময়ের জন্যে সর্বময় ক্ষমতা পাইয়া থাকে। পৃথিবীতে ক্ষমতায় থাকার অর্থ হইতেছে ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠে আরোহণ করা। অবতরণ করিবামাত্র ব্যাঘ্র তোমাকে গলাধঃকরণ করিবে। সুতরাং ঋষিগণ প্রবর্তিত চতুরঙ্গ কৌশল ব্যবহার করিয়া যত দীর্ঘকাল সম্ভব ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠোপরি অবস্থান করা ভিন্ন তোমার কিংবা ঐরাবিণের গত্যন্তর নাই। ক্ষমতায় থাকিলে খৈলদা জঈয় বা তদীয় পুত্র তৈরক জঈয় কিংবা মার্গশুদ্ধ কৌমলও ভিন্ন আচরণ করিত না। বস্তুত, ক্ষমতা কুক্ষিগত করাতে তোমাদের কাহারও বিন্দুমাত্র দোষ নাই। হিন্দুদেবী দুর্গা সেই যে কবে সিংহের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়াছিলেন, অদ্যাপি অবতরণ করিয়াছেন কি? অজর-অমর দেবতারাই যদি হিংস্র পশুর পৃষ্ঠ হইতে অবতরণে অসমর্থ হন, তোমরা মরণশীল মনুষ্য হইয়া কী প্রকারে সেই অসাধ্য সাধন করিবে?