ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া: বাঁধনছেঁড়া এক শিল্পী

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 31 August 2017, 07:05 AM
Updated : 31 August 2017, 07:05 AM

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন সে কী উৎসাহ চারদিকে! আমরা মাত্র কিশোরবেলা ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠছি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সারারত নির্ঘুম থেকে সকালে শহীদ মিনারে যাবার প্রস্তুতি ছিল দেখার মতো। সে সময় হঠাৎ একটি গান ভাসিয়ে দিয়েছিল জাতিকে। এর আগে "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো" ছিল শহীদ দিবসের একমাত্র গান। এবার প্রভাতফেরিতে যুক্ত হল "সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণ" । এরপর থেকে এই গান সকাল থেকে রাত অব্দি সকল বাংলাদেশির জন্য এক অনিবার্য সঙ্গীত। কজন গায়কের ভাগ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটে?

আবদুল জব্বার কিন্তু এর আগে থেকেই আমাদের ঘরে ঘরে পরিচিত ছিলেন। বাংলা সিনেমার সাদাকালো বা ইস্টম্যান কালারের যুগে তিনি আসতেন রেডিও আর রূপালি পর্দা ভেদ করে। এবার থেকে ঢুকে গেলেন প্রাণর গভীরে– ওই এক অসামান্য গান দিয়ে।

বাংলাদেশের মানুষের মনে "তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়" বা "তারাভরা রাতে" র মতো গান খুব বেশি নেই। এখনও মনে পড়ে সেই সহজ সাধারণ জীবনের দিনগুলিতে তিনি কতটা আপন আর কতটা জায়গাজুড়ে ছিলেন। সবাই বলে, আমাদের দেশের গান নাকি ওপার বঙ্গের তুলনায় কিছু নয়। আমি তা মানি না। আমার ধারণা, তফাৎ ছিল প্রচারে। পার্থক্য ছিল, আমাদের যন্ত্র-যন্ত্রী আর মিডিয়ার পাওয়ারে। সে কারণে কণ্ঠ থাকার পর বা গানের সুর ও কথা ভালো হবার পরও অনেক সময় সেগুলো ক্লিক করতে পারেনি।

আবদুল জব্বার সে সময়ের এমন এক কণ্ঠ যাঁকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। "পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি" গানটি আবার শুনে দেখুন– মর্ডান বা আধুনিক গান কাকে বলে। কাকে বলে সুরের সঙ্গে কণ্ঠের ওঠানামা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা যুগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে "সালাম সালাম হাজার সালাম""জয় বাংলা বাংলার জয়" সহ অংসখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া যুুদ্ধের সময়কালে তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। তৎকালীন কলকাতাতে অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের ক্যাম্প ঘুরে হারমোনি বাজিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন যা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। সে সময় বিভিন্ন সময় গণসঙ্গীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ রুপি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় ভূমিকা, সেই অগদূতের আসন তাঁকে অমর করবে। তাঁর কণ্ঠে গীত "জয় বাংলা বংলার জয়" গানটি নানা দ্বন্দ্বে বিতর্কিত করেছি আমরা। কিন্তু ইতিহাস বলে, এই গান আমাদের মুক্তিদাতা। কী দুর্ভাগ্য, এই গানের সুরকার ও গীতিকার দুজনই আওয়ামী ধারার সঙ্গে ছিলেন না। সুরকারের বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ "প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ" এর মতো একটি শ্রুতিপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। প্রয়াত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কেন এই গান পছন্দ করলেন তাতেই শাহনাজ হয়ে গেলেন অচ্ছ্যুৎ!

একইভাবে "জয় বাংলা বাংলার জয়" গেয়ে আবদুল জব্বারের কপালেও দুর্ভোগ নেমেছিল বৈকি। হয়তো সে কারণে তাঁকে আমরা মাঝে মাঝে দলবদলের নামে পাগলামি করতেও দেখেছি। কিন্তু তাতে তাঁর মান বা মর্যাদায় আঘাত লাগেনি।

তিনি যেবার সিডনি এলেন তাঁর গানের অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল নেমেছিল। তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত নুরুল আজাদ। সিডনির বাংলাদেশিদের নানাভাবে পথ-দেখানো নুরুল আজাদ ছিলেন এখানকার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন অষ্ট্রেলিয়ায় প্রথম বাংলাদেশি মুদ্রিত পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। অকালপ্রয়াত এই ভদ্রলোক আবদুল জব্বারকে নিয়ে এসেছিলেন সেই চেতনা থেকে। বয়সের ভারে তখন কিছুটা শ্লথ হলেও আবদুল জব্বার অনায়াসে জয় করে নিয়েছিলেন মানুষের মন।

অনুষ্ঠান শেষে তাঁর সঙ্গে আলাপের সুযোগে বুঝেছিলাম, তাঁর অন্তরজুড়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যাঁরা একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ লাভ করেছেন তাঁরা সারাজীবনে সে ঘটনা ভুলতে পারেননি। আর আবদুল জব্বার তো সেই ভাগ্যবানদের একজন বঙ্গবন্ধু যাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর গান শুনেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া সেই ছবিটি দেখুন– বুঝবেন এখনকার শিল্পীরা যখন রাজনৈতিক খায়েশ পূরণের জন্য গায় বা নেতানেত্রীদের বন্দনা করে, তার সঙ্গে এই ছবির তফাৎ কোথায়। জাতির জনক চোখ মুদে গানে বুঁদ আর আবদুল জব্বারেরও চোখ বন্ধ।

এই বিনিময় এখন আর চোখে পড়ে না। এখন যা দেখি তার নাম স্বার্থ।

আবদুল জব্বার সে শিল্পীদের একজন যাঁরা আমাদের দেশমুক্ত করার সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। সময়ের সঙ্গে প্রায় মুছে যাওয়া সে ইতিহাসের কাণ্ডারি। তিনি গান গেয়ে প্রেরণা যুগিয়ে চুপ থাকেননি। টাকা তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে। তাঁর জীবনের এই দিকটি গৌরবের।

তাই বলব, ব্যক্তিজীবনের কিছু সামান্য খামখেযালিপনার বাইরে যে মহান আবদুল জব্বার– যিনি আমাদের মুক্তির সৈনিক– তাঁকে যেন ভুলে না যাই আমরা। সব মানুষের জীবনে এমন সময় আসে না যখন দেশের পক্ষে কাজ করার সুযোগ ঘটে। আবার ঘটলেও সবাই তা করেন না। সবটুকু ভালোবাসা আর নিষ্ঠা দিয়ে আবদুল জব্বার দায়িত্বটুকু পালন করেছিলেন।

গানের কথাই যদি বলি, আমাদের দেশে মৌলিক গানের সংখ্যা হাতেগোনা। সেখানেও এক বিশাল আকাশ তাঁর দখলে। "হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে" এই গানটি যারা জানেন বা শুনেছেন তারা এ-ও মানবেন যে, এই গানে চোখ ভিজে আসে। "শিউলি-গন্ধে ভেজা সোনার আলোক" — এমন কথায় এখন আর গান লেখা হয় না। তেমন দরাজ কণ্ঠও আর নেই। ভাবীকালের গায়ক-গায়িকাদের ভেতর সামনে যাবার নামে যে প্রতিযোগিতা সেটা ছিল না সে কালে। আবদুল জব্বারেরা উঠে এসেছিলেন সময়ের হাত ধরে। তাদের শুরু ছিল সাধনায়। যতদিন সে জায়গাটা ছিল ততদিন তিনি আমাদের দিয়েছেন অসাধারণ গানের মালা। "ওরে নীল দরিয়া" গানটি যে শ্রুতপ্রিয়তা পেয়েছে সেটি যে কোনো শিল্পীর কাছে ঈর্ষণীয়। যতদিন বাংলাদেশের নদীগুলো বয়ে যাবে– যতকাল সমুদ্রের নীল ঢেউ মন মাতাবে– ততকাল এই গান বাজবে পথেঘাটে, অন্দরের বাদ্যযন্ত্রে আর মানুষের হৃদয়ে।

জীবনের নদী বেয়ে জীবনশেষের দরিয়ায় পৌঁছে যাওয়া মানুষ আর ফেরে না। একটু ভুল সময়ে তাঁর তিরোধান হয়েছে বলব। যেদিন তিনি বিদায় নিলেন সে দিন আমাদের জাতির ইতিহাসমুকুটে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। আমাদের ক্রিকেটাররা হারিয়ে দিয়েছে অজিদের। যে অষ্ট্রেলিয়া নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে একসময় বাংলাদেশে আসতে চায়নি তাদের হারানোর দ্বিগুণ আনন্দে উদ্বেল জাতি মহান এই গায়ককে হারানোর শোক ভুলে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। তবে আমরা নিশ্চিত, বেঁচে থাকলে এতে তাঁর মুখে বরং হাসেই ফুটত। কারণ এই বিজয়, এই সম্মান, এই গৌরবের পেছনে যে পতাকা– যে দেশ– যে মাটি– সে তো তাঁর মতো মানুষদেরই অবদান।

নীল দরিয়ার স্রোতে ভাসমান বাংলাদেশিদের আনন্দমুখর জীবনের এই গায়ককে জাতি কোনোদিন ভুলবে না। আবদুল জব্বার নিজেই গেয়েছিলেন, "আমায় দে রে দে ছাড়িয়া" । মুক্ত মানুষ আপনি এখন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, হে প্রিয় গায়ক।