আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা ভোট দিতে পারবে তো?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 6 Sept 2017, 02:45 PM
Updated : 6 Sept 2017, 02:45 PM

১৬ আগস্ট সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা আবশ্যক বলে মনে হবে সেগুলো করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য নির্বাচনকালীন 'সহায়ক' সরকারের কথাও কেউ কেউ বলছেন। আর প্রায় সবাই নির্বাচন কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর যাতে কোনো অত্যাচার-নিপীড়ন না হয় সেটা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। পৃথকভাবে এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে অঙ্গীকার পাওয়ার খবর কোনো গণমাধ্যমে দেখিনি। কিন্তু বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা দেখেছি, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছিল। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়। সহায়-সম্বল হারিয়ে তীব্র শীতের মধ্যে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরে। আক্রমণের সময় বনে-জঙ্গলে-আখ ক্ষেতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচনের আগের রাতে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট দিলে বিপদ হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভয়ে-আতঙ্কে অনেক জায়গায় হিন্দুরা ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছেও যায়নি। তারপরও তারা আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সে সময় পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, দিনাজপুরের একজন আক্রান্ত ব্যক্তি, অনন্ত চন্দ্র রায় দুঃখ করে বলেছিলেন, "ভোট এলেই আমাদের উপর নির্যাতন নেমে আসে। কোনোদিন কি এর প্রতিকার হবে না? কেমন করে এদেশে থাকবে?"

এই জিজ্ঞাসা এখন শুধু অনন্ত রায়ের নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের কমবেশি সব সদস্যেরই। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণে-অকারণে তাদের উপর হামলা ও আক্রমণ হয়। জীবন অনিরাপদ করে তোলা হয়। সম্পদ লুটপাট করা হয়। জায়গা-জমি জবরদখল হয়ে যায়। আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এটা মানুষের জীবন নয়। ভোটের সময় হামলা-আক্রমণের ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি নির্বাচনের আগে-পরেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার আগে-পরে এই হামলা-আক্রমণের ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি হামলা-নির্যাতনের সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির জড়িত থাকলেও কাউকেই তখন গ্রেফতার করা হয়নি, আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হয়নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশা করা হয়েছিলে ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রতিটি ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত হবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি বিধান করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো মহাজোট সরকারের আমলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর– আরেও স্পষ্ট করে বললে– বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। কোনো ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতকারীরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে এমন প্রমাণ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে দুএকটি মামলা হয়েছে, দুএকজনকে গ্রেফতারও হয়তো করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। ফলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করা, তাদের জীবন বিপন্ন করে তোলা, ত্রাসের মধ্যে তাদের বসবাসে বাধ্য করা যেনে তাদের 'নিয়তি' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতিধর্মনির্বিশেষে দেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু নানান রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি আমাদের দেশের রাজনীতিতে ঠাঁই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সমাজে-রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে-প্রশাসনে যতে শক্তি সঞ্চয় করেছে, দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতার উপাদান ততই বেড়েছে। উদারতা, সহনশীলতার পরিবর্তে উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটেছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি প্রকটভাবে দেশের উপর চেপে বসার সুযোগ পেয়েছে।

জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে এই উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে আপোস করেছে মধ্যপন্থার রাজনৈতিক শক্তি। এখন তার খেসারত গুনতে হচ্ছে গোটা দেশকে। উগ্রবাদ এবং গণতন্ত্র যে একসঙ্গে চলতে পারে না এটা না বুঝতে পারার ব্যর্থতার কারণেই দেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে সেটাও এই উগ্রপন্থার রাজনীতির পরিণতি।

রাজনীতি থেকে সব ধরনের উগ্রবাদীদের হটাতে না পারলে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যারা একদিনের ভোটের গণতন্ত্রের শুদ্ধতার জন্য বিলাপ করেন, তারা সাধারণ মানুষের জীবন সংহার করছে যে উগ্রবাদী রাজনীতি, তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটিও করছেন না।

মধ্য-ডানপন্থার রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে উগ্র-ডানের জামায়াতে ইসলামীর বেশিমাত্রায় মাখামাখির কারণেই দেশের রাজনীতিতে যে উগ্রধারার বিস্তার ঘটছে তাতে সন্দেহ নেই। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশের রাজনীতিতে আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চলছে তার জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত যে একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী দল সেটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। এই দল গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গোপনে নিজেদের সহিংস রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাদখলের সম্ভাবনা না দেখেই তারা সশস্ত্র ক্যাডারবাহিনী গড়ে তুলেছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাথায় রেখে।

বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয় জামায়াতের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করেছে। জামায়াত যে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে গ্রাস করে ফেলছে এটা বিএনপি বুঝতে পারছে না। বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা এক নয়। জামায়াতের আশু লক্ষ্য হল, যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে বিএনপির লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। দেশের মধ্যে অরাজকতা-নৈরাজ্য তৈরি হলে জামায়াতের লাভ, বিএনপির ক্ষতি। কিন্তু দলটি অন্ধ আওয়ামী-বিরোধিতার কারণে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচন। অথচ জামায়াতের প্ররোচনায় বা ফাঁদে পড়ে বিএনপি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে উল্টো নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে দলটি নিজেদের গণতান্ত্রিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। নির্বাচন প্রতিহত করা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিএনপি কেন নিজেরা নির্বাচন বর্জন করে ভোটারদের নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পরিবর্তে নির্বাচন প্রতিহত করার সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে? এই প্রশ্নের উত্তর বিএনপির সকল স্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জানতে চাইতে হবে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে কয়েক মাস জুড়ে যেভাবে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানো হয়েছে, নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে তা কোনোভাবেই গণতন্ত্রসম্মত নয়। গণতন্ত্রে বলপ্রয়োগের সুযোগ নেই। শক্তির জোর নয়, যুক্তির জোরই গণতন্ত্রের সার কথা। অথচ বিএনপি জামায়াতের খপ্পরে পড়ে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে জড়িয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য কত বড় ক্ষতি করেছে সেটা তারা এখন বুঝতে না পারলেও একসময় এজন্য তাদের আফসোস করতে হবে।

বলা হচ্ছে, দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিএনপি আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলনের মূল কথা হল, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হল, ধর্মবিশ্বাসের কারণে দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে চায় তাদের কোন বিবেচনায় গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি বলে ধরা হবে? দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, হিন্দু সম্প্রদায়সহ আরেও কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভোটদানে বিরত রাখার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাদের মধ্যে বিএনপির নামও রয়েছে। আগে এই কাজ বিএনপি-সমর্থকরা রেখে-ঢেকে করলেও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর এটা তারা নগ্নভাবেই করছে। জামায়াতি রাজনীতির উগ্রপন্থার প্রভাব বিএনপিকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছে যে, তারা গণতন্ত্রের নাম করে এমন সব কর্মকাণ্ড করছে যা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিএনপি-নেতৃত্বকে এটা বুঝতে হবে যে, উগ্রপন্থা এবং গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। বলপ্রয়োগ, ভয়-ভীতি দেখানো আর গণতন্ত্র সমান্তরাল পথে চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা যদি বিকশিত করতে হয় তাহলে হিংসার পথ পরিহার করে, সন্ত্রাস-নাশকতার ইতি টেনে বিএনপিকে শান্তির পথেই ফিরে আসতে হবে। বলপ্রয়োগে দাবি আদায়ের কৌশল ত্যাগ করে যুক্তির জোরের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। শান্তি ও সমঝোতার পথে না হাঁটলে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণ করা যাবে না।

ক্রমাগত হামলা-নির্যাতনে টিকতে না পেরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি নিরূপায় হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয় তাহলে আপাতদৃষ্টিতে উগ্রপন্থার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয় হলেও শেষ বিচারে ক্ষতি হবে দেশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির। বাংলাদেশকে যারা একটি উগ্র-জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন উদার গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষের এক হয়ে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেও বেছে নিতে হবে তারা উগ্রপন্থার সহায়ক হবে নাকি গণতান্ত্রিক ধারার পক্ষে অবস্থান নেবে।

সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অবস্থান এবং মনোভাবও আগের মতো নেই। আওয়ামী লীগ আর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঝাণ্ডাবাহী থাকতে চায় বলে মনে হচ্ছে না। ভোটের রাজনীতির জটিল সমীকরণ এই দলকেও ধর্মাশ্রয়ী করে তুলছে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তারা এখন দোদুল্যমান, আপসকামী। মার খেতে খেতে সংখ্যালঘুরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তাই তারা কোনো দলের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায় না। তাদের মধ্যেও বিভিন্ন ধারার রাজনীতি ক্রিয়াশীল।

সংখ্যালঘুদের ভোট নিয়ে যে রাজনীতি তা তাদের জীবন ক্রমাগত অনিরাপদ করে তুলছে। আগামী নির্বাচনে কোনো ব্যতিক্রম দেখা যাবে কি?