প্রসঙ্গ ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা

সাইফুর রহমান তপন
Published : 26 August 2017, 03:28 PM
Updated : 26 August 2017, 03:28 PM

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমােলোচনা। তবে তাঁর একটি পর্যবেক্ষণ জনমনে বেশ ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তিনি বলেছেন, `No country is made of or by one person'– এর বাংলা করা যায় এভাবে: "কোনো জাতি বা দেশ একজন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত হয় না, আবার তা এক ব্যক্তির চেষ্টারও ফসল নয়।"

অভিযোগ উঠেছে, এ মন্তব্য মূলত বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এবং এটা ইতিহাস-বিকৃতির সামিল। তাই, সম্ভবত, প্যারাফ্রেজ করে অভিযোগকারীরা বলছেন যে, প্রধান বিচারপতি ওই পর্যবেক্ষণে বলেছেন, 'কোনো এক ব্যক্তির দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি'।

তবে অনেকে, বিশেষ করে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে যারা উল্লসিত, বলছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ পর্যবেক্ষণ বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে দেননি, বঙ্গবন্ধু তো নয়ই। এর সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁরা বলছেন, রায়ে বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে 'শেখ মুজিবর রহমানের নাম' মোট '১১' বার এসেছে। এর মধ্যে পাঁচ বারই এসেছে প্রধান বিচারপতির অংশে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শব্দটি বিচারপতিরা মোট 'নয়' বার ব্যবহার করেছেন। যার মধ্যে 'তিন' বারই ব্যবহার করেছেন প্রধান বিচারপতি।

রায়ে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে যে সম্বোধন করা হয়েছে, তা-ও তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, যিনি বা যাঁরা এতবার বঙ্গবন্ধু শব্দটি জপেছেন তিনি বা তাঁরা এদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করতে পারেন এমনটা তাঁরা নিজেরা বিশ্বাস করেন না; অন্যদেরও বলছেন তা বিশ্বাস না করার জন্য।

কিন্তু যারা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো করার অভিযোগ করছেন, তাঁরা এসব যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, ষোড়শ সংশোধনীর সঙ্গে তথাকথিত আমিত্বের দূরতম সম্পর্ক নেই। প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ আমিত্বের প্রসঙ্গটি এনেছেন। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি 'অন্যায়ভাবে' বঙ্গবন্ধুকে হেয় করেছেন। রায়ে 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি কতবার উল্লিখিত আছে তা দিয়ে এ অন্যায়ের প্রতিকার হয় না।

তাদের এ বক্তব্য সমর্থন করেন এমন একজন, সম্প্রতি, এক আড্ডায় ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ব্যবহারের বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস থেকে একটা ঘটনার কথা বলেছেন যা এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হিজরি ৩৭ সালের সিফফিন যুদ্ধে হযরত আলী যখন বিজয়ের দ্বারপান্তে তখন প্রতিপক্ষ হযরত মুয়াবিয়ার সেনারা বর্শাফলকের মাথায় কোরআন বেঁধে আক্রমণে নামেন। কোরআন দেখে হযরত আলীর সেনারা একটু দ্বিধায় পড়ে গেলে আলী তাদেরকে ওই কোরআনসহ পাল্টা আঘাত করার নির্দেশ দেন।

যাহোক, আইনের শাসনে বিশ্বাসী যে কোনো নাগরিকের মতো আমরাও মনে করি যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় যেমন সবার জন্য অবশ্যপালনীয় তেমনি তাদের পর্যবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে যে কোনো স্তরে বিচারের ক্ষেত্রে এসব পর্যবেক্ষণ– শুধু দেশে নয় বিদেশেও– রেফারেন্স হিসেবে আসতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই সরকার ও সরকার-সমর্থক একটা বিরাট জনগোষ্ঠী ষোড়শ সংশোধনী রায়ের আরও কয়েকটি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি উক্ত পর্যবেক্ষণ নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন।

তাদের এ উদ্বেগ উপেক্ষা করে আর যা-ই হোক দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা– যা নিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি তাঁর পূর্বসূরী যে কারও চেয়ে একটু বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়– সম্ভব নয়। শুধু তা নয়, প্রধান বিচারপতির উক্ত পর্যবেক্ষণে আসলেই যদি কোনো সমস্যা থাকে তা শুধু ইতিহাস-বিকৃতির সামিল হবে না, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এ জাতির আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেওয়ার যে অশুভ ধারা সূচিত হয়েছিল তার পালেও বাতাস দেবে।

এ কারণেই উক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রধান বিচারপতি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা খতিয়ে দেখাটা জরুরি মনে করছি।

এটা ঠিক যে, বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে প্রধান বিচারপতির বাক্যটি– No country is made of or by one person– একটা আপ্তবাক্যের বেশি কিছু মনে হবে না। আর এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, এ আপ্তবাক্য সব কালে সব জাতি বা দেশের জন্য প্রযোজ্য। কেবল একজন ব্যক্তি নিয়ে কোথাও একটা দেশ বা জাতি গঠিত হয়েছে এমন চিন্তা শুধু অবাস্তব নয় পাগলামিও বটে। আবার কোনো একজন নেতা যখন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তখন তাঁর বহু সহযোগীর প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

প্রশ্ন হল, মাননীয় প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনীর রায় দিতে গিয়ে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন কেন?

রায়টি যারা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, প্রসঙ্গটি এসেছে প্রধান বিচারপতির 'আমিত্ব-বিরোধী' সংগ্রামের অংশ হিসেবে, যদিও তাঁর এ সংগ্রাম 'ডন কুইক্সোটিক' আখ্যা দিলে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না। এটা ভুল হবে না এজন্য যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী কোনো এক ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে আনা হয়নি; এটা বর্তমান সরকার-ঘোষিত ধারাবাহিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ১৯৭২এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কর্মসূচিরই অংশ।

প্রতিটি সংগ্রামেরই পক্ষ ও বিপক্ষ থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতি কাকে বিপক্ষ মনে করছেন? এটা বোঝার জন্য আমাদেরকে ওই আপ্তবাক্যের পরের বাক্য পড়তে হবে, যেখানে বলা হয়েছে:

If we want to truly live up to the dream of Sonar Bangla as advocated by our father of the nation, we must keep ourselves free from this suicidal ambition and addiction of 'I'ness. That only one person or one man did all this and etc.

অর্থাৎ, আমরা যদি আসলেই জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই এই আত্মঘাতী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আমিত্বের আসক্তি ছাড়তে হবে যে, 'কেবল একজন ব্যক্তি বা একজন মানুষই সবকিছু করেছে…'।

বাক্যের শেষাংশটি কি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে না?

গত ৪৬ বছরে যখনই কেউ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকারী ভূমিকার কথা বলতে চেয়েছেন তখনই একটি বিশেষ মহল থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারও একক অবদান নয়। বর্তমান সরকার যখনই বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে চেয়েছে তখনই বলা হয়েছে, কেবল একজন ব্যক্তি বা একটা পরিবারই 'সবকিছু' করেছে এমন চিন্তা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, নানা– বেশিরভাগই অগুরুত্বপূর্ণ– রেফারেন্স টেনে এদেশে এখনও এটা প্রমাণ করার প্রয়াস চলে যে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধই চাননি। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন তাদেরকে 'দলকানা' বলে গালি শুনতে হয়। এ প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে ওই বাক্যাংশ পড়লে যে কেউ এর অর্থ এবং তা বলার পেছনে বক্তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন।

মজার বিষয় হল, যাঁরা 'প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল' বলে নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা– সচেতন বা অসচেতনভাবে– তাদের বক্তব্যে এ বাক্যাংশ উদ্ধৃত করেন না।

প্রেক্ষাপট মাথায় রাখার গুরুত্ব বোঝাতে শরৎচন্দ্র চট্টেপাধ্যায়ের একটি কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, কোনো কিছুর মর্ম উপলব্ধি করতে হলে তার কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট মাথায় থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, যে ব্যক্তি জানে না রাধা কে আর যমুনার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী সে যখন 'যমুনা পুলিনে বসি কাঁদে রাধা বিনোদিনী' এ বিখ্যাত কীর্তনটি শোনে তখন তার কাছে মনে হয় লোকটা কী আবোলতাবোল গাইছে। আর যে বিষয়টা জানে সে এ পদটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবে, 'আহ্!'

দশকের পর দশক বঙ্গবন্ধুবিরোধী অপপ্রচারের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদেরও ওই শেষোক্ত ব্যক্তির মতো বোধশক্তি গড়ে ওঠেছে। তাদের ঘ্রাণশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ হয়েছে যে, কোন কথাটা বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মানমূলক আর কোনটা অসম্মানমূলক তা তাঁরা দুয়েকটা শব্দ শুনেই বুঝে ফেলেন।

যারা বলছেন প্রধান বিচারপতি ওই একই রায়ে সামরিক একনায়ক জিয়া ও এরশাদকেও কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন তাদের মনে রাখা উচিত যে, বিশেষ করে জিয়ার অনুসারীরা কিন্তু ওই রায়ে ভীষণভাবে উল্লসিত। তারা রাজনৈতিক কস্ট-বেনিফিট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইতোমধ্যেই ওই রায় 'ঐতিহাসিক' বলে আখ্যা দিয়েছেন। রায়ের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ভক্তদেরকে ভিন্ন কিছু ভাবতে বাধ্য করতে আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের নেতৃত্বকারী দলের এ উল্লাসই যথেষ্ট।

বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। তাদের এ কথার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা আরেকটি লেখায় আলোচনা করব। কিন্তু তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই যে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কে কোন ভূমিকা রেখেছেন এবং সেজন্য তাদেরকে কীভাবে সম্মান জানানো হয় তার বর্ণনা দিয়েছেন, এটা বোঝার জন্য কাউকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন তিনি সরকার বা বিরোধী দল কারও 'ফাঁদে' পড়বেন না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি ইতোমধ্যেই– কারণ যা-ই হোক– সুশীল সমাজ নামে যে একটা বিশেষ গোষ্ঠী গত কয়েক দশকে এদেশে গজিয়ে ওঠেছে তাদের খপ্পরে পড়েছেন। কথাটা এ জন্য বলা হল যে, উক্ত বিতর্কিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি যেটি প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন, তা নিয়ে পাশ্চাত্যের স্বঘোষিত বিশ্বমোড়লদের আশীর্বাদপুষ্ট ও অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ওই মহল অনেকদিন ধরে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এরা ইতিহাসে যার যা অবদান তাকে তার 'যোগ্য সম্মান' বুঝিয়ে দেওয়ার নামে একদিকে অযৌক্তিকভাবে বিভিন্নজনকে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে দাঁড় করাচ্ছে– আরেকদিকে অপপ্রচার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর দলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।

নিশ্চয়ই, সত্যের ঢোল যেমন আপনি বাজে, তেমনি ইতিহাসে যার যা অবদান তা বেশিদিন মাটিচাপা দিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু যে সমস্যা রাজনৈতিক তার নিরসন রাজনৈতিকভাবে হতে দেওয়াই ভালো। এখানে আদালতের মতো দল বা রাজনীতি-নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ সমস্যাটি আরও জটিল করে তুলতে পারে।